মুআবিয়া কী আলি রা.-কে মিম্বরে গালিগালাজের বিষয়টি ব্যাপক করেছিলেন?

মুআবিয়া কী আলি রা.-কে মিম্বরে গালিগালাজের বিষয়টি ব্যাপক করেছিলেন?

কিছু ইতিহাসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর ইবনে আবদুল আজিজ রাহ. এর পূর্বে বনু উমাইয়্যার গভর্নররা আলি রা.-কে গালিগালাজ করত। এ ‘আছার’ টি ইবনে সাদ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সহিহ নয়। ইবনে সাদ বর্ণনা করেন আলি বিন মুহাম্মাদ থেকে, তিনি লূত বিন ইয়াহইয়া থেকে, তিনি বলেন, ‘বনু উমাইয়্যারা আলি রা.-কে গালিগালাজ করত। উমর ইবনে আবদুল আজিজ খলিফা নির্বাচিত হলে তিনি গালিগালাজ বন্ধ করে দেন। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৫/১৪৭।  

এ আছারটি পরিত্যাজ্য। কারণ, এর বর্ণনাকারী আলি বিন মুহাম্মাদ হলেন জয়িফ তথা দুর্বল। আর তাঁর শায়খ লূত হলেন পরিত্যাজ্য বর্ণনাকারী। তাঁর ব্যাপারে ইবনে মায়িন বলেনে, সে ছিকাহ তথা গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী নয়। আবু হাতিম বলেন, সে পরিত্যাজ্য বর্ণনাকারী। দারা কুতনি বলেন, দুর্বল ইতিহাস বর্ণনাকারী। ‘মিজনুল এতেদাল’ এ তাঁর বিশেষণ দেওয়া হয়েছে অগ্রহণযোগ্য ইতিহাস বর্ণনাকারী বলে। মিজানুল এতোদাল: ৩/৪১৯।

 

তার অধিকাংশ বর্ণনা হলো, পরিত্যাজ্য, দুর্বল এবং মাজহুল তথা অজ্ঞাত বর্ণনাকারী থেকে। দিফা আনিস সালাফিয়্যাহ:  ১৮৭।

 

আলি রা.-কে গালিগালাজের বিষয়ে শিয়ারা মুআবিয়া রা.-কে অভিযুক্ত করেছে। তাঁদের দাবি মতে মুআবিয়া রা. মানুষকে বাধ্য করেছিলেন আলি রা.-কে গালিগালাজ করতে। এ দাবির কোনো সঠিক ভিত্তি নেই। বিদ্ধেষকারীরা হালাল হারামের তোয়াক্কা না করে তাঁর ওপর অপবাদ দিয়েছে। ফলে পরবর্তী অনেকে এটাকে মেনে নিয়েছেন তাহকিক ছাড়া! অথচ বিষয়টি কখনো সহিহ রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত নয়। দিময়ারি, ইয়াকুবি, আবুল ফারজ আসফাহানির বইয়ে যা উল্লেখ আছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। এগুলো সহিহ বর্ণনার বিপরীত। আল ইনতেসার  লিস সুহুবি ওয়াল আল: ৩৬৭, জুহাইলি।

 

কারণ, বিশুদ্ধ রেওয়ায়াতে রয়েছে তিনি আলি রা. এবং তাঁর পরিবারকে সম্মান করতেন। বনু উমাইয়্যা যুগের যে সমস্ত ইতিহাস রয়েছে, সেগুলোতে এ ধরনের কোনো কথা নেই। পরবর্তীকালে যারা আব্বাসিদের ইতিহাস লিখেছেন, তাঁদের বইয়ে এগুলো আমরা পাই। তাঁরা চেয়েছিল মানুষের কাছে বনু উমাইয়্যাকে খাটো করা। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জােআতের কিছু কিছু বইয়ে বিষয়গুলো এসেছে। কিন্তু কোনো বিশুদ্ধ বর্ণনায় নেই। এটা একটি দাবি। প্রমাণ করতে হলে সহিহ বর্ণনা লাগবে। সনদ বিশুদ্ধ হতে হবে। এমনভাবে মতন প্রশ্নমুক্ত হতে হবে। আর মুহাক্কিকরা এ বিষয়ে একমত যে, এমন দাবি থেকে মুআবিয়া রা. জোজন জোজন দূরে রয়েছেন। কারণ, তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। কিছু সাহাবা এবং সম্মানিত শ্রেষ্ঠ অনেক তাবেয়ি তাঁর প্রশংসা করেছেন। তাঁর ধর্ম, ইলম এং প্রজ্ঞার সাক্ষী দিয়েছেন। খামিসুল খুলাফায়ির রাশিদিন: ৩৫৩।

 

যিনি এমন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, তিনি কখনো মিম্বরে দাঁড়িয়ে আলি রা.-কে গালিগালাজ করতে পারেন না। এগুলো মুআবিয়া রা এর নামে মিথ্যাচার এবং তাঁর ওপর অপবাদ আরোপ করা হয়েছে। মুআবিয়া রা.-এর বদান্যতা সকলের কাছে উপমেয়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আদর্শ। তিনি কীভাবে আলি রা.-কে মিম্বরে দাঁড়িয়ে গালিগালাজ করতে পারেন?

 

শিয়ারা তাঁদের মতের পক্ষে মুসলিম শরিফের একটি হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করে থাকে। কিন্তু এ হাদিস তাঁদের দলিল হয় না। আমির বিন সাদ বিন আবু ওযাক্কাস তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, মুআবিয়া রা. সাদ রা.-কে বলেন, আলি রা.-কে গালিগালাজ করতে আপনাকে কোনো জিনিস বাধা প্রদান করেছে?

তিনি বললেন, ‘রাসুল সা. তাঁকে যে তিনটি কথা বলেছিলেন, সেগুলোর একটি যতক্ষণ আমার মনে থাকবে, ততক্ষণ আমি তাঁকে গালিগালজ করব না। তিনটির একটি যদি আমি েপেয়ে যাই, তাহলে সেটা আরবের লাল উটের মালিক হওয়া থেকে আমার কাছে অধিক প্রিয়।’ মুসলিম: ৪/১৮৭১।

 

এ হাদিস দ্বারা শিয়ারা তাঁদের মিথ্যা দাবির পক্ষে দলিল পেশ করা বিশুদ্ধ নয়। এ হাদিস দ্বারা তাঁদের মিথ্যা দাবি প্রমাণিত হয় না। ইমাম নববি রাহি. বলেন,

‘মুআবিয়া রা. কথা থেকে এটা স্পষ্ট নয় যে, তিনি আলি রা.-কে গালিগালাজের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র গালিগালাজ না করার কারণ সম্পর্কে সাদ রা.-কে জিজ্ঞাসা করেছেন। তিনি শুধুমাত্র কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। কোনো জিনিস তাঁকে গালিগালাজ থেকে বিরত রেখেছে? বুযুর্গির কারণে, নাকি ভয়ে? নাকি অন্য কোনো কারণে বিরত থেকেছ? যদি আল্লাহর ভয়ে হয়ে বাদ দিয়ে থাক, তাহলে তুমি সঠিক এবং পূণ্যের কাজ করেছ। হয়ত সাদ রা. সে দলে ছিলেন যারা গালিগালাজ করত। তিনি গালিগালাজ করেননি। আবার বাধা দিতে অক্ষম ছিলেন। এ জন্য এ প্রশ্ন করেছেন। আরেকটি ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রয়েছে। মুআবিয়া রা.-এর এ কথার অর্থ হলো, তুমি আলি রা.-এর মতো এবং তাঁর ইজেতেহাদকে ভুল বলো। লোকদের সামনে আমার মতো এবং ইজতহাদ বিশুদ্ধ হওয়ার কথা তুলে ধর।’ শরহে মুসলিম: ১৫/১৭৫।

 

‘আল মুফহিম’ এর লেখক আবুল আব্বাস কুরতুবি রাহ. এ হাদিসের সঙ্গে মুআবিয়া রা. সামনে জিরার আর সুদায়ি যে আলি রা.-এর প্রশংসা করেছেন, জেরারের কথা সত্যায়ন করে মুআবিয়া রা.-এর কান্নার কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর বলেন,

‘এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুআবিয়া রা. আলি রা. অবস্থান এবং মর্যাদার কথা জানতেন। এ জন্য আলি রা.-কে অভিশাপ এবং গালিগালাজ করার বিষয়টি বাস্তবতা থেকে দূরবর্তী বিষয়। মুআবিয়া রা. খোদাভীরু, প্রজ্ঞাবান এবং সৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আলি রা.-কে গালিগালাজের বিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে, অধিকাংশই মিথ্যা। সঠিক নয়। এ ব্যাপারে সঠিক হলো, তিনি সাদ রা.-কে বলেছেন, কোনো জিনিস তোমাকে আলি রা.-কে গালিগালাজ করতে বাধা প্রদান করেছে? এখানে গালির কথা স্পষ্ট নেই। তিনি গালি না দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেছেন। যাতে তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। তাঁর উত্তর থেকে এমনটা বোঝা যায়। উত্তর শুনে মুআবিয়া রা. প্রশান্তি লাভ করেছেন এবং এটাকে সত্য মনে করেছেন।’ আল মুফহিম: ৬/২৭৮, কুরতুবি।

 

ড. জুহাইলি তাঁর কিতাবে বলেন,

‘সাদ রা. সঙ্গে রসিকতা করে মুআবিয়া রা. এমনটা বলেছেন । তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আলি রা.-এর মর্যাদা প্রকাশ করা। কারণ, মুআবিয়া রা. ছিলেন বুদ্ধিমান এবং মেধাবী মানুষ। তিনি রসিকতা করে মানুষ থেকে বাস্তবতা বের করে আনতেন। আলি রা.-এর ব্যাপারে সাদ রা.-এর দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্য তিনি এভাবে প্রশ্ন করেছেন। এমনটা তিনি ইবনে আব্বাস রা.-এর সঙ্গেও করেছিলেন। তাঁকে বলেন, ‘আপনি কী আলি রা.-এর ধর্মে? তিনি জবাবে বলেন, ‘আলি কিংবা উসমানের ধর্মের ওপরও না। আমি হলাম মুহাম্মাদ সা.-এর ধর্মের ওপর।’ আল ইবানাহ: ১/২৫৫।

 

আমরা বুঝতে পারলাম যে, মুআবিয়া রা. ইবনে আব্বাস রা.-কে রসিকতা করে একথা বলেছিলেন। সাদ রা.-কে বলা কথাও এ পর্যায়ের। শিয়ারা এটা গালি হিসেবে ধরে নিয়েছে! মুআবিয়া রা. থেকে এমন কোনো কিছু সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। কয়েকটি কারণে এটা অসম্ভব।

  • মুআবিয়া রা. আলি রা.-কে গালিগালজ করেননি। কাউকে গালি দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেননি; বরং তিনি তাঁকে সম্মান করতেন। তাঁর মর্াঁদা এবং শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করতেন। আলি থেকে প্রমাণিত বিভিন্ন কথা দ্বারািএ বাস্তবতা স্পষ্ট হয়। ইবনে কাসির রাহ. বলেন, ‘আবু মুসলিম খাওলানি রাহ. এবং একটি দল মুআবিয়া রা.-এর কাছে প্রবেশ করলেন। তারা তাঁকে বললেন, আপনি আলির সঙ্গে ঝগড়া করেন? আপনি কি তাঁর মতো?

তিনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, তিনি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সব বিষয়ে বেশি যোগ্য।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৩৩।

 

জারির বিন আবদুল হামিদ মুগিরা থেকে বর্ণনা করেন, মুআবিয়া রা.-এর নিকট আলি রা.-এর হত্যার সংবাদ পৌঁছলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, আপনি কাঁদছেন? অথচ আপনি তাঁকে হত্যা করেছেন! তিনি বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হোক। তুমি জান না ইলম এবং প্রজ্ঞার কী বিশাল ভাণ্ডার মানুষ থেকে হারিয়ে গেছে।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৩৩।

 

আপনি কি বিশ্বাস করেন এ ধরনের কোনো মানুষ আলি রা.-কে গালিগালাজ করতে পারে? অথবা মানুষকে আলি রা.-কে গালিগালাজ করার নির্দেশ প্রদান করতে পারে?

* কোনো সহিহ সনদে আপনি দেখাতে পারবেন না যে, আলি রা. জীবিত থাকাবস্থায় তাঁর সঙ্গে যখন মুআবিয়া রা.-এর যুদ্ধ হয়েছে, তিনি তাঁকে গালিগালাজ করেছেন। তাহলে এটা কী যুক্তিসঙ্গত হবে যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অথবা আলি রা.-এর মৃত্যুর পর তিনি তাঁকে গালিগালাজ করবেন? জ্ঞানীদের নিকট এটা অসম্ভব বিষয়। তিনি নিজে গালিগালাজ না করলে অন্যকে কীভাবে নির্দেশ দেবেন?

* মুআবিয়া রা. মেধাবী এবং প্রজ্ঞাবান লোক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি যদি এটা চাইতেন যে, লোকেরা আলি রা.-কে গালিগালাজ বর্ষণ করুক, তাহলে কি সাদ রা.-এর কাছে এর কারণ জানতে চাইতেন? অথচ সাদ বীরত্ব, মর্যাদা এবং খোদাভীরুতায় অন্যান্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ! একজন সামান্য বিবেকের মানুষও এমনটা করবে না। মুআবিয়া রা.-এর পক্ষে এমনটা করা তো অসম্ভব।

* হাসান রা. সরে যাওয়ার পর মুআবিয়া রা. ছিলেন একক খলিফা। সকলেই তাঁর খেলাফতের ব্যাপারে ঐক্যমত হয়েছিল। এরপর আলি রা.-কে গালিগালাজ করার কী ফায়দা? বরং প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উত্তম হলো, গালিগালাজ না করা। কারণ, এর দ্বারা প্রশান্ত চিত্তে সব করা যাবে। আর এ বিষয়টি মুআবিয়া রা.-এর কাছে অস্পষ্ট ছিল না।

* মুআবিয়া রা. এককভাবে খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর আলি রা.-এর সন্তানদের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে যে বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। হাসান এবং হুসাইন রা. মুআবিয়া রা.-এর কাছে এলে তিনি তাঁদের উভয়কে দুই লাখ দিরহাম প্রদান করেন। তাঁদেরকে তিনি বলেন, ‘ইতিপূর্বে কাউকে আমি এত অধিক প্রদান করিনি। হুসাইন রা. জবাবে বললেন, ‘আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ কাউকে ইতিপূর্বে আপনি প্রদান করেন নি।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৩৯।

 

আরেকবার হাসান রা. মুআবিয়া রা.-এর কাছে গেলে তিনি তাঁকে অভিবাদন জানান এবং তিন লাখ দিরহাম প্রদান করেন। আলবিদায়া ওয়ান  নিহায়া: ৮/১৪০।

এ ধরনের ঘটনা গালিগালাজের বিষয়টি অকাট্যভাবে মিথ্যা প্রমাণিত করে। তাঁর সন্তানদের সঙ্গে এত সুসম্পর্ক থাকার পর তিনি তাঁদের পিতাকে গালিগালাজ করবেন? এর দ্বারাই এ মাসআলার বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া রাসুল সা. মুশরিকদের মৃতদের গালিগালাজ করতে নিষেধ করেছেন।

 

তাহলে তিনি কীভাবে পূণ্যবান মানুষদের গালিগালজ করবেন? আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা মৃতদের গালিগালাজ করো না। কারণ, তাঁরা তাঁদের পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে।’

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *