জিকির: আল্লাহর নৈকট্যলাভের অন্যতম আমল

জিকির আল্লাহ তাআলার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। বান্দা যে সকল আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভ করে, এর মাঝে অন্যতম হলো জিকির। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসংখ্য হাদীসে জিকিরের ফজিলত বর্ণনা করেছেন। আমরা প্রথমে ধারাবাহিকভাবে জিকির সংক্রান্ত কিছু আয়াত পেশ করব।

আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًاوَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
অর্থ: হে ঈমানদারগণ, তোমরা বেশি পরিমাণে আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল সন্ধ্যায় তার তাসবিহ পাঠ করো। সূরা আহযাব: ৪১—৪২।

অধিক পরিমাণে জিকিরের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। আবদুল্লাহ বিন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“ما من قوم جلسوا مجلسا لم يذكروا الله فيه، إلا رأوه حسرة يوم القيامة.”
অর্থাৎ, কোন সম্প্রদায় কোন মজলিসে একত্রিত হয়েছে, কিন্তু আল্লাহর জিকির করে নি, তারা কিয়ামতের দিন এরজন্য আফসোস করবে। তাফসিরে কাসির: ৬/৪৩২, এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম হাইছামি রাহি. বলেন,
رواه أحمد ورجاله رجال الصحيح
অর্থাৎ এ হাদীসটি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী সকলেই বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য।

কুরআনের আয়াত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস থেকে আমরা জিকিরের গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি। আল্লাহ তাআলা অধিক পরিমাণে আমাদের জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন । বেশির পরিমাণ বুঝাতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমাদের কোন মজলিস যেন আল্লাহর জিকিরশুন্য না হয়। সব মজলিসে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের আল্লাহর জিকির করতে হবে।

অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
অর্থ. যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর জিকিরের দ্বারা তাদের অন্তরের প্রশান্তি লাভ করে। ভাল করে জেনে রাখো, আত্মার প্রশান্তি কেবলমাত্র আল্লাহর জিকিরের দ্বারাই হয়ে থাকে। সূরা রাদ: ২৮।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রাহি. লিখেন:
أي وهم تطمئن قلوبهم على الدوام بذكر الله بألسنتهم
অর্থাৎ তারা সর্বদা তাদের হৃদয়কে প্রশান্ত রাখে মুখে আল্লাহর জিকির করার মাধ্যমে।. তাফসিরে কুরতুবি: ৯/৩১৫।

অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَـٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
যারা দাঁড়ানো, বসা এবং শোয়া অবস্থায় আল্লাহর জিকির করে, আসমান এবং জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করে, হে প্রভূ, আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেন নি। সকল পবিত্রতা আপনারই। আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। সূরা আল ইমরান: ১৯১।

এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম কুরতুবী রাহি. লিখেন:
{الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَاماً وَقُعُوداً وَعَلَى جُنُوبِهِمْ} ذكر تعالى ثلاث هيئات لا يخلو ابن آدم منها في غالب أمره ، فكأنها تحصر زمانه. ومن هذا المعنى قول عائشة رضي الله عنها : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يذكر الله على كل أحيانه
অর্থাৎ এ আয়াতে বসা, দাঁড়ানো এবং শোয়া এ তিন অবস্থার কথা বলা হয়েছে। কারণ, সাধারণত বেশিরভাগ অবস্থায় মানুষ এ তিন অবস্থা থেকে কোন এক অবস্থায় থাকে। এ দিক বিবেচনায় এ যেন এ আয়াতে পুরো যুগকে শামিল করা হয়েছে। এ অর্থকে সামনে রেখেই আয়েশা রাযি. বলেছিলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা জিকির করতেন। তাফসিরে কুরতুবি: ৪/৩১০।

মূলত সর্বদা জিকির করার মধ্যে জিকরে কলবী তথা অন্তরের জিকিরও রয়েছে। অর্থাৎ হৃদয়ে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ রাখা। এটাও একপ্রকারের জিকির। এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইমাম আবু বকর জাসসাস রাহি. ব্যাপারটি নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন:
ولكنه على أحد وجهين أما الذكر بالقلب وهو الفكر في عظمة الله وجلاله وقدرته وفيما في خلقه وصنعه من الدلائل عليه وعلى حكمه وجميل صنعه والذكر الثاني الذكر باللسان بالتعظيم والتسبيح والتقديس
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যে দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে জিকিরের নির্দেশ দিয়েছেন, এটা দু্ই প্রকারের। প্রথম প্রকার হলো, জিকির বিল কালব তথা অন্তরের জিকির। সেটা হলো, আল্লাহ বড়ত্ব, তাঁর কুদরত, সৃষ্টি এবং বিধান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। আরেক প্রকার হলো, জিকির বিল লিসান তথা মুখ দ্বারা জিকির করা। সেটা হলো, মূখ দ্বারা আল্লাহর বড়ত্ব, পবিত্রতা বর্ণনা করা। আহকামুল কুরআন: ৩/২৪৭।

এ আয়াতের তাফসিরে ইবনে কাসির রাহি. লিখেন:
لا يقطعون ذِكْره في جميع أحوالهم بسرائرهم وضمائرهم وألسنتهم
অর্থাৎ তারা সর্বাবস্থায় তাদের অন্তর কিংবা মুখ দ্বারা আল্লাহর জিকির করতে থাকে। জিকির থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হয় না। তাফসিরে ইবনে কাসির: ২/১৮৪।

অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ
অর্থ. ঈমানদারদের জন্য ঐ সময় কী আসে নি যে, তারা আল্লাহর জিকির এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে সেটার দিকে ঝুকে পড়বে? তারা এমন লোকদের মতো না হয় যাদের পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। অতপর তাদের অন্তর কঠিন হয়েছে, তাদের অধিকাংশই পাপাচারী। সূরা হাদীদ: ১৬।

এ আয়াতে মূলত মুমিনের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর জিকিরের দিকে মুমিনের হৃদয় ঝুকে পড়বে। এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইমাম ইবনে কাসির রাহি. লিখেন:
يقول الله تعالى: أما آن للمؤمنين أن تخشع قلوبهم لذكر الله، أي: تلين عند الذكر والموعظة وسماع القرآن، فتفهمه وتنقادُ له وتسمع له وتطيعه.
অর্থাৎ মুমিনদের কাছে আল্লাহর জিকির করা হয়, অথবা নসিহত করা হয়, তখন তাদের হৃদয় নরম হয়। এমনভাবে কুরআন তেলাওয়াত করলে শুনে এবং অনুধাবন করে আনুগত্য করে। তাফসিরে ইবনে কাসির: ৮/১৯।

আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
অর্থ. হে ঈমানদারগণ, তোমাদের সম্পদ এবং সন্তান যেন তোমাদের আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারা ক্ষতিগ্রস্ত। সূরা মুনাফিকুন: ৯।

যিকির না করলে তার অবস্থা কেমন হবে? আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَـٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ
অর্থ. যে দয়াময় আল্লাহর জিকির থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপর একজন শয়তান একজন নিযুক্ত করা হবে, সে শয়তান তার সঙ্গী হবে। সূরা যুখরুফ: ৩৬।

মানুষ তখন সে শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। শয়তান তাকে পরিচালনা করে। উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম কুরতুবী রাহি. লিখেন:
{ فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ} قيل في الدنيا ، يمنعه يمنعه من الحلال ، ويبعثه على الحرام ، وينهاه عن الطاعة ، ويأمره بالمعصية ؛
অর্থাৎ শয়তান তাকে হালাল থেকে বাধা প্রদান করে। হারামের দিকে ধাবিত করে। আল্লাহর আনুগত্য থেকে বাধা প্রদান করে এবং গুনাহের দিকে উৎসাহিত করে। তাফসিরে কুরতুবী: ১৬/৬৮।

এ ধরণের আরও অসংখ্য আয়াত পবিত্র কুরআনে রয়েছে। যে আয়াগুলোর আলোকে জিকিরের গুরুত্ব বুঝা যায়। এটাও বুঝা যায় জিকিরের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যলাভ করে। আর আল্লাহর নিকটবর্তী বান্দা হলো, যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করে। কোন অবস্থাতে আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল হওয়া যাবে না। জিকির থেকে গাফেল হওয়ার অর্থ হলো, নিজেকে শয়তানের অনুসারী বানিয়ে ফেলা। যারা জিকির থেকে গাফেল হয়ে যায়, আল্লাহ তাদের কঠোরভাবে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সতর্ক করেছেন।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *