মুনকিরে হাদীস তথা হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকার, বর্তমান যুগের নতুন ফিতনা, প্রয়োজন বাস্তবমুখি পদক্ষেপ 

মুনকিরে হাদীস তথা হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকার, বর্তমান যুগের নতুন ফিতনা, প্রয়োজন বাস্তবমুখি পদক্ষেপ 
                                                                     রেজাউল কারীম আবরার
মুনকিরে হাদীস তথা হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকারের ফিতনা নতুন নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদীসে উম্মতকে তাদের সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। হাদীসকে বাদ দিয়ে কুরআনের উপর আমল করা সম্ভব নয়, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবয়ে তাবেয়ীন বিষয়টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে মানুষদের বুঝিয়েছেন। যুগে যুগে এমন বহু মানুষ দাঁত গজিয়েছে। খতীবে বাগদাদীর ‘আল কিফায়া’ থেকে শুরু করে যুগে যুগে অসংখ্য মুহাদ্দিস তাদের অসার দলীলগুলোর চোয়ালভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন।
মুসতাশরিক তথা প্রাচ্যবিদরা এ ফিতনাটি হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকারের ফিতনাকে ধীরে ধীরে মুসলমানদের মাঝে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করেছে। আবু হুরায়রার মত সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী, ইবনে শিহাব যুহরীর মত মুহাদ্দিসদের উপর ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে তাদের বর্ণিত হাদীসে সুক্ষ্মভাবে সন্দেহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে হাদীস লেখা হয়নি এমন বানোয়াট অভিযোগ তুলে হাদীসের প্রামাণিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। ড. আবু শাহাবা রহ., শায়খ মুসতাফা আস সিবায়ী রহ., আল্লামা মানাজির আহসান গিলানী রহ., শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানী দা.বা. সহ আরো অনেকে তাদের অসার প্রশ্নের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে বিজ্ঞ উস্তাদের সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জনের কথা বলেছেন্ কারণ বিজ্ঞ মানুষের সান্নিধ্যে থেকে না পড়লে শয়তান যে কোনো সময় আপনাকে বিপদগামী করে ফেলতে পারে। যুগে যুগে এমন নজীর অসংখ্য রয়েছে। বিজ্ঞ উস্তাদের সান্নিধ্য না থাকায় অনেক মেধাবী ভ্রান্ত পথের পথিক হয়েছেন। তাহকীক এবং গবেষণার নামে ভ্রান্ততার অতঁলান্ত আধারে হারিয়ে গেছেন। বিজ্ঞ উস্তাদের সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করা প্রসঙ্গে প্রথমে কয়েকটি হাদীস দেখুন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্ট বলেছেন যে,দ্বীনি ইলম শিক্ষা করতে হয় আলেমের সান্নিধ্যে থেকে। একা একা পড়ে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা যায়না। তিনি বলেন:
্র مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْراً يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ، وَإِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ
অর্থাৎ,আল্লাহ যার কল্যাণ চান,তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন। আর ইলম অর্জন করতে হয় অন্যের সান্নিধ্যে থেকে।(বুখারী,হাদীস নং,৬৭.)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (৮৫২হিঃ) এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন-
والمعنى ليس العلم المعتبر الاالمأخوذ من الأنبياء وورثتهم على سبيل التعلم
অর্থাৎ,শুধুমাত্র সে ইলম গ্রহণযোগ্য,যা নবীদের থেকে অথবা নবীর ওয়ারিসদের থেকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে অর্জিত হয়।(ফাতহুল বারী ১/২৯৪.দারুল মারেফা, বায়রুত)
আল্লামা আইনী রহঃ(৮৫৭হিঃ) বলেন-
أي ليس العلم المعتد إلا المأخوذ عن الأنبياء عليهم الصلاة والسلام على سبيل التعلم والتعليم
অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য ইলম হল যা নবীদের থেকে শিক্ষাদানের পদ্বতিতে অর্জিত হয়। (উমদাতুল কারী,২/৪৫৮.মাকতাবাতুশ শামেলা)
নবীর ওয়ারিছ কারা? একাধিক হাদীসে বলা হয়েছে যে,আলেমরা নবীর ওয়ারিছ।
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. বলেন-
إنَّ الرَّجُلَ لاَ يُولَدُ عَالِمًا ، وَإِنَّمَا الْعِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ
অর্থাৎ কোন মানুষ আলেম হয়ে জন্ম গ্রহণ করেনা। বরং কারো সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করতে হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা,হাদীস নং,২৬৬৪৬.শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দাঃবাঃ তাহকীককৃত)
ইলম অর্জনের চিরসত্য এ পথ থেকে আজকের অনেকেই উদাসীন। উস্তাদের প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেন না। নেটে সার্চ দিয়ে, ইউটিউবে লেকচার শুনে অথবা অনূদিত বই পড়ে নিজেকে মুজতাহিদ মনে করতে শুরু করেন! ফলশ্রুতিতে ঈমান বিধ্বংসী কথাবার্তা তাদের মুখ থেকে বের হয় দেদারসে।
নিজে নিজে এক দুটো বাংলা বই পড়ে সহীহ হাদীসের অনুসারী হয়ে যাওয়ার ধোয়া তুলে যে ফিতনা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগ থেকে, পরিণতিতে অনেক বিপদগামী তরুণ বর্তমানে সরাসরি হাদীসের প্রামাণিকতাকে অস্বীকার করছে! কত ভয়ংকর কথা! হাদীস মানা যাবে না! কুরআন আমাদের জন্য যথেষ্ট! ইমরান বিন হুসাইন রা. এর সময় এক ব্যক্তির খটকা লেগেছিল। সে ইমরান বিন হুসাইন রা. কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন-
“إنك أحمق,أتجد الظهر في كتاب الله أربعا؟لا يجهر فيها القراءة!ثم عدد عليه الصلاة و الزكاة و نحو هذا,ثم قال: أتجده في كتاب الله مفسرا؟! إن كتاب الله أبهم هذا و إن السنة تفسره”
অর্থাৎ তমি একজন অহম্মক। তুমি কি কোরআনে পেয়েছো জোহরের নামাজ চার রাকাত? তাতে কেরাত উচ্চস্বরে পড়া হবেনা? এতপর অন্যান্য নামায এবং যাকাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, উপরোক্ত বিষয়গুলো তুমি কি কোরআনে বিস্তারিতভাবে পাবে? কোরআনে বিষয়গুলোকে অস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। “সুন্নাহ”তে বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। (আল কিফায়াহ, খতীবে বাগদাদী, পৃষ্টা নং ৩০)
ইমাম মাকহুল রহঃ থেকে বর্ণিত:
“القراّن أحوج إلى السنة من السنة الى القراّن”
অর্থাৎ সুন্নাহ কোরআনের চেয়ে কোরআন সুন্নাহর বেশি মুখাপেক্ষি। (আল কিফায়া ৩০, দারুল কিতাবিল আরাবী)
আইয়ুব সাখতিয়ানি রহ. বলেন-
“أذا حدثت الرجل باالسنة فقال:دعنا من هذا,و حدثنا من القراّن فاعلم أنه ضال مضل”
অর্থাৎ যখন তুমি কারো কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের হাদীস বর্ণনা করবে, সে তখন বলবে, এগুলো বাদ দিয়ে কোরআন থেকে বর্ণনা কর, তাহলে তুমি জেনে রাখ নিশ্চই সে পথভ্রষ্ট। (আল কিফায়া,৩১.দারুল কিতাবিল আরবী)
ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদী রহ. (মৃত্যু১৯৮হিঃ) বলেন-
الرجل إلى الحديث أحوج منه إلى الآكل والشرب.و قال:الحديث تفسير القراَن”
অর্থাৎ: মানুষ খাওয়া -দাওয়া এবং পানাহারের চেয়ে হাদীসের অধিক মুখাপেক্ষী। (আল কিফায়া, ৩১)
ঈমান বিধ্বংসী ভয়ংকর এ ফিতনা থেকে তরুণদের বাঁচাতে হলে আমাদের এখনি সতর্ক হতে হবে। দ্বীনের সঠিক দাওয়াত তাদের নিকট পৌঁছাতে হবে।

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *