মুসলমান কাউকে কাফের ফতোয়া দিতে চূড়ান্ত সতর্কতা কাম্য

মুসলমান কাউকে কাফের ফতোয়া দিতে চূড়ান্ত সতর্কতা কাম্য
                               রেজাউল কারীম আবরার
কোন শাখা-প্রশাখাগত মতানৈক্যের কারণে, একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে, অস্পষ্ট কথা অথবা এমন আকীদা ও বাক্য, যার দ্বারা কাফের হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মতানৈক্য রয়েছে, সে সমস্ত বিষয় দ্বারা কোন মুসলমানকে কাফের বলার ক্ষেত্রে অসতর্কতার অর্থ হলো, নিজের ঈমানকে শংকায় ফেলা। কারণ, এমতাবস্থায় ঈমানকে কুফর বলা জরুরী হয়ে যায়। ঠিক এমনভাবে নিশ্চিত কোন কাফেরকে মুসলমান বলাও মারাত্মক দৃষ্টতা এবং নিজের ঈমানকে শংকায় ফেলার শামিল। আর একথা স্পষ্ট যে , ঈমানকে কুফর বলা অথবা কুফরকে ঈমান বলা যদি নিজের ইচ্ছায় হয়, তাহলে নিশ্চয় সেটা কুফর। অন্যথায় তা কুফরের আশংকা থেকে খালি নয়।
এছাড়া কোন কাফেরকে মুসলমান বলে দেওয়া শুধু শাব্দিক দৃষ্টতা নয়। বরং পুরো মুসলিম উম্মাহর উপর অত্যাচারের শামিল। পুরো মুসলিম সামাজিক জীবনে এর প্রভাব পড়বে। বিবাহ, বংশ, মিরাছ, জবেহকৃত প্রাণী, ইমামতি, নামাজ, সম্মিলিত এবং রাজনৈতিক সর্ব বিষয়ে এর প্রভাব পড়বে। এজন্য কুফরের যে সূরতকে ইলহাদ বা জিনদিক বলা হয়, তার বিষয়টি খুবই মারাত্মক। এখানে সামান্য অসতর্কতার কারণে একজন মুসলমানকে কাফের বানিয়ে দেওয়া হবে। আর আরেকজন ইসলামের মারাত্মক দুশমনকে ইসলামের বন্ধু বানিয়ে দিবে। আর এ দুই বিচ্যূতি উম্মাহকে মারাত্মক সমস্যায় ফেলবে।
আজকাল এ দুটি বিষয় এতটা সহজ হয়ে গেছে যে, কুফর, ইসলাম, ঈমান এবং ইরতেদাদ এর নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি নেই। একটি দল এমন যাদের কাজই হলো, মানুষের বিরুদ্ধে কুফরের ফতোয়া প্রদান করা। শরীয়তের বিপরীত কোন কথা বরং অনেক সময় নিজের মতের বিপরীত কথা বললেই তাদের পক্ষ থেকে কুফরের ফতোয়া চলে আসে। সামান্য শাখা-প্রশাখাগত মাসআলার উপর ভিত্তি করে প্রতিপক্ষকে ইসলাম থেকে বের করে দিই।
এদের বিপরীত আরেকটি দল রয়েছে, যারা মুসলমান দাবীদার প্রত্যেককেই মুসলমান মনে করে। যদিও সে পুরো কুরআন, হাদীস এবং ইসলামের আহকামাদিকে কটাক্ষ করে। তারা হিন্দুদের মতো ইসলামকে একটি জাতিগত লকব মনে করে। আকীদা তুমি যা মন চায়, তা পোষণ কর। কথা এবং কর্মের দিক দিয়ে তুমি স্বাধীন। এরপরও তুমি মুসলমান। এটাকে তারা নিজেদের চিন্তার প্রশস্ততা বলে মনে করে।
এ মাসআলায় এ কথার উপর খেয়াল রাখা জরুরী যে, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। মাসআলার উভয় দিকে চূড়ান্ত সতর্কতা কাম্য। যেমনভাবে কোন মুসলমানকে কাফের বলা মারাত্মক দৃষ্টতা, এমনকি যে বলবে, তার ঈমান আশংকায় পড়ে যায়। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী যে মুসলমানকে কাফের বলে, সে কাফের হয়ে যায়। এমনভাবে কাফেরকে মুসলমান বলাও মারাত্মক দৃষ্টতা। যেমননটি “শিফা” এর ইবারতে উল্লিখিত হয়েছে।
“ولمثل هذا ذهب ابو المعالي في اجوبته الى محمد عبد الحق وكان سئله عن المسئلة فاعتذر له بأن الغلط فيه يصعب لأن إدخال كافر في الملة الإسلامية او إخراج مسلم عنها عظيم في الدين.
অর্থাৎ আবুল মাআলি মুহাম্মাদ আবদুল হক এর প্রশ্নের জবাবে ওযরখাহি করেন। কেননা এ বিষয়ে ভুল করা মারাত্মক বিষয়। কেননা কোনো কাফেরকে মুসলমানদের মধ্যে শামিল করা অথবা কোনো মুসলমানকে কাফের বলা অত্যান্ত নাজুক বিষয়। (শারহে শিফা, ২/৫০০)
এজন্য এদিকে সতর্কতা রাখা জরুরী যে, যদি কোন ব্যক্তির অস্পষ্ট কথা সামনে আসে, যে কথার একাধিক সম্ভাবনা রয়েছে, সবগুলো সম্ভাবনা থেকে কুফরি আকীদা প্রকাশ পায়, শুধুমাত্র একটি একটি সম্ভাবনা এমন, যার দ্বারা সহীহ আকীদা প্রমাণিত হয়, তাহলে মুফতি এবং কাজির জন্য ফরজ হলো, সে সম্ভাবনাকে গ্রহণ করে ওই লোককে মুসলমান বলা হবে। আর যে ব্যক্তির মধ্যে কুফর আবশ্যক হয়ে যাবে, তাকে কাফের ফতোয়া দিতে মোটেই বিলম্ব করা যাবে না । যেমনটা উম্মতের আলেমদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছে।
কাজী ইয়াজ রহ. বলেন-
و كذلك نقطع بتكفير كل من كذب و أنكر قاعدة من قواعد الشرع ، و ما عرف يقيناً بالنقل المتواتر من فعل الرسول ، و وقع الإجماع المتصل عليه ، كمن أنكر وجوب الخمس الصلوات أو عدد ركعاتها و سجداتها ، و يقول : إنما أوجب الله علينا في كتابه الصلاة على الجملة ، و كونها خمساً ، و على هذه الصفات و الشروط لا أعلمه ، إذ لم يرد فيه في القرآن نص جلي ،
অর্থাৎ এমনভাবে অকাট্যভাবে কাফের বলা হবে সে ব্যক্তিকে, যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অকাট্যভাবে বিশাল একটি গোষ্ঠির কথা অথবা কর্মের দ্বারা প্রমাণিত কোন বিষয়কে মিথ্যা বলবে। অথবা অস্বীকার করবে। যে বিষয়ের উপর সকলের ইজমা তথা ঐক্যমত হয়ে গেছে। যেমন কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, অথবা তার রাকাত সংখ্যা, অথবা রুকু বা সিজদাকে অস্বীকার করল। সে বলল, আল্লাহ কুরআনে নামাজকে ওয়াজিব বলেছেন। কিন্তু এসমস্ত শর্তাবলি এবং গুণাবলিকে আমি মানি না। কেননা এ ব্যাপারে কুরআনে কোন আয়াত নেই। (আশ শিফা বি তা’রিফি হুকুকিল মুসতাফা, ১/৪৫৮ মাকতাবাতুশ শামেলা)
“শারহে শিফা”তে রয়েছে-
“وكذالك انعقد إجماعهم على أن مخالفة السمع الضروري كفر وخروج عن الإسلام.
অর্থাৎ এমনিভাবে এ কথার উপর ইজমা তথা ঐক্যমত হয়েছে যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত রেওয়ায়াতকে অস্বীকার করা কুফর এবং ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণ। (. শারহে শিফা, পৃষ্ঠা নং, ১২১)
কাফের ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
” ثلاث من أصل الإيمان الكف عمن قال لا إله إلا الله ولا نكفره بذنب ولا نخرجه من الإسلام بعمل…..
অর্থাৎ তিন জিনিস হল ঈমানের মূল। যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়েছে, তাঁর ব্যাপারে বিরত থাকা। কোন গোনাহের কারণে আমরা তাকে কাফের বলব না। এবং কোন আমলের কারণে ইসলাম থেকে বের করে দিব না। (. আবু দাউদ, ২৫৩২ শায়খ মুহি উদ্দীন আবদুল হামীদ তাহকিককৃত। সুনানে সাইদ বিন মানসুর, ২৩৬৭, মাকাতাবাতুশ শামেলা)
হাদীসের শেষ অংশেতো পরিস্কার বলা হয়েছে যে,কালেমা পড়–য়া মুসলমানকে ততক্ষণ কাফের বলা যাবে না, যতক্ষণ তার কোন কথা বা কাজ দ্বারা কুফর ওয়াজিব হবে না। অথবা এমন ব্যাখ্যা করবে, যা স্পষ্ট উম্মতের ঐক্যমতের বিপরীত।
দ্বিতীয়ত, হাদীস থেকে জানা গেল, কোন মুসলমানকে গুনাহের কারণে চাই সেটা যত বড়ই হোক, কাফের বলা যাবে না । কিন্তু উম্মতের আলেমরা এ বিষয়ে একমত যে, এখানে গুনাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুফর ছাড়া অন্যান্য গুনাহ। উদ্দেশ্য হল, আমলের কমতি, পাপাচার যতই বেশি হোক না কেন? এর কারণে কোন আহলে কেবলাকে কাফের বলা যাবে না । এটা উদ্দেশ্য নয় যে, ইসলামের অকাট্য বিধানের বিরোধিতা করলেও তাকে কাফের বলা যাবে না ।
জাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের এবং মুসায়লামা কাযযাবের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ব্যাপারে সাহাবাদের ঐক্যমত একথার স্পষ্ট দলিল যে, আহলে কেবলাকে কাফের বলা নিষিদ্ধ দ্বারা এ উদ্দেশ্য নয় যে, যারাই কেবলার দিকে মুখ করে নামাজ পড়বে, তাদের কোন বাতিল আকীদার কারণে তাদেরকে কাফের বলা যাবে না! বরং জানা গেল কালেমা পড়–য়া এবং আহলে কিবলা দুটি পারিভাষিক শব্দ। তাদের মধ্যে শুধু সে সমস্ত মুসলমানরা শামিল, যারা ইসলামের নিদর্শনাবলি যেমন নামাজ, রোযা আদায়ের সাথে সাথে কুফরকে ওয়াজিবকারী বাতিল আকীদা থেকে বেঁচে থাকে।
কথায় কথায় কাফের ফতোয়া দেওয়া বর্তমানে আমাদের সমাজে ক্যান্সার আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর মাসআলাকে আমরা সবচেয়ে সহজ বানিয়ে ফেলেছি! আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *