সাহাবা এবং তাবেয়িন এবং ইমামদের দৃষ্টিতে মুআবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাযি.

সাহাবা এবং তাবেয়িনদের দৃষ্টিতে মুআবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাযি.

১. ‍উমর বিন খাত্তাব রা.

উমর রা. বলেন, ‘তোমরা রোম, পারস্য এবং তাঁদের বিচক্ষণতার কথা উল্লেখ করো। অথচ তোমাদের মাঝে রয়েছেন মুআবিয়া রা.।’ আল মুযামুল কাবীর: ৫/৩৩০।

আবু মুহাম্মাদ উমায়ি বলেন,

উমর রা. সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হলে মুআবিয়া রা. একটি বিশাল দল নিয়ে তাঁকে স্বাগতম জানানোর জন্য আসলেন। এ অবস্থা দেখে উমর রা. বললেন,

‘হে মুআবিয়া! আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে যে, তুমি সকালে তোমার বাসস্থানে অবস্থান করো আর লোকেরা প্রয়োজন নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।’

তিনি বললেন,’হে আমিরুল মুমিনিন, শত্রুরা আমাদের একেবারে নিকটবর্তী। তাঁদের গোয়েন্দারা আমাদের চারপাশে গিজগিজ করে। ইসলামের মাহত্ম বুঝানোর জন্য আমি ইচ্ছে করেছি আমিরুল মুমিনিনের শান শওকাত প্রকাশ করতে। এজন্য আমি সংবর্ধনার আয়োজন করেছি।’

উমর রা. বললেন, ‘এটা বুদ্ধিমান লোকের পরিকল্পনা।’ মুআবিয়া রা. বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাকে নির্দেশ দিন। আপনার নির্দেশ আমি নতশিরে মেনে নিব।’

উমর রা. বলেন, ‘আমি পূর্বের তোমার যত কাজের ওপর আপত্তি করেছি, তুমি আমাকে লা জবাব করে দিয়েছ। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে করার কথা বলব না, আবার নিষেধও করব না।’ আনছাবুল আশরাফ:  ৪/১৪৭।

 

২.  আবদুল্লাহ বিন উমর রা.

আবদুল্লাহ বিন উমর রা. বলেন, ‘আমি মুআবিয়া রা.-এর মতো নেতা কাউকে দেখেনি।’

বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম উমর রা.? তিনি বললেন, ‘উমর রা. তাঁর চেয়ে উত্তম। কিন্তু মুআবিয়া রা. তাঁর চেয়ে বড় নেতা ।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৩৮।

 

অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল সা.-এর পরে মুআবিয়া রা.-এর মতো বিচক্ষণ কাউকে দেখিনি।’

জিজ্ঞাসা করা হলো, আবু বকর রা.? তিনি বললেন, ‘আবু বকর, উমর এবং উসমান রা. তাঁর থেকে উত্তম। কিন্তু মুআবিয়া রা. হলেন বিচক্ষণ।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৩৮।

 

৩. আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা.

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘বাদশাহদের মাঝে মুআবিয়া রা.-এর মতো উত্তম চরিত্রের অধিকারী আর কাউকে আমি দেখিনি।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৩৯।

বুখারির বর্ণনায় রয়েছে, ইবনে আব্বাস রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হলম, মুআবিয়া রা.-এর ব্যাপারে আপনার কী মত? তিনি তো বিতরের নামাজ এক রাকআত পড়েন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘মুআবিয়া রা. হলেন ফকিহ।’ বুখারি: ৩৭৬৫।

হাসান রা.-এর ইন্তেকালের পর শোক প্রকাশের জন্য মুআবিয়া রা. ইবনে আব্বাস রা.-কে বলেন,

‘আল্লাহ সর্বদা আপনাদের সহযোগীতা করবেন। হাসান রা.-এর বিয়োগে পেরেশান হবেন না।’ তখন ইবনে আব্বাস রা. বললেন,

‘আল্লাহ তাআলা যতদিন আমিরুল মুমিনিন মুআবিয়া রা.-কে জীবিত রেখেছেন, ততদিন আমরা পেরেশান হব না এবং সাহায্য বঞ্চিত হব না।’ মুখতাসারু তারিখিদ দিমাশক: ২৫/৬৭।

 

৪. সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস রা.

সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস রা. বলেন, ‘উসমান রা.-এর পরে মুআবিয়া রা.-এর মতো মানুষের হক আদায়কারি কাউকে আমি দেখিনি।’ সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/১৫০।

৫. আবু হুরায়রা রা.

আবু হুরায়রা রা. মদিনার গলিতে হাটছিলেন আর বলছিলেন, ‘সাবধান! তোমরা মুআবিয়া রা.-এর নেতৃত্বকে গ্রহণ করো।শিশুর নেতৃত্ব থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।’ মুখতাসারু তারিখিদ দিমাশক: ২৫/৭৯।

৬. আবু দারদা রা.

আবু দারদা রা. বলেন, ‘মুআবিয়া রা.-এর নামাজের মতো রাসুল সা.-এর নামাজের সঙ্গে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কারও নামাজ দেখিনি।’ মাজমাউজ জাওয়ায়িদ: ৯/৩৫৭।

এ হাদিস উল্লেখ করে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন,

‘সাহাবার এ সাক্ষ্য দ্বারা মুআবিয়া রা.-এর ইলম এবং ফিকহ প্রমাণিত হয়। ইবনে আব্বাস তাঁর ফিকহের এবং আবু দারদা তাঁর উত্তম নামাজের সাক্ষী দিয়েছেন। তাঁরা উভয়ের তুলনা তাঁরা নিজেই। এ ধরনের বর্ণনা আরও অনেক রয়েছে।’ মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/২৩৫।

৭. সাইদ বিন মুসায়্যিব রাহি.

জুহরি বলেন, আমি সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ.কে রাসুল সা.-এর সাহাবি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমাকে বললেন,

‘হে জুহরি! শুনে রাখ, যে ব্যক্তি আবু বকর, উমর, উসমান এবং আলি রা.-এর ভালোবাসা হৃদয়ে রেখে ইনতেকাল করবে, আশারায়ে মুবাশশারা জান্নাতি হওয়ার সাক্ষী দেবে, মুআবিয়া রা.-এর জন্য দুআ করবে, বাস্তবেই আল্লাহ তাআলা তাঁর হিসেব নেবেন না।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৪৯।

. আবদুল্লাহ বিন মুবারক রাহি.

আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ.-কে এক ব্যক্তি মুআবিয়া রা. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তিনি বললেন,

‘আমি ওই ব্যক্তি সম্পর্কে কী বলব যে রাসুল সা.কে নামাজে বলতে শুনেছে ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ।’ এরপর জবাবে ওই ব্যক্তি বলেছে, ‘রাব্বানা লাকাল হামদ। তাঁকে বলা হলো, মুআবিয়া রা. শ্রেষ্ঠ নাকি উমর ইবনে আবদুল আজিজ? তিনি বললেন,

‘রাসুল সা.-এর সঙ্গে যে ধুলো মুআবিয়া রা.-এর নাকে প্রবেশ করেছে, সে ধুলো উমর ইবনে আবদুল আজিজ থেকে শ্রেষ্ঠ।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৫১।

৯. উমর বিন আবদুল আজিজ রাহি.

ইবরাহিম বিন মাইসারা রাহ. বলেন, ‘আমি উমর ইবনে আবদুল আজিজ র.-কে কাউকে প্রহার করতে দেখিনি। তবে কেউ মুআবিয়া রা.-কে গালি দিলে তিনি তাঁকে প্রহার করতেন।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৫১।

১০. মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আম্মার রাহি.

মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ আল মাওসিলি বলেন, মুয়াফি বিন ইমরান রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, মুআবিয়া রা. শ্রেষ্ঠ নাকি উমর ইবনে আবদুল আজিজ? তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন,

‘তুমি রাসুলের সাহাবিকে তাবেয়ির সঙ্গে তুলনা করছ? মুআবিয়া রা. রাসুলের সাহাবি, বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় এবং আল্লাহর ওহির লেখক এবং নিরাপত্তা কর্মী।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৫০।

১১. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল

ইমাম আহমদ রাহ.-কে বলা হলো, তাঁদের ব্যাপারে আপনার কি মতো যারা বলে মুআবিয়া রা. ওহির লেখক ছিলেন না? কারণ, তিনি জোরপূর্বক তরবারি উত্তোলন করেছেন?

তিনি বললেন, ‘তারা খুব বাজে এবং খারাপ মানুষ। তাঁদের সঙ্গে তোমরা বসবে না। আমি লোকদের কাছে তাঁদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরব।’ আস সুন্নাহ:২/৪৩৪।

১২. রাবে বিন নাফে

রাবি বিন নাফে আলহালাবি রাহ. বলেন, ‘মুআবিয়া রা, রাসুল সা.-এর সাহাবি হওয়ার কারণে আচ্ছাদিত। সুতরাং কেউ যদি পর্দা সরাতে যায়, সে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪৫০।

১৩. ইবনে আবুল ইজ রাহি.

ইবনে আবুল ইজ আলহানাফি বলেন, ‘মুআবিয়া রা. হলেন প্রথম বাদশাহ। তিনি অন্যান্য বাদশাহ থেকে উত্তম।’ শারহুল আকিদাতিত তাহাবিয়্যাহ: ৭২২।

১৪. ইবনুল আরাবি মালেকি রাহি.

কাজি ইবনুল আরাবি রাহ. মুআবিয়া রা.-এর গুণাবলি সম্পর্কে বলেন,

‘ তাঁর উল্লেখযোগ্য গুণাাবলি ছিল মুসলমানদের সীমান্ত সংরক্ষণ, ছিদ্র বন্ধ করে দেওয়া, সেনাবাহিনীকে পুনরায় বিন্যাস করা, শত্রুর ওপর বিজয়ী হওয়া এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। আল আওয়াসিম ওয়াল কাওয়াসিম:  ২১০,২১১।’

অন্য জায়গায় তিনি বলেন,

‘উমর রা. তাঁকে পুরো সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করেন। উসমান রা.ও তাঁকে বহাল রাখেন। বরং তাঁকে নিযুক্ত করেছেন আবু বকর রা.। কারণ, তিনি তাঁর ভাই ইয়াজিদকে প্রথমে নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি ইয়াজিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। এরপর উমর রা. এবং উসমান রা. তাঁকে আপন পদে বহাল রেখেছেন। এরপর হাসান রা.-এর সঙ্গে সন্ধির মাধ্যমে তিনি মুসলিম জাহানের খলিফা নিযুক্ত হন।’ আল আওয়াইসিম ওয়াল কাওয়াসিম: ৮২।

১৫. ইবনে তাইমিয়া রাহি.

ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন,

‘আলিমরা এ বিষয়ে একমত যে, মুআবিয়া রা. হলেন উম্মতের শ্রেষ্ঠ বাদশাহ। তাঁর পূর্বের চারজন ছিলেন নবুওয়ত অনসৃত খলিফা। তিনি ছিলেন প্রথম বাদশাহ। তাঁর রাজত্ব ছিল রহমতের। মুআবিয়া রা.-এর থেকে উত্তম যুগ আর কোনো বাদশাহের যুগ ছিল না।’ মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/২৩২।

ইবনে তাইমিয়া রাহি. উল্লেখ করেন, আমাশ রাহি. এর সামনে উমর বিন আবদুল আজিজ রাহি. এর কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘তোমরা মুআবিয়া রা.-এর শাসনকাল পেলে তোমাদের অবস্থা কী হতো?’

তারা বলল, তাঁর বদান্যতার ব্যাপারে নাকি? তিনি বললেন, ‘না। তাঁর ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে বলছি।’

১৬. ইমামা জাহাবি রাহি.

ইমাম জাহাবি রাহ. বলেন,

‘তিনি ছিলেন আমিরুল মুমিনিন। ইসলামের বাদশাহ। তিনি আরও বলেন, ‘মুআবিয়া রা. ছিলেন ইসলামের শ্রেষ্ঠ বাদশাহ। যাদের ন্যায়পরায়ণতা অত্যাচারের ওপর বিজয়ী হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন। তোমার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তাঁকে একটি এলাকার গভর্নর বানিয়েছেন উমর রা.। তারপর উসমান রা.ও তাঁকে বহাল রেখেছেন। তিনি তাঁর বিচক্ষণতা এবং প্রজ্ঞা দ্বারা লোকদের সন্তুষ্ট করেছিলেন।’ সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/১৩২।

১৭. ইবনে কাসির রাহি.

ইবনে কাসির রাহ. বলেন,

‘৪১ হিজরিতে তাঁর হাতে বায়আতের ব্যাপারে সকলেই একমত হয়। সে বছর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন। তাঁর আমলে শত্রুদের সঙ্গে জিহাদ অব্যাহত ছিল। আল্লাহর কালেমা সমুন্নত ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে গনিমতের সম্পদ আসার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। মুসলমানরা সকলে আরামে, ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ছিল।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪০০।

তিনি আরও বলেন,

‘মুআবিয়া রা. ছিলেন দানশীল, গম্ভীর, নেতা, সম্মানি, ন্যায়পরায়ণ এবং বাহাদুর।’ আরও লিখেন, ‘তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। উত্তম ক্ষমাকারী এবং অধিক লজ্জাশীল।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১১/৪১৯।

১৯. ইবনে খালদুন রাহি.

ইবনে খালদুন রাহ. বলেন,

‘খুলাফাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে মুআবিয়া রা.-এর শাসন যুক্ত করা উচিত। শ্রেষ্ঠত্ব এবং ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে তাঁদের পরেই তাঁর অবস্থান। সঠিক কথা হলো, মুআবিয়া রা.ও খুলাফায়ে রাশেদিন এর অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু ইতিহাসবিদরা দুটি কারণে তাঁকে পরবর্তিদের মাঝে উল্লেখ করেন।

প্রথমত, তাঁর যুগে খেলাফতে গোত্রপ্রীতি প্রবেশ করেছিল। এর আগে এটা ইচ্ছাধীন এবং সম্মিলিত ছিল। সুতরাং তাঁরা উভয় অবস্থার মাঝে পার্থক্য করেন। মুআবিয়া রা. হলেন প্রথম বাদশাহ। মুআবিয়া রা.-কে তাঁর পরবর্তী কারও সঙ্গে তুলনা করতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। তিনি খুলাফায়ে রাশেদিনের অন্তর্ভূক্ত। ধর্ম এবং শ্রেষ্ঠত্বে তাঁর পরবর্তী সকলের থেকে তিনি এগিয়ে। তারপরের বনি আব্বাসের খলিফাদের থেকেও। এটা বলা হবে না যে, বাদশাহি মর্যাদার দিক থেকে খেলাফতের থেকে কম। সুতরাং বাদশাহ খলিফা হতে পারবেন না। আপনাদের মনে গেঁেথে আছে যে, বাশাহ খেলাফতের বিরোধিতা করবেন, অর্থাৎ জোরজবস্তি করবেন। যেমনভাবে মুআবিয়া রা. তাঁদের শৌর্যবীর্য প্রকাশ করতে চাইলে উমর রা. অপছন্দ করেন। বাকি যে রাজত্ব শৌর্যবীর্যে সঙ্গে চলবে, সেটা নবুওয়ত এবং খেলাফতের বিরোধী নয়। সুলাইমান আ. এবং তাঁর পিতা দাউদ আ. নবি এবং বাদশাহ ছিলেন। তাঁরা তাঁদের ধর্ম এবং আল্লাহর আনুগত্যের ওপর অটল ছিলেন। মুআবিয়া রা. রাজত্ব চাননি। দুনিয়ার অধিক সম্পদের জন্য তিনি বাড়াবাড়ি করেননি। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সম্প্রদায়কে ডেকেছেন। কেননা, তিনি তখন পুরো সাম্রাাজ্যের দায়িত্বশীল। তিনি ছিলেন তাঁদের খলিফা। এ জন্য বাদশাহ হিসেবে তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে ডেকেছেন। এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলে, যার কাজ শরিয়ার মূলনীতি অনুযায়ী হবে, সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের খলিফা। মূলনীতি থেকে বের হয়ে গেলে সে দুনিয়ার বাদশাহ। যদিও রোপক অর্থে তাঁকে খলিফা বলা হয়।

দ্বিতীয় যে বিষয় হলো, যে কারণে মুআবিয়া রা.-কে খুলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে গণ্য না করে প্রথম বাদশাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁকে সে সকল উত্তম বাদশাদের মাঝে গণ্য করা হয়, যার ন্যায়পরায়ণা অত্যাচারের ওপর বিজয়ী হয়েছে। যদিও তাঁরা মানবিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন না। আল্লাহ তাআলা তাঁদের ক্ষমা করে দিন।’ তারিখে ইবনে খালদুন: ৫২৮-৫১৯।

 

ইবনে খালদুনের কথায় বাড়াবাড়ি রয়েছে। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি মুআবিয়া রা. সম্পর্কে সাহাবিদের প্রসংশা এবং তাঁর শাসন সর্বোত্তম হওয়ার ব্যাপারে। যার শাসনামলে ন্যায়বিচার বিজয়ী ছিল। তবে তিনি ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। এ জন্য আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন। তিনি নিজেই সেটা বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা আমল কবুল করেন, পাপকে ক্ষমা করে দেন এবং ভালো কাজের প্রতিদান দান করেন। কিছু আহলে কিতাবের বাধার কারণে মুআবিয়া রা. এবং বনু উমাইয়্যার শাসনকে ধারণা করা হয় ডে, এটা ছিল মদিনার রাজত্ব। কেউ কেউ বলে, আরবের রাজত্ব। ইসলামি রাজত্ব ছিল না; বরং কেউ কেউ এটাও বলেন, এটা ছিল ব্যক্তি শাসন। ইসলামের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই।

এটা প্রকাশ্য মিথ্যাচার এবং অপবাদ। ইতিহাসের আলোকে এগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। উমাইয়্যা শাসনামল শুরু হয়েছে ৪০ হিজরিতে। ১৩২ হিজরি পর্যন্ত ছিল। এ সময় রাসুল সা.-এর ভাষায় ‘খাইরুল কুরূন’ এর অন্তর্ভূক্ত। বিষয়টি মুতাওয়াতির সূত্রে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে মাসউদ রা.-এর বর্ণনায় রয়েছে ‘সর্বোত্তম যুগ হলো আমার যুগ। এরপর সর্বোত্তম যুগ হলো, আমার পরবর্তি যুগ। এরপর সর্বোত্তম যুগ হলো, তাঁদের পরবর্তী যুগ।’ বুখারি: ১৬৪৫।

 

ইমরান বিন হুসাইন রা.-এর বর্ণনায় রয়েছে, ‘সর্বোত্তম হলো, আমার যুগ। তারপর আমার পরবর্তীূ যুগ। তারপর তাঁদের পরবর্তী যুগ। ইমরান বিন হুসাইন রা. বলেন, আমার মনে নেই রাসুল সা. তাঁর যুগের পর দুই যুগের কথা নাকি তিন যুগের কথা উল্লেখ করেছেন।’ বুখারি: ১৬৪৬।

আবু সাইদ খুদরি রা, বর্ণনা করেন, রাসুল সা. বলেন,

‘এমন যুগ আসবে যখন একদল যুদ্ধ করবে। তাঁরা বলবে, তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে রাসুল সা.-এর সংশ্রব পেয়েছে? বলা হবে, হ্যাঁ। তাঁরা বিজয়ী হবে। এরপর এমন যুগ আসবে তাঁরা বলবে, তোমাদের মধ্যে কি কেউ এমন আছে, যে রাসুলের সাহাবার সংশ্রব পেয়েছে? তাঁরা বলবে, হ্যাঁ। তাঁরা বিজয়ী হবে।’ বুখারি: ১৬৪৭।

হাদিসে ‘আমার যুগ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আমার সম সাময়িকদের যুগ। তাঁরা হলেন সাহাবি। এরপর তাবেয়িনদের যুগ। এরপর তাবয়ে তাবেয়িনদের যুগ। যুগ দ্বারা কেউ কেউ জামানা তথা কাল উদ্দেশ্য নিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ‘কারন’ তথা যুগ হয় ৪০ বছরে। কেউ বলেছেন ৮০ বছরে। কেউ বলেছেন ১০০ বছরে। ব্যবহারে এটাই প্রসিদ্ধ। আমরা প্রসিদ্ধ মতটি ধরে নিলাম। তাহলে শ্রেষ্ঠ যুগ হলো, ৩০০ বছর। এটা ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতপূর্ণ নয়; বরং গ্রহণযোগ্য কথা হলো, হাদিসে তিন যুগ দ্বারা সাহাবা, তাবেয়ি এবং তাবয়ে তাবেয়িনের যুগ। তারিখু আলমুফতারা আলাইহি: ৬৩।

এ ছাড়া সহিহ হাদিস দ্বারা উমাইয়্যা শাসনামলের মর্যাদা প্রমাণিত হয়। ইমাম বুখারি ‘সহিহব বুখারি’ তে বর্ণনা করেন, উম্মে হারাম বলেন, আমি রাসুল সা.কে বলতে শুনেছি, ‘আমার উম্মতের যে দল প্রথমে সমুদ্রে যুদ্ধ করবে, তাঁদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব।’

উম্মে হারাম বললেন, আমি কঅ তাঁদের অন্তর্ভূক্ত হব?

রাসুল সা. বললেন, ‘তুমি তাঁদের দলে শামিল হবে।’ এরপর তিনি আরও বলেন, ‘আমার উম্মতের যে দল প্রথমে কায়সারে যুদ্ধ করবে, তাঁরা ক্ষমাপ্রাপ্ত।’

আমি বললাম, আমি কী সে দলের অন্তর্ভূক্ত হব?

তিনি বললেন, ‘না।’ বুখারি: ২৯২৪।

কায়সার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, কনস্টান্টিপোল। বায়েজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। হাদিসের ব্যাখ্যাকারীগণ বলেন,

‘এ হাদিস দ্বারা মুআবিয়া রা.-এর মর্যাদা প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, তিনি প্রথম সমুদ্রে অভিযান পরিচালনা করেছেন। সেটা উসমান রা.-এর খেলাফতকালে। সমুদ্রের অভিযানের ডাকে প্রথমে তিনি সাড়া দিয়েছেন। এরপর মুআবিয়া রা. খেলাফতকালে নৌ অভিযানে ব্যাপকতা এসেছে। তারিখুনা  আল মুফতারা আলাইহি: ৬৩।

সে যুদ্ধে আবু আইয়ুব রা. ইনতেকাল করেছেন। কনস্টান্টিনোপলের দেয়ালের নিকটবর্তী করে তাঁকে দাফন করার ওসিয়ত তিনি করেন। আমরা বিশ্বাস করি এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলেই ক্ষমাপ্রাপ্ত। সে যুদ্ধ ছিল উমাইয়্যা যুগে। সে যুদ্ধ ছিল ৫২ হিজরিতে। মুআবিয়া রা.-এর শাসনামলে। খলিফা হওয়ার পর যে মুআবিয়া রা.-এর চরিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করবে, তাহলে সে দেখতে পারবে যে, তিনি ইসলামের নিদর্শন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এ ছাড়া রাসুল সা.-এর সুন্নতের অনুসরণের পাবন্দি ছিলেন।

মূল: ড. আলী সাল্লাবী

অনুবাদ রেজাউল কারীম আবরার

 

 

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *