জিকরে জলী তথা উচ্চস্বরে জিকির এবং সম্মিলিত জিকির
জিকরে জলী তথা উচ্চস্বরে জিকির নিয়ে আমাদের ঘরণায় কথাবার্তা আগে খুব একটি ছিল না। সবাই শর্ত সাপেক্ষে এটাকে জায়েজ হবেন। হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. এ ব্যাপারে অনেক আগেই ‘নাতিজাতুল ফিকর ফি মাসআলাতিল জাহরি বিয যিকরি” নামে কিতাব লিখে গিয়েছেন। “আল হাওয়ী লিল ফাতাওয়া” তে রিাসালাটি পাওয়া যায়।
বর্তমানে আমাদের ঘরণার কেউ কেউ এ মাসআলাটি নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিতে চাচ্ছেন। আমি দলিলের দিকে যাওয়ার আগে হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. এর বক্তব্য পেশ করতে চাই। তিনি তার পুস্তিকার সূচনা করেছেন এভাবে:
سألت أكرمك الله عما اعتاده السادة الصوفية من عقد حلق الذكر والجهر به في المساجد ورفع الصوت بالتهليل وهل ذلك مكروه أو لا.
الجواب — إنه لا كراهة في شيء من ذلك وقد وردت أحاديث تقتضي استحباب الجهر بالذكر وأحاديث تقتضي استحباب الأسرار به والجمع بينهما أن ذلك يختلف باختلاف الأحوال والأشخاص كما جمع النووي بمثل ذلك بين الأحاديث الواردة باستحباب الجهر بقراءة القرآن والواردة باستحباب الأسرار بها وها أنا أبين ذلك فصلا فصلا.
অর্থাৎ সুয়ুতী রাহি. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, বর্তমানে অনেক সুফীদের অভ্যাস হলো তারা জিকিরের হালকা করেন এবং মসজিদে উচ্চস্বরে জিকির করেন, এটা মাকরুহ নাকি জায়েজ?
জবাবে সুয়ুতী রাহি. বলেন: এগুলোর কোনটিতে কোন সমস্যা নেই। এমন এগুলো হাদীস রয়েছে যেগুলোর আলোকে উচ্চস্বরে জিকির মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। এমনভাবে কিছু হাদীস দ্বারা আস্তে আস্তে জিকির মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। উভয় ধরণের হাদীসের এভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা হবে যে, অবস্থা এবং ব্যক্তির ভিন্নতার কারণে হুকুমের ভিন্নতা হবে। যেমনভাবে ইমাম নববী রাহি. সামঞ্জস্য বিধান করেছেন উচ্চস্বরে কুরআন পড়ার ব্যাপারে। আমি আলাদা পরিচ্ছেদ আকারে এগুলো নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আল হাভী লিল ফাতাওয়া: ২/৭৫।
হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. উচ্চস্বরে জিকির এর পক্ষে কিছু হাদীস দিয়ে দলিল পেশ করেছেন। আমরা ধাবারাবাহিকভাবে প্রত্যেকটি হাদীস নিয়ে আলোচনা করব।
এক নং হাদীস
আবু হুরায়রা রাযি. থেকে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
يقول الله أنا عند ظن عبدي بي وأنا معه إذا ذكرني فان ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي وان ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منه
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার সাথে তার ধারণা অনুযায়ী থাকি। যদি সে মনে মনে আমার জিকির করি, তাহলেও আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। আর যদি সে একটি দলের মধ্যে আমার জিকির করে, তাহলে আমি তাদের শ্রেষ্ঠ একটি দলের কাছে তাদের আলোচনা করি।. বুখারী: ৭৪০৫।
এ হাদীস বর্ণনা করে ইমাম জাযারী রাহি. বলেন:
“فيه دليل على جواز الجهر بالذكر
অর্থাৎ এ হাদীসে উচ্চস্বরে জিকির জায়েজ হওয়ার দলিল রয়েছে। মিফতাহুল হিসনিল হাসীন: ৫৪।
এ হাদীস কীভাবে উচ্চস্বরে জিকিরের পক্ষে দলীল হয়? কারণ আলোচনা করতে গিয়ে হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. লিখেন:
والذكر في الملأ لا يكون إلا عن جهر
অর্থাৎ দলের মাঝে আল্লাহর জিকির করলে সেটা উচ্চস্বরেই হবে। আল হাভী লিল ফাতাওয়া: ২/৭৫।
দুই নং হাদীস
উচ্চস্বরে জিকির এর পক্ষে জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. জাবের রাযি. এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন:
خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيه وسَلَّم فَقَالَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ ، إِنَّ لِلَّهِ سَرَايَا مِنَ الْمَلاَئِكَةِ تَحُلُّ فَتَقِفُ عَلَى مَجَالِسِ الذِّكْرِ فِي الأَرْضِ ، فَارْتَعُوا فِي رِيَاضِ الْجَنَّةِ , قَالُوا : وَأَيْنَ رِيَاضُ الْجَنَّةِ يَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيه وسَلَّم ؟ قَالَ : مَجَالِسُ الذِّكْرِ ، فَاغْدُوا وَرُوحُوا فِي ذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে বললেন, হে লোক সকল! আল্লাহর পক্ষ থেকে ফিরিশতাদের একটি প্রতিনিধি দল রয়েছেন, যারা অনুসন্ধ্যান করে জমিনে জিকিরের মজলিসে অবস্থান করেন। সুতরাং তোমরা রিয়াযুল জান্নাহ তথা জান্নাতের বাগানের দিকে অগ্রসর হও।
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, জান্নাতের বাগান কোথায় হে আল্লাহর রাসূল? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জিকিরের মজলিস হলো জান্নাতের বাগান। সুতরাং সকাল, সন্ধ্যা তোমরা আল্লাহর জিকির করো। আল মুসতাদরাক: ১৮২০, এ হাদীস বর্ণনা করে হাকিম নিশাপুরী রাহি. বলেন:
هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه
অর্থাৎ সনদের দিক থেকে সহিহ হলেও ইমাম বুখারী এবং মুসলিম রাহি. হাদীসটি তাখরিজ করেন নি। ইমাম হাইছামী রাহি. এ হাদীস সম্পর্কে বলেন:
رواه أبو يعلى والبزار والطبراني في الأوسط وفيه عمر بن عبد الله مولى عفرة وقد وثقه غير واحد وضعفه جماعة وبقية رجالهم رجال الصحيح
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম আবু ইয়ালা আল মাওসিলী, ইমাম বাযযার এবং ইমাম তাবারানী রাহি. ‘আল মু’যামুল আওসাত’ এ বর্ণনা করেছেন। সনদে একজন বর্ণনাকারী হলেন উমর বিন আবদুল্লাহ। একদল তাকে ছিক্বাহ বলেছেন, আবার আরেক দল তাকে জয়িফ বলেছেন। এছাড়া অন্যান্য সকল বর্ণনাকারী সহিহ হাদীসের বর্ণনাকারী। মাযমাউয যাওয়াইদ: ১৬৭৬৮।
এ হাদীসটি যেমনভাবে উচ্চস্বরে জিকিরের দলীল, তেমনভাবে সম্মিলিত জিকিরেরও দলিল। কারণ, জিকিরের মজলিসে সবাই জিকির করলে সেটাকে পরিভাষায় ইজতেমায়ী জিকির তথা সম্মিলিত জিকির বলে।
তিন নং হাদীস
আনাস বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
قالَ الله تَعَالى : لاَ يَذْكُرُنِي عَبْدٌ فِي نَفْسِهِ إِلاَّ ذَكَرْتُهُ فِي مَلإٍ مِنْ مَلاَئِكَتِي وَلاَ يَذْكُرُنِي فِي مَلإٍ إِلا ذَكَرْتُهُ في الرَّفِيقِ الأَعْلَى
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার কোন বান্দা একাকী আমার জিকির করলে আমি তার কথা ফিরিশতাদের একটি দলের কাছে আলোচনা করি। আর সে একটি দলের মধ্যে আমার জিকির করলে আমি পরম বন্ধুর কাছে তার আলোচনা করি।
ইমাম মুনযিরী রাহি. এ হাদীস সম্পর্কে বলেন:
رواه الطبراني بإسناد حسن
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম তাবারানী রাহি. হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। আত তারগীব ওয়াত তারহীব: ২২৭৮।
ইমাম হাইছামী রাহি. বলেন:
رواه الطبراني وإسناده حسن
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম তাবারানী রাহি. বর্ণনা করেছেন। হাদীসের সনদ হলো হাসান।
এ হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা একটি দলের মধ্যে আমার জিকির করলে আমি তার জিকির করি। দল নিয়ে জিকির করাকে আমরা সম্মিলিত জিকির বলি। আবার দল নিয়ে জিকির করলে স্বাভাবিকভাবে জোরে জিকির হবে। এজন্য এ হাদীসটি যেমনভাবে উচ্চস্বরে জিকির এর দলীল, তেমনভাবে সম্মিলিত জিকিরেরও দলিল।
চার নং হাদীস
হাফেজ জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. আবু হুরায়রা রাযি. এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস দ্বারাও দলিল পেশ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِنَّ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مَلَائِكَةً فُضُلًا يَتَّبِعُونَ مَجَالِسَ الذِّكْرِ يَجْتَمِعُونَ عِنْدَ الذِّكْرِ فَإِذَا مَرُّوا بِمَجْلِسٍ عَلَا بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ حَتَّى يَبْلُغُوا الْعَرْشَ فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ مِنْ أَيْنَ جِئْتُمْ فَيَقُولُونَ مِنْ عِنْدِ عَبِيدٍ لَكَ يَسْأَلُونَكَ الْجَنَّةَ وَيَتَعَوَّذُونَ بِكَ مِنْ النَّارِ وَيَسْتَغْفِرُونَكَ فَيَقُولُ يَسْأَلُونِي جَنَّتِي هَلْ رَأَوْهَا فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْهَا وَيَتَعَوَّذُونَ مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْهَا فَإِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ فَيَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّ فِيهِمْ عَبْدَكَ الْخَطَّاءَ فُلَانًا مَرَّ بِهِمْ لِحَاجَةٍ لَهُ فَجَلَسَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أُولَئِكَ الْجُلَسَاءُ لَا يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার একদল ফিরিশতা নিযুক্ত রয়েছেন, যারা জিকির এর মজলিস অনুসন্ধ্যান করতে থাকেন, যেখানে লোকজন জিকিরের জন্য একত্রিত হয়েছে, এ ধরণের জিকিরের মজলিসের পাশ দিয়ে গেলে তারা একজন অপরজনের উপরে উঠতে উঠতে একেবারে আল্লাহর আরশে পৌঁছে যান।
আল্লাহ তাআলা তখন জানা সত্ত্বেও তারা জিজ্ঞাসা করেন যে, তোমরা কোন জায়গা থেকে এসেছো? ফিরিশতারা বলেন, আপনার এমন বান্দাদের কাছ থেকে এসেছি, যারা আপনার কাছে জান্নাত চায়, জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চায় এবং আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
আল্লাহ তখন বলেন, তারা জান্নাত চায়, জান্নাত কী তারা দেখেছে জান্নাত দেখলে কী অবস্থা হতো? তারা জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চায়, জাহান্নাম দেখলে কী অবস্থা হতো? আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম।
ফিরিশতারা তখন বলেন, হে আল্লাহ, এখানে আপনার এমন গুনাহগার বান্দা রয়েছে, তারা ভিন্ন প্রয়োজনে এদিকে যাচ্ছিল, এরপর এখানে বসে গেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, এরা এমন মজলিসে বসেছে, যেখানে বসলে কেউ বঞ্চিত হয় না। মুসনাদে আহমদ: ৮৭০৪। হাকিম নিশাপুরী রাহি. এ হাদীস সম্পর্কে বলেন:
هذا حديث صحيح تفرد بإخراجه مسلم بن الحجاج مختصرا من حديث وهيب بن خالد عن سهيل
অর্থাৎ হাদীসটি সহিহ। ওয়াইব বিন খালিদ সুহাইল এর সূত্রে ইমাম মুসলিম রাহি. সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন। আল মুসতাদরাক: ১৮২১।
জোরে জিকির এবং সম্মিলিত জিকির নিয়ে যারা বিতর্ক তৈরী করেন, তারা এ হাদীস একটু ভালোভাবে পড়লেই বুঝতে পারতেন। আল্লাহর ফিরিশতারা এমন মজলিস তালাশ করতে থাকেন, যেখানে মানুষ আল্লাহর জিকির করার জন্য একত্রিত হয়েছে। মজলিসে মানুষ জিকির করার জন্য একত্রিত হলে সেটাকেই তো সম্মিলিত জিকির বলে। আর মজলিসে জিকির করলে স্বাভাবিকভাসে সেটা জোরে হবে।
৫ নং হাদীস
আবু সাঈদ খুদরী রাযি. এবং আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্র لاَ يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ حَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ গ্ধ.
অর্থাৎ কোন সম্প্রদায় যদি বসে আল্লাহর জিকির করে, তখন ফিরিশতারা তাদের ঘিরে রাখেন। রহমত তাদের ঢেকে নেয়। প্রশান্তি তাদের উপর অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তাঁর কাছের ফিরিশতাদের কাছে সে বান্দাদের আলোচনা করেন। মুসলিম: ৭০৩০।
এ হাদীসের উপর একটু নজর করুন। হাদীসে বলা হয়েছে, কোন সম্প্রদায় যদি জিকিরের জন্য বসে। জিকিরের জন্য লোক বসলে সেটাকে সম্মিলিত জিকির বলে। আবার স্বাভাবিকভাবে সম্প্রদায় বসে জিকির করলে সেটা জোরে হবে।
৬ নং হাদীস
মুআবিয়া রাযি. বর্ণনা করেন:
خَرَجَ عَلَى حَلْقَةٍ مِنْ أَصْحَابِهِ فَقَالَ ্র مَا أَجْلَسَكُمْ গ্ধ. قَالُوا جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللَّهَ وَنَحْمَدُهُ عَلَى مَا هَدَانَا لِلإِسْلاَمِ وَمَنَّ بِهِ عَلَيْنَا. قَالَ ্র آللَّهِ مَا أَجْلَسَكُمْ إِلاَّ ذَاكَ গ্ধ. قَالُوا وَاللَّهِ مَا أَجْلَسَنَا إِلاَّ ذَاكَ. قَالَ ্র أَمَا إِنِّى لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ وَلَكِنَّهُ أَتَانِى جِبْرِيلُ فَأَخْبَرَنِى أَنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يُبَاهِى بِكُمُ الْمَلاَئِكَةَ গ্ধ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সাহাবায়ে কেরাম এর একটি মজলিসে তাশরিফ আনলেন এবং তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস তোমাদের এখানে বসিয়ে রেখেছে?
তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা এখানে বসে আল্লাহর জিকির করছি এবং তাঁর প্রশংসা করছি যে, তিনি আমাদের ইসলামের মতো দৌলত দিয়েছেন এবং ইসলাম দিয়ে আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা কী এজন্য বসেছো? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ, এজন্যই বসেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোন খারাপ ধারণা করে আমি তোমাদের কসম দেইনি । এইমাত্র জিবরিল আ. আমাকে সংবাদ দিয়ে গিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা তোমাদের নিয়ে ফিরিশতাদের মাঝে গৌরব করছেন। মুসলিম: ৭০৩৯।
হাদীস ভালোভাবে খেয়াল করুন। কিছু মানুষ একসাথে বসলে আল্লাহর জিকির করাকে পরিভাষায় সম্মিলিত জিকির বলে। আর অনেক মানুষ জিকির করলে স্বাভাবিকভাবে সেটা জোরে হবে।
৭ নং হাদীস
আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
يَقُولُ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ : سَيَعْلَمُ أَهْلُ الْجَمْعِ الْيَوْمَ مَنْ أَهْلِ الْكَرَمِ ، فَقِيلَ : مَنْ أَهْلُ الْكَرَمِ يَا رَسُولَ اللهِ ؟ قَالَ : مَجَالِسُ الذِّكْرِ فِي الْمَسَاجِدِ.
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, পৃথিবীতে কারা বদান্যশীল ছিল, মানুষ আজ তা জানতে পারবে। জিজ্ঞাসা করা হলো এরা কারা হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বলেন, মসজিদে যারা জিকিরের মজলিসে বসে।. মুসনাদে আহমদ: ১১৬৫২। এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম হাইছামী রাহি. বলেন,
رواه أحمد بإسنادين وأحدهما حسن وأبو يعلى كذلك
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম আহমদ দুটি সনদে বর্ণনা করেছেন। দুটি সনদের একটি হলো হাসান। এমনভাবে আবু ইয়ালা আল মাওসিলি রাহি. এর বর্ণনাও হাসান। মাযমাউয যাওয়াইদ: ১৬৭৬৩।
এ হাদীস নিয়ে চিন্তা করলেই সম্মিলিত জিকির এবং জোরে জিকির প্রমাণিত হয়ে যায়। হাদীসে বলা হয়েছে যারা মসজিদে জিকিরের মজলিসে বসে। জিকিরের মজলিসে বসে মানুষ তো জিকিরই করে। আর অনেক মানুষ জিকির করাকে সম্মিলিত জিকির বলে। আর অনেক মানুষ জিকির করলে জোরেই করবে।
৮ নং হাদীস
আনাস বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَا مِنْ قَوْمٍ اجْتَمَعُوا يَذْكُرُونَ اللَّهَ لاَ يُرِيدُونَ بِذَلِكَ إِلاَّ وَجْهَهُ ، إِلاَّ نَادَاهُمْ مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ أَنْ قُومُوا مَغْفُورًا لَكُمْ قَدْ بُدِّلَتْ سَيِّئَاتُكُمْ حَسَنَاتٍ
অর্থাৎ কোন সম্প্রদায় যদি একত্রিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জিকির করে, তখন আসমান থেকে একজন ফিরিশতা ঘোষণা করেন, তোমরা এমন অবস্থায় দাঁড়াও যে তোমাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তোমাদের গুনাহকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুসনাদে আহমদ: ১২৪৫৩।
৯ নং হাদীস
আবদুল্লাহ বিন আমর রাযি. বলেন:
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا غَنِيمَةُ مَجَالِسِ الذِّكْرِ قَالَ غَنِيمَةُ مَجَالِسِ الذِّكْرِ الْجَنَّةُ الْجَنَّةُ
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল,জিকিরের মজলিসের অর্জিত সম্পদ কী? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জিকিরের মজলিসের একমাত্র অর্জিত সম্পদ হলো, জান্নাত। মুসনাদে আহমদ: ৬৬৫১, ইমাম হাইছামী রাহি. এ হাদীস সম্পর্কে বলেন:
رواه أحمد والطبراني وإسناد أحمد حسن
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম আহমদ এবং তাবারানী রাহি. বর্ণনা করেছেন। মুসনাদে আহমদ এর সনদ হলো হাসান। মাযমাউয যাওয়াইদ:১৬৭৭৩।
এ হাদীসে জিকিরের মজলিসে বসলে কী ফায়দা হবে? সেটা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। জিকিরের মজলিসে জিকির করাকে সম্মিলিত জিকির বলা হয়। আবার একসাথে অনেকে জিকির করলে স্বাভাবিকভাবে জোরে জিকির করা হয়।
১০ নং হাদীস
আমর বিন আনবাসা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
عَنْ يَمِينِ الرَّحْمنِ تَعَالَى وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِينٌ رِجَالٌ لَيْسُوا بِأَنْبِيَاءَ وَلاَ شُهَدَاءَ يَغْش ىبَيَاضُ وَجُوهِهِمْ نَظَرَ النَّاظِرِينَ يَغْبِطُهُمُ النَّبِيُّونَ وَالشُّهَدَاءُ بِمَقْعَدِهِمْ وَقُرْبِهِمْ مِنَ الله تَعَالَى هُمْ جُمَاعٌ مِنْ نَوَازِعِ الْقَبَائِلِ يَجْتَمِعُونَ عَلَى ذِكْرِ الله فَيَنْتَقُونَ أَطَايِبَ الْكَلاَمِ كَمَا يَنْتَقِي آكِلُ التَّمْرِ أَطَايِبَهُ
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার ডানে এমন কিছু মানুষ থাকবে, যারা নবী কিংবা শহীদ নয়। তাদের চেহারার শুভ্রতা দর্শকদের দৃষ্টি ডেকে রাখবে। তারা আল্লাহর এতটা নিকটবর্তী হবে যে তাদের অবস্থান দেখে নবীরাও ঈর্ষা করবেন। তারা হলো, যারা বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে জিকির করার জন্য একত্রিত হয়েছে। কিতাবুদ দোয়া: তাবারানী, ৫৩১। এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম হাইছামী রাহি. বলেন:
رواه الطبراني ورجاله موثقون
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম তাবারানী রাহি. বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী সকলেই বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য। মাযমাউয যাওয়াইদ: ১৬৭৭১।
বিভিন্ন গোত্র থেকে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে জিকির করলে সেটাকেই সম্মিলিত জিকির বলে। আবার সবাই মিলে করলে সেটা জোরেই হবে।
হাফিজ জালাল উদ্দিন সুয়ুতী রাহি. এ ব্যাপারে মোট ২৫ টি হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা ১০ টি হাদীস উল্লেখ করলাম। আবদুল হাই লাখনবী রাহি. তো এ ব্যাপারে ৪০ এর অধিক হাদীস উল্লেখ করেছেন। সুয়ুতী রাহি. ২৫ টি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন:
إذا تأملت ما أوردنا من الأحاديث عرفت من مجموعها أنه لا كراهة البتة في الجهر بالذكر بل فيه ما يدل على استحبابه إما صريحا أو التزاما كما أشرنا إليه،
অর্থাৎ আমি যে সকল বর্ণনা পেশ করেছি, এগুলো থেকে সমষ্টিগতভাবে আপনি জানতে পেরেছেন যে, উচ্চস্বরে জিকির করতে কোন সমস্যা নেই। কোন হাদীস তো স্পষ্টভাবে আবার কোন হাদীসটি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বুঝিয়েছে যে, উচ্চস্বরে জিকির করা মুস্তাহাব। আল হাবী লিল ফাতওয়া: ২/৭৫।
এরপর সুয়ুতী রাহি. যারা এটাকে হারাম বা বিদআত মনে করেন, তারা যে দলিলগুলো পেশ করেন, সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। আগ্রহী পাঠকরা সেখান থেকে অধ্যয়ন করতে পারেন।
মূলত ব্যক্তি এবং অবস্থার ভিন্নতায় হুকুমের ভিন্নতা আসবে। হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত কিতাব “আল ফাতওয়া আল খাইরিয়্যাহ” তে বলা হয়েছে:
إِنَّ ذَلِكَ يَخْتَلِفُ بِاخْتِلاَفِ الأْشْخَاصِ وَالأْحْوَال فَالإْسْرَارُ أَفْضَل حَيْثُ خِيفَ الرِّيَاءُ أَوْ تَأَذِّي الْمُصَلِّينَ أَوِ النِّيَامِ ، وَالْجَهْرُ أَفْضَل حَيْثُ خَلاَ مِمَّا ذُكِرَ
অর্থাৎ জিকিরের বিধানটি ব্যক্তি এবং অবস্থার পরিবর্তনের কারণে হুকুমের ভিন্নতা আসবে। যদি লৌকিকতা, নামাজী কিংবা ব্যক্তির কষ্টের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আস্তে জিকির করা উত্তম। এ সমস্যাগুলো না থাকলে জোরে জিকির করা উত্তম। রাদ্দুল মুহতার: ৫/২৫৫।
ইমাম আলুসী রাহি.ও এ ব্যাপারটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন:
الاخفاء أفضل عند خوف الرياء والاظهار أفضل عند عدم خوفه وأولى منه القول بتقديم الاخفاء على الجهر فيما إذا خيف الرياء أو كان في الجهر تشويش على نحو مصل أو نائم أو قاريء أو مشتغل بعلم شرعي وبتقديم الجهر على الاخفاء فيما إذا خلا عن ذلك وكان فيه قصد تعليم جاهل أو نحو ازالة وحشة عن مستوحش أو طرد نحو نعاس أو كسل عن الداعي نفسه أو ادخال سرور على قلب مؤمن أو تنفير مبتدع عن بدعة أو نحو ذلك
অর্থাৎ যদি লৌকিকতার ভয় থাকে, তাহলে আস্তে জিকির করা উত্তম। ভয় না থাকলে জোরে জিকির করা উত্তম। আস্তে জিকিরকে তখন প্রাধান্য দেওয়া হবে, যখন জোরে জিকির করলে রিয়া তথা লোক দেখানোর সম্ভাবনা থাকে, অথবা জোরে জিকির এর কারণে কোন নামাজী ব্যক্তির, ঘুমন্ত ব্যক্তির, কুরআন তিলাওয়াতকারীর, দ্বীনী ইলম অন্বেষণকারীর যদি ব্যাঘাত ঘটে। যদি এ সমস্যা না থাকে, আর উদ্দেশ্য হয় কোন মূর্খকে শিক্ষা দেওয়া, অথবা কারও অমনযোগীতা, অলসতা দূর করা, অথবা কোন মুসলমানদের অন্তরে আনন্দ সৃষ্টি করা কিংবা বিদআতের প্রতি অনিহা তৈরী করা, তখন জোরে জিকির করা উত্তম। তাফসিরে রুহুল মাআনী: ১৪/২৯৯।
এখানে চাইলে আরও অনেক রেফারেন্স যোগ করা যেতে পারে। এ আলোচনার পর আশা করি ইনসাফকারী ব্যক্তিরা বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। আল্লাহ সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।