আশুরার দিন ভালো খাবার সংক্রান্ত হাদীস, একটি পর্যালোচনা

আমাদের দেশে একটি প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আশুরার দিন প্রত্যেকেই তার সামর্থ অনুযায়ী ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে। এ সংক্রান্ত একটি হাদীসও মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। প্রথমে আমরা হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব।
হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي سَائِرِ سَنَتِهِ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবার পরিজনের জন্য সচ্ছলতার (ভালো খাবারের) ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ণ বছর সচ্ছলতার সাথে রাখবেন।(. আল মু’যামুল কাবীর, তাবারানী,হাদীস নং, ১০০০৭, শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস নং ৩৫১২,)
ইবনে মাসউদ রা. থেকে হাদীসটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ وَسَّعَ عَلَى عِيَالِهِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ لَمْ يَزَلْ فِي سَعَةٍ سَائِرَ سَنَتِهِ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবার-পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সারা বছর সাচ্ছন্দ্যে রাখবেন। (. বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং, ৩৫১৩)
এছাড়াও হাদীসটি আবু হুরায়রা রা. এবং আবু সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং ৩৫১৪-৩৫১৫, সাঈদ যাগলুল তাহকীককৃত।)
এ বর্ণনার উপর ভিত্তি করে সমাজে আশুরার দিন ভালো খাবারে রীতি চালু হয়েছে। কিন্তু কোনো বিষয়ে আমল করার আগে সে সম্পর্কিত হাদীসটি ভালো করে তাহকীক করে নেওয়া জরুরী। এজন্য এ হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য নিম্নে উল্লেখ করছি।
হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসরা দুইভাগে বিভক্ত। অনেক মুহাদ্দিস একে সরাসরি জাল বলে দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই জাল বলতে আপত্তি করেছেন। কেননা হাদীসটি বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য তারা বলেছেন যে, হাদীসটি যয়ীফ বা দুর্বল। আর কোন বিষয়ের মর্যাদা প্রমাণের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করা সর্বজনবিদিত।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন-
لا يصح هذا الحديث
অর্থাৎ হাদীসটি সহীহ নয়। (আল মানারুল মুনীফ, ইবনুল কায়্যিম, পৃষ্ঠা নং ১১২, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ তাহকীককৃত।)
ইমাম উকায়লী রহ. বলেন-
ولا يثبت في هذا عن النبي صلى الله عليه وسلم شئ إلا شئ يروى عن إبراهيم بن محمد بن المنتشر مرسلا به
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ সংক্রান্ত কোনো কিছুই প্রমাণিত নয়। হ্যাঁ, ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির থেকে বিষয়টি প্রমাণিত। (আয যুআফাউল কাবীর, উকায়লী ৩/২৫২)
ইমাম যাহাবী রহ. হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আলী বিন মুহাজিরের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
لا يدرى من هو ، والخبر موضوع
অর্থাৎ আলী বিন মুহাজির অজ্ঞাত। তার পরিচয় জানা যায় না। আর বর্ণনাটি জাল। (মিযানুল এতেদাল ৫/ ১৯১)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে উকায়লী রহ. বলেন-
وسليمان مجهول و الحديث غير محفوظ ولا يثبت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في حديث مسند.
অর্থাৎ হাদীসের বর্ণনাকারী সুলাইমান মাজহুল। তাঁর অবস্থা জানা যায়নি। আর হাদীসটি সঠিক নয়। হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়নি। (আল মাওযুয়াত, ইবনুল জাওযী, ২/৫৭৩ )
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, হাদীসটি জাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। এরপর তিনি বলেন-
لم يصح في عاشوراء إلا فضل صيامه
অর্থাৎ আশুরার রোযা রাখার ফযীলত ব্যতীত অন্য কিছু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। (মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ, ৭/১৯ মুহাম্মাদ রাশাদ সালিম তাহকীককৃত।)
আরেক জায়গায় শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন-
ورووا فى حديث موضوع مكذوب على النبى انه من وسع على اهله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر السنة ورواية هذا كله عن النبى صلى الله عليه و سلم كذب ولكنه معروف من رواية سفيان بن عيينة عن ابراهيم بن محمد بن المنتشر عن ابيه قال بلغنا انه من وسع على اهله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر سنته وابراهيم بن محمد بن المنتشر من اهل الكوفة
অর্থাৎ আশুরার দিন ভালো খাবার খাওয়ানো সংক্রান্ত হাদীসটি জাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মিথ্যাচার। কিন্তু সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা এর বর্ণনায় তিনি মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিন পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ তায়ালা সারা বছর তাকে সাচ্ছন্দে রাখবেন। আর ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির হলেন কুফার অধিবাসী।
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর এ বক্তব্য থেকে বুঝা গেলো যে, বর্ণনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। বরং মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির এর কথা।
ইমাম যারকাশী রহ. বলেন-
لا يثبت إنما هو من كلام محمد ابن المنتشر،
অর্থাৎ বর্ণনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়; বরং এটি হলো মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির এর কথা। (মাজমুয়াতু ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া, ২৫/৩০০)
আল্লামা ইবনে রাজাব হাম্বলী রহ. বলেন-
وأما التوسعة فيه على العيال فقال حرب: سألت أحمد عن الحديث الذي جاء: من وسع على أهله يوم عاشوراء) فلم يره شيئا، وقال ابن منصور: قلت لأحمد: هل سمعت في الحديث: (من وسع على أهله يوم عاشوراء أوسع الله عليه سائر السنة) فقال: نعم رواه سفيان بن عيينة عن جعفر الأحمر عن إبراهيم بن محمد عن المنتشر وكان من أفضل أهل زمانه أنه بلغه: أنه من وسع على عياله يوم عاشوراء أوسع الله عليه سائر سنته. قال ابن عيينة: جربناه منذ خمسين سنة أو ستين سنة فما رأينا إلا خيرا. وقول حرب أن أحمد لم يره شيئا إنما أراد به الحديث الذي يروى مرفوعا إلى النبي – صلى الله عليه وسلم -، فإنه لا يصح إسناده وقد روي من وجوه متعددة لا يصح منها شيء. وممن قال ذلك محمد بن عبد الله بن عبد الحكم، وقال العقبلي: هو غير محفوظ وقد روي عن عمر من قوله وفي إسناده مجهول لا يعرف.
অর্থাৎ তিনি প্রথমে হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম আহমদের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। ইবনে মানসুর বলেন, আমি ইমাম আহমদকে বললাম, আপনি কি আশুরার দিন পরিবারকে ভালো খাওয়ানো সংক্রান্ত হাদীসটি শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা জাফর থেকে, তিনি মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির থেকে বর্ণনা করেছেন। আর মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির হলেন ভালো মানুষ।
এরপর ইবনে রাজাব হাম্বলী রহ. বলেন, এ বর্ণনাটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনোটিই সহীহ নয়।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বর্ণনাটিকে ‘মুনকারুন জিদ্দান’ (মারাত্মক আপত্তিকর) বলেছেন।
ইবনে মাসউদ রা. এর বর্ণনায় একজন বর্ণনাকারী হলো হাইসাম। তাঁর ব্যাপারে ইবনে হিব্বান রহ. বলেন,
الهيصم يروى الطامات لا يجوز الاحتجاج به.
অর্থাৎ হাইসাম বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করে। তাঁর বর্ণনা দ্বারা দলীল পেশ করা জায়েয নেই।( লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা নং- ৭৬-৭৭ দারুল হাদীস কাহেরা।)
এখানে বেশ কয়েকজন মুহাদ্দিসের বক্তব্য উল্লেখ করলাম। তাদের মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ ধরণের কোনো হাদীস প্রমাণিত নয়। কারো কারো মতে এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস নয়; বরং মুহাম্মাদ বিন মুনতাশিরের কথা।
ওদিকে মুহাদ্দিসদের আরো একটি দল হাদীসটিকে জাল মানতে নারাজ। তাঁদের মতে হাদীসটি জয়ীফ। নিম্নে আবদুল হাই লাখনভী রহ. এর লম্বা আলোচনা তুলে ধরছি। তিনি বলেন-
وأما حديث التوسعة على العيال فأخرجه الطبراني عن ابن مسعود مرفوعا من وسع على عياله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر سنته وفي سنده الهيضم بن شداخ مجهول وأخرجه البيهقي في شعب الإيمان وقال تفرد به هيضم عن الأعمش وأخرجه ابن عدي عن أبي هريرة مرفوعا ((من وسع على عياله وأهله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر سنته)) وفي سنده سليمان بن أبي عبد الله الراوي عن أبي هريرة مجهول كذا ذكره ابن الجوزي في الموضوعات وقال المنذري في كتاب الترغيب والترهيب رواه البيهقي من طرق عن جماعة من الصحابة وقال البيهقي هذه الأسانيد وإن كانت ضعيفة فهي إذا ضم بعضها إلى بعض أخذت قوة انتهى
وقال زين الدين العراقي في أماليه ورد في هذا الحديث من طرق صحح بعضها الحافظ ابن ناصر وسليمان الذي قال فيه ابن الجوزي مجهول ذكره ابن حبان في الثقات فالحديث حسن على رأيه وقد روى من حديث أبي سعيد عند البيهقي في شعب الإيمان وابن عمر عند الدار قطني في الأفراد وجابر ورواه البيهقي من رواية ابن المنكدر عنه وقال إسناده ضعيف
ورواه ابن عبد البر في الاستذكار من رواية أبي الزبير عنه وهي على شرط مسلم قال البيهقي هذه الأسانيد وإن كانت ضعيفة فهي إذا ضم بعضها إلى بعض أحدثت قوة هذا مع كونه لم تقع له رواية أبي الزبير عن جابر التي هي أصح طرق الحديث وقد ورد موقوفا على عمر أخرجه ابن عبد البر بسند رجالة ثقات لكنه من رواية ابن المسيب عنه وقد اختلف في سماعه منه ورواه في الشعب من قول إبراهيم بن محمد بن المنتشر وأما قول الشيخ تقي الدين بن تيمية إن حديث التوسعة ما رواه أحد من الأئمة وإن أعلى ما بلغه من قول ابن المنتشر فهو عجب منه كما ترى وقد جمعت طرقه في جزء انتهى كلام العراقي
وفي جواهر العقدين في فضل الشرفين لنور الدين السمهودي لا يلزم من قول أحمد في حديث التوسعة أنه لا يصح أن يكون باطلا فقد يكون غير صحيح وهو صالح للاحتجاج به إذ الحسن رتبته بين الصحيح والضعيف انتهى
وفي تنزيه الشريعة قول الإمام أحمد لا يصح لا يلزم منه أن يكون باطلا كما فهمه ابن القيم فقد يكون الحديث غير صحيح وهو صالح للاحتجاج به بأن يكون حسنا انتهى
قلت بهذا كله بطل قول الشوكاني(১) في الفوائد المجموعة في الأحاديث الموضوعة بعد نقل شيء من كلام العراقي ذكره ابن الجوزي في الموضوعات وابن تيمية في فتوى له فحكم بوضع الحديث من تلك الطرق والحق ما قالاه انتهى كلامه
وجه البطلان أنه كيف يكون ما قال ابن الجوزي وابن تيمية حقامع كونهما من المشددين المتعنتين في الحكم بالوضع على ما بسطته في رسالتي الأجوبة الفاضلة للأسئلة العشرة الكاملة وفي تعليقات تحفة الطلبة في مسح الرقبة المسماة ((بتحفة الكملة)) وقد تعقبهما جمع من العلماء المحققين وأثبتوا كون الحديث حسنا إما لذاته ببعض أسانيده وإما لغيره بجمع أسانيده بالبراهين لا بمجرد الظن والتخمين فانظر إلى ما قال ولا تنظر إلى من قال
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম তাবারানী রহ. ‘আল মু’যামুল কাবীর’এ ইবনে মাসউদ রা. থেকে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন হাইসাম বিন শাদ্দাখ, সে হলো মাজহুল। ইমাম বায়হাকী রহ. ‘শুআবুল ঈমান’এ ইবনে মাসউদের সূত্রে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। বায়হাকী রহ. বলন, হাদীসটি হাইসাম বিন শাদ্দাখ একাকী বর্ণনা করেছেন।
ইবনে আদী রহ. আবু হুরায়রা রা. এর সূত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সনদে আবু আবদুল্লাহ সুলাইমান নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। সে মাজহুল।
ইমাম মুনযীরী রহ. ‘আত তারগীব ওয়াত তারহীব’ কিতাবে বলেন, ইমাম বায়হাকী রহ. অনেক সাহাবা থেকে বিভিন্ন সনদে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। ইমাম বায়হাকী বলেন, হাদীসের সনদগুলো যদিও দুর্বল, কিন্তু যখন একটার সাথে অপরটি যুক্ত করা হবে, তখন হাদীস শক্তিশালি হয়ে যাবে।
হাফেজ যায়নুদ্দীন ইরাকী রহ. বলেন,হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। হাফেজ ইবনে নাসির কিছু সনদকে সহীহ বলেছেন। সুলাইমান নামক যে বর্ণনাকারীকে ইবনুল জাওযী মাজহুল বলেছেন, ইবনে হিব্বান তাকে ছিকাহ রাবীদের জীবনী শীর্ষক গ্রন্থ “কিতাবুস সিকাত” এর মধ্যে তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং ইবনে হিব্বানের মত অনুসারে হাদীসটি হাসান।
ইমাম বায়হাকী “শুআবুল ঈমান” এ হাদীসটি আবু সাইদ খুদরী রা. এর সূত্রেও উল্লেখ করেছেন। ইমাম দারা কুতনী রহ. ইবনে উমর থেকে বর্ণনা করেছেন ‘কিতাবুল আফরাদ’ এ। ইমাম বায়হাকী এমনভাবে ইবনুল মুনকাদির এর সূত্রে জাবের রা. থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। জাবের রা. থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবু যুবায়র। সনদটি মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ। এছাড়া মাওকুফভাবে উমর রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আবদিল বার মালেকী রহ. উল্লেখ করেছেন এমন সনদে, যার বর্ণনাকারী সকলেই ছিকাহ। কিন্তু উমর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন সায়িদ ইবনুল মূসায়্যিব। উমর রা. থেকে তাঁর হাদীস শুনা প্রমাণিত কিনা? এবিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
ছাড়া ইমাম বায়হাকী মুহাম্মাদ বিন মুনতাশিরের কথা হিসাবেও উল্লেখ করেছেন। ইবনে তাইমিয় রহ. এর কথা ‘হাদীসটি কোনো ইমাম বর্ণনা করেননি; বরং এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশিরের কথা’ এটা আশ্চর্যজনক কথা! যেমনটা আপনি দেখে আসলেন। ইরাকী রহ. বলেন, হাদীসটির সনদ আমি আলাদা একটি ছোট পুস্তিকায় একত্রিত করেছি।
‘জাওয়াহিরুল ইকদ’ নামক কিতাবে ইমাম নুরুদ্দীন সামহুদী রহ. বলেন,ইমাম আহমদ রহ. যে বলেছেন, ‘হাদীসটি সহীহ নয়’ এর দ্বারা হাদীসটি বাতিল প্রমাণিত হয় না। কেননা সহীহ এবং যয়ীফের মাঝামাঝি হলো হাসান।
আল্লামা ইবনে আররাক কাত্তানী রহ.ও এমনটা বলেছেন। অর্থাৎ ইমাম আহমদের বক্তব্য দ্বারা হাদীসটি বাতিল প্রমাণিত হয় না। যেমনটা বুঝেছেন ইবনুল কায়্যিম। কোনো হাদীস এমন হয় যে, হাদীসটি সহীহ নয়। কিন্তু দলীলযোগ্য। অর্থাৎ হাদীস সহীহ না হয়ে হাসান হয়।
কাত্তানী রহ. বলেন, এই পুরো আলোচনা দ্বারা ইবনুল জাওযী এবং ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়ে যায়। কেননা তারা উভয়ে হাদীসটিকে জাল বলেছেন!
ইবনুল জাওযী এবং ইবনে তাইমিয়া এর বক্তব্য কীভাবে সঠিক হবে? অথচ তারা হলেন হাদীসকে জাল হুকুম আরোপ করতে চরম কঠোরতাকারী! এবিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার লিখিত ‘আল আযওয়িবাতুল ফাজিলা’ নামক কিতাবে। অনেক মুহাক্কিক আলেম তাঁদের কথার বিরোধিতা করেছেন এবং প্রমাণিত করেছেন যে, হাদীসটি হাসান পর্যায়ের। হয়তো ‘হাসান লি যাতিহি’। কিছু সনদের কারণে। অথবা ‘হাসান লি গাইরিহি’ । অনেকগুলো সনদ থাকার কারণে। শুধুমাত্র ধারণার কারণে নয়। সুতরাং কি বলছে? তা দেখ! কে বলছে? তা দেখো না! . (আল আছারুল মারফুআ, পৃষ্ঠা নং- ৮৩-৮৫. )
আবদুল হাই লাখনভী রহ. এর এ দীর্ঘ বক্তব্য থেকে বুঝা গেলো যে, তিনি হাদীসটিকে জাল মানতে নারাজ। তাঁর মতে হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে হাসান পর্যায়ের। শুধুমাত্র আবদুল হাই লাখনোভী রহ. নয়, সুয়ূতি, ইবনে আররাক, মোল্লা আলী কারী, আজলূনী এবং মুনাভী রহ. ও এনমটা বলেছেন।
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. মুহাদ্দিসদের বক্তব্যগুলোকে সামনে রেখে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, হাদীসটি জাল নয়। বরং যয়ীফ। এজন্য তিনি আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. লিখিত ‘আল মানারুল মুনীফ’ এর শেষে উক্ত কিতাবের হাদীসগুলোকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। একভাগে জাল বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছেন। অপরভাগে দুর্বল বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছেন। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. আশুরা সংক্রান্ত এ বর্ণনাটি দুর্বল বর্ণনার ভাগে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বুঝা গেলোযে তাঁর তাহকীক অনুসারে বর্ণনাটি জাল নয়। বরং যয়ীফ বা দুর্বল।
                                                      আমাদের করণীয় কী?
যেহেতু অনকে মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলেছেন এবং সম্ভবত তাঁদের কথা অধিক সঠিক। এজন্য উক্ত হাদীসের উপর বেশি গুরুত্ব না দেওয়া উচিৎ। মানুষের নিকট প্রচার না করাই ভালো। বাকী কেউ যদি অন্যান্য মুহাদ্দিসদের কথা মেনে নিয়ে আশুরার দিন পরিবার পরিজনের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করে, তাহলে তাঁর সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া উচিৎ নয়।

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *