হুজর বিন আদি রা.-এর হত্যা এবং মুআবিয়া রাযি. এর অবস্থান
হুজর বিন আদি রা.-এর হত্যার বিষয়টি অনেক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন। ইবনে সাদ, খলিফা বিন খাইয়্যাত খুব সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন। বালাযুরি, ইয়াকুবি, মাসউদি, আবুল ফারজ আসফাহানি, ইবনুল জাওযি, ইবনুল আছির, জাহাবি এবং ইবনে কাসির রাহ. বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তাবারি হুজর বিন আদি এর হত্যার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ শিয়া বর্ণনাকারি আবু মুখান্নাফের বর্ণনার ওপর ভরসা করেছেন। সে বিশ্বস্ত নয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআতের উলামায়ে কেরামের মতে তাঁর বর্ণনার ওপর ভরসা করা যাবে না। তাবারি তাঁর থেকে ১৬টি বর্ণনা করেছেন। হুজর বিন আদি এর হত্যাকান্ডের ঘটনা বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র এককভাবে শিয়াদের বর্ণনা করো হয়নি। জরাহ, তাদিল শাস্ত্রবিদ উলামায়ে কেরামের মতে আবু মুখান্নাফের বর্ণনা পরিত্যাজ্য। তাঁর বর্ণনা মতে মুআবিয়া রা. মুগিরা রা.-কে ইশারা করেছিলেন আলি রা.-কে গালিগালাজ করার এবং নিন্দা করার। এ জন্য মুগিরা কুফার গভর্নর থাকার সময় দীর্ঘ সময় আলি রা.-কে গালিগালাজ করেছেন।
আবু মুখান্নাফের বর্ণনা মতে তাঁর বক্তৃতা শুনে হুজর বিন আদি রাগ করেন। খুতবার সময় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি উসমানের ওপর রহম করুন এবং তাঁকে ক্ষমা করুন। তাঁকে উত্তম বদলা প্রদান করুন। কারণ, তিনি আপনার কিতাবের অনুসরণ করেছেন এবং আপনার নবির সুন্নাতের অনুসরণ করেছেন। তিনি আমাদের কথা একত্রিত করেছেন। রক্তের হেফাজত করেছেন। তিনি মাজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছেন। আপনি তাঁর সাহায্যকারী, অভিভাবক। যারা তাঁকে ভালোবাসে এবং রক্তের বদলা চায় তাঁদের ওপর অনুগ্রহ করুন। এরপর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বদদুআ করলেন।’
খুতবা থেকে আমরা বুঝি যে, তিনি আলি রা.-এর নিন্দায় একটি শব্দও ব্যবহার করেননি। উসমান রা.-এর হত্যাকারীদের অভিশাপের বিষয়টি আলি রা.-কে নিন্দা করেছেন বলে ধরে নিয়েছেন। আছারুত তাশয়ি’ ফির রেওয়ায়াত: ৩৬৮।
উসমান রা. রক্ত থেকে যে আলি রা. পবিত্র, এ বিষয়ে উসমান রা.-কে নিয়ে লিখিত আমার বইয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে বুঝতে হবে আলি রা.-এর ব্যাপারে হুজর বিন আদি রা. অবস্থান দুটি পর্যায়ে ছিল।
১. প্রথম পর্যায়, মৌখিক বিরোধিতা (৪১-৫০ হিজরি)
হুজর বিন আদি আল কিনদি রাসুল সা.-এর সংশ্রবপ্রাপ্ত সাহাবি। তাঁর ভাই হানি বিন আদি এর সঙ্গে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে তিনি রাসুল সা.-এর কাছে আসেন। রাসুল সা. থেকে তিনি কোনো হাদিস তিনি বর্ণনা করেননি। আম্মার রা. এবং আলি রা. থেকে হাদিস শুনেছেন। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৬২।
তিনি ছিলেন ভদ্র এবং আমিরের আনুগত্যশীল। ছিলেন সৎ কাজের আদেশকারী এবং খারাপ কাজের প্রতি বাধা প্রদানকারী। আলি রা.-এর বাহিনীর সদস্য হিসেবে সিফফিনে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন বেশি ইবাদতকারী। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৬৩।
তিনি ছিলেন হাসান রা. এবং মুআবিয়া রা.-এর মধ্যকার সন্ধির বিরোধী লোক। প্রথম পর্যাযে এ বিরোধিতা শুধুমাত্র মৌখিক বিরোধিতার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। এ কারণে বালাযুরি বলেন, হাসান বিন আলি রা.-এর মুআবিয়া রা.-এর সঙ্গে কৃত সন্ধির তিনি বিরোধী ছিলেন না। তিনি নিজেকে অপদস্থ মনে করে বলেন,
‘তোমার সঙ্গে ৪০ হাজার অস্ত্র সজ্জিত যুবক থাকতে তুমি মুআবিয়ার সাথে যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছ? এরপর তিনি মুআবিয়া রা.-এর ওপর আপত্তি করে তাঁকে অত্যাচারী সাব্য্স্থ করেন। তিনি সর্বদা এ কাজ করছিলেন।’ তারিখুত তাবারি: ৬/১৬৯।
২. ২য় স্তর, কর্মের মাধ্যমে বিরোধীতা
এ স্তরের বিরোধিতা শুরু হয় ৫০ হিজরিতে। কারণ, এ বছর ইরাকের গভর্নর জিয়াদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অধঃপতন হয়। সম্পর্ক অধঃপতনের কারণ হিসেবে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়।
১. মুগিরা বিন শুবা রা. কর্তৃক উসমান রা.-এর প্রশংসা এবং তাঁর জন্য দুআ করা, আলি রা.-এর নিন্দা করা। এর বিপরীতে হুজর বিন আদি অগ্রসর হয়ে আলি রা.-এর প্রশংসা করা এবং উসমান রা.-এর নিন্দা করা। দেখা যেত, হুজর বিন আদি সম্পর্কে মুগিরা রা. চুপ থাকতেন। মুগিরা বিন শুবা রা. ইনতেকাল করলে জিয়াদ ইরাকের গভর্নর নিযুক্ত হোন। জিয়াদও উসমান এবং আলি রা.-এর ব্যাপারে মুগিরা রা. পথ অনুসরণ করেন। হুজর বিন আদিও দাঁড়িয়ে আগের মতো আলি রা.-এর প্রশংসা করেন। এটা ছিল, উভয়ের মুখোমুখি অবস্থানের কারণ।
২. জিয়াদের দীর্ঘ খুতবার কারণে নামাজ দেরি হওয়া। হুজর বিন আদি দাঁড়িয়ে সে বিষয়ের প্রতিবাদ করেন। এটাও ছিল উভয়ের মুখোমুখি অবস্থানের আরেকটি কারণ। এদুটি কারণ উভয়ের সম্পর্কে বিরক্তির উদ্রেক করে। মারওয়্যিাতু খেলাফাতি মুয়াবিয়া: ৪২৫।
এ বিষয় ছাড়া আরও কিছু কারণ ছিল,
* কুফাবাসীর সঙ্গে মুগিরা রা.-এর আচরণ ছিল, ক্ষমাসূলভ এবং দয়ার। কোনো ধরনের হিংসাত্মক বা ক্রোধ উদ্রেককারী আচরণ তিনি করতেন না। দলিল স্বরূপ ইমাম বুখারি রাহ. এর একটি রেওয়ায়ত পেশ করা যায়। জিয়াদ বিন আলাকা বলেন, আমি জারির বিন আবদুল্লাহকে বলতে শুনেছি যে, মুগিরা বিন শুবা রা. যে দিন ইনতেকাল করেছিলেন সে দিন তিনি কুফায় দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন,
‘তোমরা সেই একক আল্লাহকে ভয় করো, যিনি ছাড়া কোনো প্রতিপালক নেই। আরেকজন গভর্নর আসার আগ পর্যন্ত তোমরা নিশ্চিন্তে, প্রশান্তচিত্তে অবস্থান করো। তিনি শীঘ্রই আসবেন। এরপর বললেন, তোমার তোমাদের গভর্নরের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। কারণ, তিনি ক্ষমা করাকে পছন্দ করতেন।’
এরপর বলেন,
‘আমি রাসুল সা.-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললাম, আমি ইসলামের ওপর বায়আত হব। তিনি এর সাথে শর্ত লাগালেন, সকল মুসলমানের কল্যাণ করার। আমি এর ওপর বায়আত হলাম। এ মসজিদের প্রভুর কসম, আমি তোমাদের কল্যাণকামী। এরপর তিনি ইসতেগফার করে মিম্বর থেকে নেমে গেলেন।’ ফাতহুল বারি: ১/১৬৮।
* ৪৯ হিজরিতে জিয়াদ কুফার গভর্নর নিযুক্ত হন। এ ব্যাপারে জিয়াদের গোলাম ফাইল পরিস্কার বলেছে যে, জিয়াদ পাঁচ বছর ইরাকের গভর্নর ছিলেন। এরপর ৫৩ হিজরিতে তিনি ইন্তকাল করেন। এ কথা থেকে জিয়াদের কুফার গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির তারিখ জানা যায়। সেটা হলো, ৪৯ হিজরিতে। হাসান রা. জীবিত থাকতে হুজর বিন আদি এবং জিয়াদের মাঝে কোনো ধরনের বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। হাসান রা.-এর অস্তিত্ব তাঁদেরকে এগুলো থেকে নিরাপদ রাখত। তিনি তাঁদের আগলে রাখতেন। কারণ, সন্ধিতে শর্ত ছিল, তিনি কারও সাথে যুদ্ধ করলে তারাও যুদ্ধ করবে। তিনি কাউকে নিরাপত্তাপ্রদান করলে তারাও নিরাপত্তাপ্রদান করবে। কিন্তু ৫১ হিজরিতে হাসান রা.-এর ইনতেকালের পর শুরু হয় বিরোধ। মারওয়্যিাতু খেলাফাতু মুয়াবিয়া: ৪২৫।
ইরাকের কিছু নেতৃস্থানীয় লোক মৌখিক বিরোধিতার স্তর পাড়ি দিয়ে কাজের মাধ্যমে বিরোধিতা শুরু করে। হুজর বিন আদি রা.ও তাঁদের একজন। বালাযুরি সনদসহ শা’বি থেকে বর্ণনা করেন,
‘জিয়াদ যখন কুফায় গভর্নর হয়ে আসলেন, তিনি হুজর বিন আদি এর নিকট লোক পাঠিয়ে বললেন, আপনি এগুলো কি করছেন? আপনি আপনার মুখকে সংযত করুন এবং ্আপনার অবস্থানকে বিস্তৃত করুন। এই আমার খাট। এখানে হবে আপনার অবস্থান। আপনি নিচু হওয়া থেকে বিরত থাকবেন এবং আমাদেরও নিচু করা থেকে বিরত রাখবেন। যদি আমি আপনার অধিকার আদায়ে কমতি করি, তাহলে আমাকে বলবেন। আমি কথা থেকে এক চুলও নড়ব না।’
এরপর তিনি তাঁর বাড়িতে ফিরে গেলে রাফেজিরা তাঁর নিকট একত্রিত হয়ে বলল, আপনি আমাদের শায়খ। তাঁর আনুগত্য অস্বীকার করার অধিকার আপনার অবশ্যই রয়েছে।
এরপর বিশেষ প্রয়োজনে জিয়াদের বসরায় যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। যাওয়ার আগে তিনি আমর বিন হুরাইছ কে নামাজ এবং যুদ্ধের দায়িত্বপ্রদান করেন, খেরাজ উসূলের দায়িত্বপ্রদান করেন মাহরানকে। কর্মচারীদের নির্দেশ দেন আমর বিন হুরাইছ এর সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে। এরপর আমর জিয়াদের কাছে চিঠি লিখেন যে, আপনার যদি কুফায় কোনো প্রয়োজন থাকে, তাহলে তাড়াতাড়ি আসেন। হুজুর বিন আদির ব্যাপারে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে আমি অক্ষম। খবর পেয়ে জিয়াদ দ্রুত সফর করে কুফায় আসেন। তিনি আদি বিন হাতিম এবং জারির বিন আবদুল্লাহর কাছে লোক পাঠালেন এই মর্মে যে, আপনারা ফিতনা সৃষ্টিকারী এ শায়খকে বিরত রাখুন। কারণ, আমি ভয় করছি যে, তিনি এমন বিষয় আমাদের করতে বাধ্য করবেন যা আমাদের শানে মানায় না। তাঁরা হুজর বিন আদি রা.-এর সাথে কথা বলতে গেলে তিনি কারও সাথে কথা বললেন না। তাঁরা জিয়াদের কাছে ফিরে এসে তাঁর অবস্থা জানালেন এবং বললেন, হে গভর্নর! আপনি আপনার জিম্মায় তাঁকে রক্ষা করুন। কারণ, তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি বললেন, আমি এখন আবু সুফিয়ান নই। এরপর তিনি পুলিশ প্রেরণ করলেন এবং হুজুর বিন আদি রা.-কে হত্যা করা হলো। আনসাবুল আশরাফ: ৪/২৪৬।
অপর বর্ণনায় রয়েছে,
জিয়াদ যখন গভর্নর হিসেবে কুফায় আসলেন, তিনি হুজর রা.কে সম্মান করলেন এবং তাঁর নিকটবর্তী হলেন। এরপর যখন তিনি বসরায় যাওয়ার ইচ্ছে করলেন, তিনি হুজর বিন আদিকে ডেকে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কী আচরণ করেছি সেটা আপনি দেখেছেন। আমি আপনাকে আমার সঙ্গে বসরায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে করেছি। আপনাকে রেখে যেতে চাচ্ছি না। হতে পাের আপনার এমন কোনো সংবাদ আমার কাছে পৌঁছবে, যা আমার হৃদয়ে আঘাত করবে। আলি বিন আবু তালেব রা.-এর ব্যাপারে আমি আপনার মতো জেনেছি। আমারও মতো ইতিপূর্বে এমন ছিল। এরপর যখন দেখলাম নেতৃত্ব আল্লাহ তাআলা মুআবিয়া রা.-কে দান করেছেন, আল্লাহর নির্বাচনে আমি অভিযোগ না করে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিলাম। আলি রা.-এর বিষয় এবং তাঁর সঙ্গীদের অবস্থা আমি দেখেছি। আমি আপনাকে এমন অক্ষম বিষয়ে সওয়ার হতে নিষেধ করছি, যাতে সওয়ার হলে ধ্বংস হয়ে যাবেন। জিয়াদের উদ্দেশ্য ছিল, হুজর বিন ছিলেন আলি রা.-এর বিশেষ সাথীদের অন্যতম। কিন্তু যখন হাসান রা. এবং মুআবিয়া রা.-এর মাঝে সন্ধি হতে দেখলেন এবং সে ব্যাপারে উম্মতকে একমত হতে দেখলেন, তিনিও ঐক্যমতে প্রবেশ করলেন। ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করলেন এবং ফিতনা সৃষ্টির ব্যাপারে ভয় প্রদর্শন করলেন।
আদি বললেন, আমি অসুস্থ। বসরায় স্থানাস্তর হতে পারব না। জিয়াদ বললেন, সত্য বলেছেন। আপনি হলেন দীন, অন্তর এবং বিবেকের অসুস্থ। আল্লাহর শপথ, যদি আপনার কোনো ফিতনার সংবাদ আমার কাছে পৌঁছে, তাহলে আমি আপনাকে হত্যা করতে বাধ্য হব। আপনি চিন্তা করুন অথবা এগুলো ছেড়ে দিন। এরপর জিয়াদ বসরায় চলে গেলেন। হুজরের নিকট তখন কুফার কারীরা একত্রিত হলো। তাঁরা জিয়াদের প্রতিনিধির কোনো নির্দেশ পালন করত না। তাঁরা কোনো কিছু করতে চাইলে বাধা প্রদান করত। প্রতিনিধি জিয়াদের কাছে চিঠি লিখলেন তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে। জিয়াদ তখন দ্রুত সফর করে কুফায় আসলেন। তিনি আসলে হুজর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অনুসন্ধান করে তাঁকে পাওয়া গেল না। আনসাবুল আশরাফ: ৪/২৭০।
আর জিয়াদের পুলিশ এবং হুজর এবং তাঁর সাহায্যকারীদের মুখোমুখি অবস্থান শুধুমাত্র আবু মুখান্নাফ একাকি রেওয়ায়াত করেছে। এমনভাবে হুজর এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে কুফাবাসীর সাক্ষী প্রদানের কথাও সে একাকি উল্লেখ করেছে। তারিখুত তাবারি: ৬/১৭৭-১৮৩।
৩. হুজর এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে মুআবিয়া রা.-এর সিদ্ধান্ত
হুজরের বিষয় স্পর্শকাতর অনুধাবন করে জিয়াদ একটি শর্তে তাঁকে আত্মসমর্পনের নির্দেশ প্রদান করেন। শর্ত হলো, হুজর এবং তাঁর সঙ্গীদের ফায়সালা তিনি করবেন না; বরং ফায়সালার দায়িত্ব মুআবিয়া রা.-এর নিকট হস্তান্তর করা হবে। তারিখুত তাবারি: ৬/১৮৭-১৮৮।
হুজর বিন আদি এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে মুআবিয়া রা.-এর ফায়সালা জানার আগে আরেকটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। কী কী অভিযোগে হুজর বিন আদি রা.-কে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিস্তারিত অভিযোগ আবু মুখান্নাফের বর্ণনায় এসেছে। হুজর বিন আদি রা. কবিতা পেশ করে মুআবিয়া রা.-এর বিরোধিতা করতেন। তিনি মুআবিয়া রা.-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লোকদের উৎসাহপ্রদান করতেন এবং মুআবিয়া রা.-কে গালিগালাজ করতেন। তাঁর মতো ছিল, খেলাফতের জন্য আলি রা.-এর পরিবারই একমাত্র যোগ্য। তিনি মিশরে হামলা করে আমিরুল মুমিমিন কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নরকে বের করে দেন। এরপর আলি রা.-এর অপারগতা পেশ করে তাঁর জন্য দোয়া করলেন। এরপর শত্রুদের সাথে নিজের সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করলেন। এরপর বললেন, যারা আলি রা.-এর সাথে ছিল, তাঁরা যেন আমার নির্দেশের অনুসরণ করে।’ তারিখুত তাবারি: ৬/১৮৭।
মুআবিয়া রা. হুজর বিন আদি এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে দ্রুত হত্যা করার মতো প্রকাশ করেননি। এমনভাবে তাঁদেরকে সাফাই উপস্থাপনেরও কথা বলেননি যেমনটা কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন।
তিনি তাঁদের বিষয়ে ইসতেখারা করেছেন। পরামর্শদাতাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। এরপর সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন কিছুকে হত্যা করার এবং কিছুকে জীবিত রাখার। এর পক্ষে হাসান সনদে বর্ণিত একটি রেওয়ায়াত রয়েছে। শুরাহবিল বিন মুসলিম বর্ণনা করেন, হুজর বিন আদি বিন আদবর এবং তাঁর সঙ্গীদের যখন ইরাক থেকে মুআবিয়া রা.-এর নিকট প্রেরণ করা হলো, তাঁদের হত্যা করার ব্যাপারে তিনি পরামর্শ করলেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে চুপ থাকলেন। কেউ কেউ পরামর্শ প্রদান করলেন। মুআবিয়া রা. শুনে তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। জোহরের নামাজান্তে তিনি লোকদের বক্তৃতা প্রদানের উদ্দেশ্যে দাড়লেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করলেন। এরপর মিম্বরে বসলেন। তখন ঘোষক ঘোষণা করল, আমর বিন আসওয়াদ কোথায়?
তিনি দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সুরক্ষিত দুর্গে নিরাপদে রয়েছি। দুর্গ পরিত্যাগ করার নির্দেশ আমাদের প্রদান করা হয়নি। ইরাকিদের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কারণ, আপনি হলেন রাখাল, আমরা হলাম শাবক। তাঁদের প্রতিকার সম্পর্কে আপনি বেশি অবগত। আমাদের কাজ হলো শুনা এবং আনুগত্য করা।’
ঘোষক তখন ঘোষণা করল, আবু মুসলিম খাওলানি কোথায়?
তিনি দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন, ‘আমরা যেদিন থেকে আপনাকে ভালোবেসেছি, এরপর থেকে বিদ্ধেষ পোষণ করিনি। আনুগত্যের পর অবাধ্যতা করিনি। ঐক্য হওয়ার পর বিচ্ছিন্ন হইনি। বায়আতের পর লঙ্গণ করিনি। আমাদের স্কন্ধে অর্পিত দায়িত্ব হলো, আপনি নির্দেশ দিলে আনুগত্য করা। ডাকলে সাড়া দেওয়া।’ এরপর তিনি বসে গেলেন।
এরপর ঘোষক ঘোষণা করল, আবদুল্লাহ বিন মিখমার কোথায়?
তিনি দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আপনি যদি ইরাকবাসীদের শাস্তি প্রদান করেন, তাহলে সঠিক করেছেন। ক্ষমা করে দিলে তাঁদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন।’
ঘোষক আবার ঘোষণা করল, আবদুল্লাহ বিন আসাদ কোথায়?
তিনি দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করে বলেন, ‘তারা আপনার প্রজা। তাঁদের আপনি শাস্তি প্রদান করলে তাঁরা শাস্তির পাওয়ার মতো অপরাধ করেছে। যদি মাফ করে দেন, তাহলে ক্ষমা তাকওয়ার নিকটবর্তী হে আমিরুল মুমিনিন। আপনি আমাদের অনুসরণ করবেন না যারা অত্যাচারী, রাতে ঘুমে থাকে এবং আখিরাতের আমল থেকে নিস্পৃহ। হে আমিরুল মুমিনিন, দুনিয়া তাঁর গোঁজকে বিস্তৃত করেছে। তাঁর স্তম্ভকে ধাবিত করেছে। তাঁর সঙ্গীদের ভালোবাসে। তাঁর প্রতিশ্রুত সময়কে নিকটবর্তী করেছে।’ মারওয়্যিাতু খেলাফাতু মুআবিয়া: ৪৩৪।
বর্ণনাকারী বলেন, আমি শুরাহবিলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, মুআবিয়া রা. তাঁদের সাথে কী আচরণ করেছিলেন?
তিনি বললেন, ‘তাঁদের কিছু লোককে হত্যা করা হয় এবং কিছূ লোককে জীবিত ছেড়ে দেওয়া হয়। যাদের হত্যা করা হয়, তাঁদের মাঝে হুজর বিন আদি রাযি.ও ছিলেন।’ আহমদ বিন হাম্বল: মাসায়িল, ২/৩২৮।
হত্যার পূর্বে হুজর বিন আদি বলেন, হে সম্প্রদায়, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি দু রাকাত নামাজ পড়ব। তাঁকে নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়া হলো। তিনি ওজু করে দীর্ঘ দু রাকাত নামাজ পড়লেন। তাঁকে বলা হলো, আপনি কী ভয়ে দীর্ঘ নামাজ পড়েছেন?
তিনি বলেন, ‘আমি এত সংক্ষিপ্ত নামাজ কখনো পড়িনি। আর যদি চিন্তিত হই, আমি প্রসিদ্ধ তরবারি, বিস্তৃত কাফন, খুড়া কবর দেখেছি। তাঁদের স্বজনরা কাফন নিয়ে এসেছে এবং তাঁদের জন্য কবর খুড়েছে।
বলা হয়, মুআবিয়া রা. এটা করেছেন। হুজর বলেন, হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে প্রত্যাবর্তন করছি। ইরাকবাসীরা আমাদের ব্যাপারে সাক্ষী দিয়েছে আর সিরয়াবাসীরা আমাদের হত্যা করেছে। তাঁকে বলো হলো, গর্দান প্রসারিত করুন। তিনি বলেন, এখানে রক্ত। এ ব্যাপারে কাউকে সাহায্য করব না। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৬৫।
অপর বর্ণনায় এসেছে, মুআবিয়া রা.-এর কাছে যখন হুজরকে নিয়ে আসা হলো, তিনি বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম হে আমিরুল মুমিনিন!’
তিনি বললেন, আমি কী আমিরুল মুমিনিন? তাঁর গর্দানে আঘাত করো।’
এরপর তিনি দু রাকাত নামাজ পড়লেন। এরপর পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা আমার লোহার বেড়ি খোলবে না। আমার রক্ত ধৌত করবে না। কারণ, আমি মুআবিয়ার সাক্ষাৎ করব মামলা দায়ের করে।’ সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৬৬।
হুজর বিন আদি আর হত্য সম্পর্কে ইবনুল আরাবি বলেন,
‘তিনি ফিতনা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। মুআবিয়া রা. তাঁকে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টিকারী হিসেবে গণ্য করেছেন।’ আল আওয়াসিম ওয়াল কাওয়াসিম: ২২০।
রায়ের ক্ষেত্রে মুআবিয়া রা. রাসুল সা.-এর একটি হাদিস সামনে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘যদি এমন কেউ আসে যারা তোমাদের লাঠি বিদির্ণ করতে চায় অথবা উম্মতের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে তাঁদেরকে হত্যা করো।’
রাসুল সা. আরেক হাদিসে বলেন, ‘অতি শীঘ্রই ফিতনা সৃষ্টি হবে। যে এই উম্মতে মতভিন্নতা সৃষ্টি করতে চাইবে, তাঁদের তোমরা হত্যা করো।’ সহিহ মুসলিম শরহে নববি: ১২/২৬১।
এর থেকে বোঝা যায়, হুজর বিন আদি যদি শুধুমাত্র মৌখিক বিরোধিতায় সীমাবদ্ধ থাকতেন, তাহলে মুআবিয়া রা. তাঁকে হত্যা করতেন না। মিসওয়ার বিন মাখরামা রা. এবং পূর্বে উল্লিখিত নস থেকে এটা বোঝা যায়।
৪. হুজর বিন আদি এর হত্যা সম্পর্কে আয়েশা রা. অবস্থান
হুজর বিন আদি রা.-এর হত্য সম্পর্কিত আয়েশা রা.-এর অবস্থান সংক্রান্ত কিছু বর্ণনায় বাড়াবাড়ি রয়েছে। কিছু রেওয়ায়াতে এমনটা বর্ণিত হয়েছে যে, মুআবিয়া রা.-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হলে তিনি তাঁকে ধমক দিয়েছেন। যেমনভাবে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে, যুদ্ধ সংক্রান্ত বর্ণনায়। বলা হয়, যুদ্ধের কারণে আয়েশা রা. তাঁকে ধমক দিয়েছিলেন।’ মারওয়্যিাতু খেলাফাতু মুআবিয়া ফি তারিখিত তাবারি: ৪৩৮।
আয়েশা রা. থেকে এ ধরনের কোন রেওয়ায়াত সহিহ নয়। বাস্তবতা হলো, ইবনে আবি মুলায়কা বর্ণনা করেন, মুআবিয়া রা. আয়েশা রা.-এর কাছে এসে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি প্রদান করতে অস্বীকার করলেন। জাকওয়ান নামক আয়েশা রা.-এর একজন গোলাম বের হলে মুআবিয়া রা. তাঁকে বললেন, উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. আমার ওপর রাগ করেছেন। আপনি আমাকে তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দিন। গোলাম পীড়াপীড়ি করলে আয়েশা রা. অনুমতিপ্রদান করেন।
তিনি প্রবেশ করে বললেন, ‘আম্মাজান! আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন, আপনি কেন আমার ওপর রাগ করে আছেন?’
তিনি বলেন, ‘হুজর বিন আদি এবং সঙ্গীদের ব্যাপারে আমি সংবাদ পেয়েছি যে, তুমি তাঁকে হত্যা করেছ?’
তিনি বলেন, হুজর এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে আমি এমন ফিতনার আশঙ্কা করেছি, যে ফিতনা তরবারিকে আবার উন্মুক্ত করবে। রক্ত প্রবাহিত করবে। আপনি আমাকে নিয়ে ভয় করছেন! আমাকে ছেড়ে দিন। আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করবেন। তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে তিনবার বলেন, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি।’
অপর বর্ণনায় রয়েছে, মুআবিয়া রা. এসে আয়েশা রা.-এর কাছে প্রবেশ করলেন। তিনি বললেন, আপনি কি হুজরকে হত্যা করেছেন? আমি বললাম, কোনো মানুষকে বাঁচিয়ে ফিতনা সৃষ্টি করা থেকে তাঁকে হত্যা করে মানুষকে বাঁচানো আমার নিকট উত্তম।’ তারিখে দিমাশক: ৪/২৭৩।
৫. হুজর বিন আদিকে হত্যার কারণে মুআবিয়া রা. অনুতপ্ত হওয়া
বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা রা. আবদুর রহমান বিন হারিছকে হুজর বিন আদি এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে কথা বলার জন্য মুআবিয়া রা.-এর কাছে প্রেরণ করেন। তাঁদের হত্যা করার পর তিনিিএসে পৌঁছালেন। আবদুর রহমান বললেন, আবু সুফিয়ানের বিচক্ষণতা তোমার থেকে কোথায় অনুপস্থিত ছিল?
তিনি বললেন, আপনার মতো প্রজ্ঞাবানরা দূরে থাকলে বিচক্ষণতা অনুপস্থিত থাকবেই।’ তারিখুত তাবারি: ৬/১৯৫।
এ রেওয়ায়াত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম জাহাবি বলেন, হুজর বিন আদি রা. এবং তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করার কারণে মুআবিয়া রা. অনুতপ্ত হয়েছিলেন। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/৪৬৫।
হুজর বিন আদিকে হত্যার জন্য ওজর হিসেবে যদিও অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়, তারপরও এটা মুআবিয়া রা.-এর ভুল এবং বাড়াবাড়ি। রাসুল সা.-এর সাহাবির ব্যাপারে আরও বিচক্ষণতার প্রয়োজন ছিল। হুজরকে হত্যার কারণে মুআবিয়া রা. অনেক বেশি অনুতপ্ত হয়েছেন। বাকি জীবন এ ঘটনা তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে। বর্ণিত হয়েছে, তিনি মৃত্যুর সময় বলেন, ‘হুজরকে হত্যার পর থেকে আমার দিন দীর্ঘ হয়ে গেছে।
৬. মালিক বিন হুবায়রা রা.-এর অবস্থান
হুজর বিন আদি রা.-এর ব্যাপারে মুআবিয়া রা. মালিক বিন হুবায়রা রা.-এর সুপারিশ গ্রহণ করেননি। হুজর এবং তাঁর সঙ্গীদের মুক্ত করার জন্য মালিক তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে রওয়ানা হলে হত্যাকারীদের সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। মালিক বিন হুবায়রা রা. তাঁদের হুজর বিন আদি রা. এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে বলো, তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। এরপর হুজর বিন আদি এর পিতা আদি সে কথা সত্যায়ন করেন।
মুআবিয়া রা.-কে তাঁরা সংবাদ দিলে তিনি বললেন, এটা স্ফুলিঙ্গ, তাঁরা অন্তরে অনুভব করেছে। যেন আমি তা নির্বাপিত করেছি। এরপর তিনি মালিক বিন হুবায়রা রা.-কে এক লাখ দিরহাম পাঠিয়ে বললেন, ‘আমি ভয় করছিলাম, হুজর বিন আদি সম্প্রদায়কে পুনরায় যুদ্ধের ধাবিত করবে। সেটা মুসলমানদের জন্য হুজর হত্যার থেকে বেশি ক্ষতিকর হয়ে যায়। তখন মালিক বিন হুবায় রা.-এর অন্তর তখন খুশি হলো। তারিখে ইবনে খালদুন: ৩/১৭।
মালিক বিন হুবায়রা রা. ছিলেন প্রসিদ্ধ সাহাবি। মুআবিয়া রা. তাঁকে হিমসের গভর্নর বানিয়ে ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমার নিকট আরবের মধ্যে মুসলমানদের জন্য কলাণকামী মালিক বিন হুবায়রা থেকে কাউকে বেশি পাইনি।
মুআবিয়া রা. হত্যা ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি প্রদান করতে পারতেন। যেমন বন্দি করতে পারতেন, অথবা হুজর কে তাঁর সঙ্গীদের থেকে আলাদা করতে পারতেন।
মূল: শায়খ আলী সাল্লাবী
অনুবাদ: রেজাউল কারীম আবরার