“তোমরা এত অধিক জিকির করো যে মানুষ তোমাদের পাগল বলে” সংক্রান্ত হাদীসের তাহকীক

“তোমরা এত অধিক জিকির করো যে মানুষ তোমাদের পাগল বলে” সংক্রান্ত হাদীসের তাহকীক

অধিক পরিমাণে জিকিরের গুরুত্ব সংক্রান্ত একটি হাদীস অনেকেই বর্ণনা করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أكْثِرُوا ذِكْرَ الله حَتّى يقولوا مَجْنُونٌ
তোমরা এত অধিক পরিমাণে জিকির করো যে, জিকিরকারীদের লোকেরা পাগল বলবে।
বর্তমানের কেউ কেউ এ হাদীসকে জাল বলছেন। আসলে এটা শাস্ত্রীয় মানদণ্ডে জাল কি না? এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। প্রথমে আমরা হাদীসটি সনদ পর্যালোচনা করব।

এ হাদীসটি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহি. স্বীয় ‘মুসনাদ’ এ উল্লেখ করেছেন। পুরো সনদ হলো:
حَدَّثَنَا حَسَنٌ حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ حَدَّثَنَا دَرَّاجٌ عَنْ أَبِي الْهَيْثَمِ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ أَكْثِرُوا ذِكْرَ اللَّهِ حَتَّى يَقُولُوا مَجْنُونٌ
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বর্ণনা করেছেন হাসান থেকে, তিনি ইবনে লাহিয়া থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন দাররায থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন আবুল হাইছাম থেকে, তিনি আবু সাঈদ খুদরি রাযি. থেকে, তিনি বর্ণনা করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। মুসনাদে আহমদ: ১১৬৭৪।

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ছাড়াও আরও অনেকে ইমামগণ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে হিব্বান রাহি., ইমাম তাবারানী রাহি. ইমাম আবু ইয়ালা আল মাওসিলি রাহি., হাকিম নিশাপুরি রাহি., ইমাম বায়হাকী রাহি. সহ আরও অনেক ইমাম দাররায এর সনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সহিহ ইবনে হিব্বান: ৮১৭, কিতাবুদ দোয়া: তাবারানি, ৫২১, মুসনাদে আবি ইয়ালা আল মাওসিলি: ১৭৩৬, আল মুসতাদরাক: ১৮৩৯, শুআবুল ঈমান: বায়হাকি, ৫২৬।

এ হাদীস বর্ণনা করার পর হাকিম নিশাপুরী বলেন:
هذه صحيفة للمصريين صحيحة الإسناد و أبو الهيثم سليمان بن عتبة العتواري من ثقات أهل مصر
অর্থাৎ সনদের দিক থেকে হাদীসটি সহিহ। সনদের একজন বর্ণনাকারী আবুল হাইছাম সুলাইমান বিন উতবা মিশরে ছিক্বাহ বর্ণনাকারীদের একজন। আল মুসতাদরাক: ১৮৩৯।

ইমাম সাখাবী রাহি. এ হাদীস বর্ণনা করে বলেন:
حديث ( أكثروا ذكر الله حتى يقولوا مجنون )
أحمد وأبو يعلى والبيهقي في الشعب وغيرها من حديث ابن وهب عن عمرو بن الحارث عن دراج أبي السمح عن أبي الهيثم عن أبي سعيد به مرفوعا وصححه الحاكم وللبيهقي من حديث عمرو بن مالك عن أبي الجوزاء رفعه مرسلا ( أكثروا ذكر الله حتى يقول المنافقون إنكم مراؤن )
অর্থাৎ এ হাদীসটি ইমাম আহমদ, আবু ইয়ালা আল মাওসিলি, ইমাম বায়হাকী “শুআবুল ঈমান” এ এবং আরও অনেক ইমাম ইবনে ওয়াহাবের সূত্রে, তিনি আমর বিন হারিছ থেকে, তিনি দাররায আবুস সামহ থেকে, তিনি আবুল হাইছাম থেকে, তিনি আবু সাঈদ খুদরি রাযি থেকে এবং তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটিকে হাকিম নিশাপুরি সহিহ বলেছেন। আল মাকাসিদুল হাসানাহ: ১৪৬।

ইসমাঈল আজলুনি রাহি.ও ইমাম সাখাবি রাহি. এর বক্তব্য নকল করেছেন। তিনি সাখাবী রাহি. এর বক্তব্যের উপর কোন পর্যালোচনা করেন নি। কাশফুল খাফা: ৪৯৭।

ইমাম ইবনে মায়ীন রাহি. ও হাদীসের বর্ণনাকারী দাররায এবং আবুল হাইছামকে ছিক্বাহ বলেছেন এবং এ হাদীসকে সহিহ বলেছেন। দুরী বর্ণনা করেন:
سمعت يحيى يقول وسئل عن حديث دراج عن أبي الهيثم عن أي سعيد فقال ما كان هكذا الإسناد فليس به بأس فقلت له إن دراجا يحدث عن أبي الهيثم عن أبي سعيد عن النبي صلى الله عليه وسلم قال أصدق الرؤيا بالأسحار ويروى أيضا اذكروا الله حتى يقولوا مجنون فقال هما ثقتان دراج وأبو الهيثم قال يحيى وقد روى هذه الأحاديث عمر بن الحارث قلت ليحيى دراج من هو قال مصري وهو أبو السمح قلت ليحيى أبو الهيثم من هو قال مصري واسمه سليمان بن عمرو
অর্থাৎ আমি ইয়াহইয়া বিন মায়ীন রাহি. কে বলতে শুনেছি, তাকে দাররায আবু হাইছাম থেকে, তিনি আবু সাঈদ খুদরী থেকে এ সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বললেন, এ সনদে কোন সমস্যা নেই।
আমি বললাম, দাররায আবুল হাইছাম থেকে, তিনি আবু সাঈদ খুদরী রাযি. এর সূত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, সবচেয়ে সত্য স্বপ্ন হলো সেহরির সময় দেখা স্বপ্ন। এমনভাবে এই সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তোমরা এত অধিক পরিমাণে জিকির করো যে, লোকেরা জিকিরকারীদের পাগল বলবে।
জবাবে ইবনে মায়ীন রাহি. বলেন: দাররায এবং আবুল হাইছাম উভয়ে ছিক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী। তারিখু ইবনে মায়ীন রেওয়াত দুরী: ২/১৩৮

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহি.ও এ বর্ণনাকে হাসান বলেছেন। তার বক্তব্য মুনাবী রাহি. নকল করেছেন। তিনি বলেন:
(حم ع حب ك هب عن سعيد) الخدري رمز المصنف لصحته وهو فيه تابع لتصحيح الحاكم له وقد اقتصر الحافظ ابن حجر في أماليه على كونه حسنا وقال الهيثمي بعدما عزاه لأحمد وأبي يعلى فيه دراج ضعفه جمع وبقية رجال أحد إسنادي أحمد ثقات.
অর্থাৎ এ হাদীসকে ইমাম সুয়ুতী রাহি. ‘জামিউস সাগীর’ এ সহিহ বলেছেন। মূলত তিনি হাকিম নিশাপুরি রাহি. এর হুকুমের অনুসরণ করেছেন। ইমাম ইবনে হাজার আসকালনী রাহি.ও ‘আমালী’ তে এ হাদীসকে ‘হাসান’ বলেছেন। ফায়যুল কাদীর: ৩/৩৬২।

মূলত হাদীসের বর্ণনাকারী দাররায নিয়ে দুই ধরণের মন্তব্য পাওয়া যায়। ইমাম ইবনে মায়ীন রাহি. হাকিম নিশাপুরী রাহি. সহ কেউ কেউ তাকে ছিক্বাহ মনে করতেন। যার কারণে তার সূত্রে বর্ণিত হাদীসকে সহিহ বলেছেন।

তবে কেউ কেউ দাররায এর কারণে হাদীসকে জয়ীফ বলেছেন। ইমাম হাইছামী রাহি. বলেন:
واه أحمد وأبو يعلى وفيه دراج وقد ضعفه جماعة وضعغه غير واحد وبقية رجال أحد إسنادي أحمد ثقات
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম আহমদ এবং ইমাম আবু ইয়ালা আল মাওসিলি রাহি. বর্ণনা করেছেন। হাদীসের সনদে একজন বর্ণনাকারী হলেন দাররায। তাকে একদল জয়িফ তথা দুর্বল বলেছেন। আবার কেউ কেউ বিশ্বস্ত বলেছেন। মুসনাদে আহমদ এর একটি সনদের অন্যান্য সকল বর্ণনাকারী হলেন বিশ্বস্ত। মাযমাউয যাওয়াইদ: ১৬৭৬১, দারুল ফিকর, বায়রুত।
সমকালীন যুগের অন্যতম মুহাদ্দীস শায়খ শুআইব আরনাউত রাহি. মুসনাদে আহমদ এর টীকায় এবং সহিহ ইবনে হিব্বান এর টীকায় দাররায এর কারণে হাদীসটিকে জয়িফ বলেছেন।

আজকে যারা ১৪ শত বছরের বরেণ্য মুহাদ্দিসদের মতামতকে উপেক্ষা করে এক কথায় এ বর্ণনাকে জাল বলে দিচ্ছেন, তারা বিষয়টি আশা করি ভেবে দেখবেন। তাদের অনুসৃত ব্যক্তি নাসির উদ্দিন আলবানি রাহি.ও এ হাদীসকে জাল বলেন নি। তিনি দাররায এর কারণে জয়িফ বলেছেন। আমরা যদি ধরে নিই যে, দাররায এর কারণে এ বর্ণনা জয়িফ, তারপরও মুহাদ্দিসগণের স্বীকৃত মূলনীতি হলো, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে জয়িফ হাদীস দিয়ে দলিল পেশ করা যায়। আল্লাহ সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

৫ comments

  1. মাশাআল্লাহ।
    আল্লাহ তাআলা আপনার ইলমে বারাকাহ দান করুন।

  2. মোহাম্মদ ইকবাল মাহমুদ

    মুহতারাম আবরার ভাই,
    আসসালামু আলাইকুম।
    আপনার সাইট পেয়ে অনেক খুশি হলাম। আশাকরি এ সাইট থেকে প্রয়োজনীয় মাস’আলার সমাধান পেয়ে যাব৷ একটি দলের বিভ্রান্তিকর প্রচারের মুখে আপনার দালিলিক প্রমাণ ও সমাধান এ উম্মাহকে ইমান হারা ও গোমরাহি থেকে হেফাজত করেছে।
    আল্লাহ! আপনার হেক হায়াত দান করুন। বরকতময় জীবন দান করুন। উপকারী জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।
    দোয়ার মোহতাজ।

  3. যাযাকাল্লাহু খইর

  4. আসসালামু আলাইকুম
    হাদীসের ভাষ্যানুসারে কিভাবে যিকির করব?
    আর যখন কথা আসবে কিভাবে ? অর্থাত্ পদ্ধতি বা তরিকা
    সেটি রসুল সাঃ থেকে প্রমান থাকতে হবে যেহেতু ঈবাদাত বলে কথা… তাহলে এই হদীসের আলোকে রাসু সাঃ এর যিকির কেমন ছিল? দয়া করে জানাবেন শায়েখ…

    যেহেতু এক শ্রেনীর লোক এই হাদীসকে ভিত্তি তাদের তরিকতে যিকির করছে… তাই তরিকা সম্পর্কে খোলাসা বর্ননা করা দরকার…..

  5. আসসালামু আলাইকুম
    হাদীসের ভাষ্যানুসারে কিভাবে যিকির করব?
    আর যখন কথা আসবে কিভাবে ? অর্থাত্ পদ্ধতি বা তরিকা
    সেটি রসুল সাঃ থেকে প্রমান থাকতে হবে যেহেতু ঈবাদাত বলে কথা… তাহলে এই হাদীসের আলোকে রাসুল সাঃ এর যিকির কেমন ছিল? দয়া করে জানাবেন শায়েখ…

    যেহেতু এক শ্রেনীর লোক এই হাদীসকে ভিত্তি তাদের তরিকতে যিকির করছে… তাই তরিকা সম্পর্কে খোলাসা বর্ননা করা দরকার…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *