শবে ইসতেফতাহ: প্রচলিত একটি বেদয়াতের পর্যালোচনা
রসম— রেওয়াজে যারা বিশ্বাসী, তারা রজব মাসের আরেক রাত্রিতে খুব ঘটা করে আরেকটি নামায আদায় করেন। যে রাতের আমলের নাম দিয়েছেন শবে ইসতেফতাহ নামে। প্রথমে ‘বার চান্দের ফযীলত’ থেকে শবে ইসতেফতাহ এর ফযীলত জেনে আসি। সেখানে লেখা হয়েছে:
“রজব মাসের ১৫ই তারিখের রাত্রকে আওলিয়াগণ ও মাশায়েখগণ ‘শবে এসতেফতাহ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই মহান রাত্রের নফল ইবাদতের কারণে অনেক মুমিন বান্দার মনের আকাংখা পূর্ণ হয় এবং ভাগ্য খুলিয়া যায়। এই রাত্রির নফল ইবাদতের কতিপয় নিয়ম নিম্নে উল্লেখ করা হইল।
১। রজব মাসের ১৫ই তারিখ রাতে অজু গোসল করত: পাক পবিত্র পোশাক পরিধান করত: দুই দুই রাকাতের নিয়তে মোট আট রাকাত নামায আদায় করিবে। উহার প্রত্যেক রাকাতের সূরা ফাতেহার পরে তিনবার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিবে। এই নামাযী ব্যক্তি অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হইবে এবং দুনিয়ার জীবনে সৌভাগ্যশীল ও মান সম্মানের অধিকারী হইবে।
২। বর্ণিত আছে, এই রাত্রিতে তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের পরে দুই দুউ রাকাতের নিয়তে মোট ৫০ রাকায়াত নামায আদায় করিবে। ইহার প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে তিনবার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিবে অথবা অন্য যে কোনো সূরা মিলাইয়া পড়িবে। এই নামাযের বরকত ও ফযীলত অত্যধিক। যথা— এই নামাযী ব্যক্তি নামায শেষে আল্লাহর কাছে যাহাই প্রার্থনা করিবে তিনি তাহাই কবুল করিবেন। এই নামাযীর সকল গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। এই নামাযীর কবর অত্যধিক উজ্জল হইবে। এই নামাযী ব্যক্তি রোজ কেয়ামতের ময়দানে মুত্তাকী, নেকবখত ও শহীদানের সঙ্গে শামিল হইবে এবং আম্বিয়াগণের সাথে জান্নাতে দাখিল হইবে।
৩। হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমাইয়াছেন, রজব মাসের ভিতরে একটি নির্দিষ্ট সময় (তারিখ) রহিয়াছে। সেই তারিখে নফল নামায পড়িলে, তাঁহার তকদীরে ১০০ বৎসরের নফল নামাযের সওয়াব লাভ হইবে। তবে বুযুর্গ ব্যক্তিগণ ধারণা করিয়াছেন যে, এই সৌভাগ্য রাত্রটি হইতেছে ১৫ই রজবের রাত্র যাহা “শবে এসতেফতাহ” নামে আখ্যায়িত।
৪। বর্ণিত আছে, ১৫ই রজবের রাত্রিবেলা দুই দুই রাকাতের নিয়্যতে মোট ৭০ রাকয়া’ত নফল নামায আদায় করিবে। ইহার প্রত্যেক রাকয়াতে সূরা ফাতেহার পরে তিনবার করিয়া সূরা ইখলাছ পাঠ করিবে। এই নামাযী ব্যক্তির আমলনামায় দুনিয়ার বৃক্ষসমূহের সংখ্যানুযায়ী সওয়াব লিখা হইবে। বার চান্দের ফযীলত, পৃষ্ঠা নং ২১—২২
প্রথমে একটি কথা বলে রাখি, রজব মাসের কোনো বিশেষ নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সবগুলো মানুষের বানানো। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে রাজাব হাম্বলী রহ. বলেন—
فأما الصلاة فلم يصح في شهر رجب صلاة مخصوصة تختص به
অর্থাৎ রজব মাসেকোনো বিশেষ নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা নং, ১৬৫, দারুলি হাদীস কাহেরা, আবদুল্লাহ বিন আমের তাহকীককৃত।
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ.—এর কথা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, রজব মাসেকোনো বিশেষ নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সুতরাং ‘সালাতুল ইসতেফতাহ’ নামে কোনো নামায প্রমাণিত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তকালের বহু পরে মানুষেরা আবিষ্কার করেছে। সুতরাং বিশেষ পদ্ধতির এ নামায বেদয়াত এবং মানুষের বানানো।
আল্লামা আবদুল হাই লাখনোভী রহ.ও এ নামায নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন—
قد كنت لما سافرت من الوطن مع الوالدين المرحومين إلى حيدر آباد الدكن في سنة أربع وثمانين بعد الألف والمائتين من الهجرة على صاحبها أفضل الصلوات والتحية دخلت بلدة حيدر آباد في اليوم الخامس عشر من رجب فلقيني بعض مشايخها وقال مرحبا نعم المجيء جئت ما أحسن وصولك في اليوم المبارك يوم الاستفتاح فقلت في نفسي لعل لهذا اليوم فضلا ثابتا بالرويات ثم طلبت ذلك من مظانه فلم أجد لذلك أصلا ثم وقفت على كلام الشيخ الدهلوي في ما ثبت بالسنة اعلم أنا لم نجد في كتب الأحاديث لا إثباتا ولا نفيا ما اشتهر بينهم من تخصيص الخامس عشر من رجب بالتعظيم والصوم والصلاة وتسميته بيوم الاستفتاح وتسميته بمريم دوزه انتهى فعلمت أنه ليس إلا من جنس الأمور المشهورة بين الصوفية مما ليس له أصل في كتب الشريعة
অর্থাৎ যখন আমি আমার মাতা—পিতার সাথে ১২৮৪ হিজরীতে হায়দারাবাদ সফর করলাম, হায়দারাবাদে আমি রজব মাসের পনের তারিখে প্রবেশ করলাম। আমার সাথে সে জায়গার কিছু মাশায়েখের সাক্ষাৎ হলো। তারা বললেন,আপনি কত উত্তম দিনে এসেছেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়ত এ দিনের কোনো ফযীলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এরপর আমি ব্যাপক অনুসন্ধান করে এটার কোনো ভিত্তি পাইনি। এরপর আমি শায়খ দেহলোভী রহ. এর কিতাব ‘মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ’ কিতাবে তাঁর কথা পড়লাম। তিনি বলেন, আমরা হাদীসের কিতাবে রজব মাসের পনের তারিখের ইবাদতের কথা পাইনি। আবার নিষেধও পাইনি। যেই দিন মানুষ নামায, রোযাসহ অন্যান্য ইবাদত করে এবং সেদিনকে ‘ইসতেফতাহ’ এবং ‘মারইয়ামদুযাহ’ বলে নামকরণ করে।
আবদুল হাই লাখনভী রহ. বলেন, এরপর আমি জানতে পারলাম যে, সালাতুল ইসতেফতাহ সূফীদের মাঝে প্রসিদ্ধ। যার কোনো ভিত্তি নেই। আল আছারুল মারফুআ, পৃষ্ঠা নং, ৬৩,
রজব মাসের বিশেষ নামাযের আলোচনা করতে গিয়ে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন—
ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه — حديث صحيح يصلح للحجة، وقد سبقني إلى الجزم بذلك الإمام أبو إسماعيل الهروي الحافظ، رويناه عنه بإسناد صحيح، وكذلك رويناه عن غيره،
অর্থাৎ রজব মাসের বিশেষ কোনো নামায দলীলযোগ্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আমার আগে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বলেছেন হাফেয ইমাম ইসমাইল হারাওয়ী। তাঁর থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত। এমনভাবে অন্য আরো অনেক থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত। তাবয়িনুল আযাব , পৃষ্ঠা নং, ১. মাকতাবাতুশ শামেলা।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হযরাতুল উস্তাদ শায়খ আবদুল মালেক দা.বা. এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন—
“এমনিভাবে পনের রজবের রাত সম্পর্কিত একটি জাল বর্ণনা হলো:
‘এ রাতে চার রাকাত নামায বিশেষ নিয়মে আদায় করে নির্দিষ্ট পরিমাণ দরুদ, তাসবীহ—তাহমীদ ও তাহলীল আদায় করলে আল্লাহর পক্ষ হতে তার নিকট এক হাজার ফেরেশতা পাঠানো হয়। যারা ওই ব্যক্তির জন্য ‘এ রাতে চার রাকাত নামায বিশেষ নিয়মে আদায় করে নির্দিষ্ট পরিমাণ দরুদ, তাসবীহ—তাহমীদ ও তাহলীল আদায় করলে আল্লাহর পক্ষ হতে তার নিকট এক হাজার ফেরেশতা পাঠানো হয়। যারা ওই ব্যক্তির জন্য নেকী লিখতে থাকেন এবং ওই রাত পর্যন্ত যত গোনাহ সে করেছে সব ক্ষমা করে দেন। অবশেষে তার কাঁধে হাত রেখে একজন ফেরেশতা বলে, তুমি নতুন করে আমল শুরু কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন……।’
গোনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নতুন করে আমল শুরু করার এই বানোয়াট বর্ণনার কারণেই সম্ভবত এই রাতের নাম রাখা হয়েছে ‘শবে ইস্তেফতাহ’।
উল্লিখিত বর্ণনা ছাড়াও এ দু’রাকাত সম্পর্কে এ ধরণের আরও প্রচুর ভিত্তিহীন বর্ণনা রয়েছে; কিন্তু আসল কথা হলো শরীয়তে ‘লাইলাতুর রাগাইব’ ও ‘শবে ইসতেফতাহ’ নামে বিশেষ কোনো রাতের অস্তিত্বই নেই।
নামে—বেনামে রজব মাসে এ বিশেষ রাত উদযাপন হচ্ছে নবউদ্ভাবিত বিদআত। কুরআন ও সুন্নাহয় যার কোনো প্রমাণ নেই। তেমনিভাবে ওই রাত বা দিনগুলোতে কোনো নির্দিষ্ট নামায—রোযা বা অন্য কোনো বিশেষ আমলের কথাও ইসলামে নেই। এ সম্পর্কিত সকল বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও জাল
অতএত ‘লাইলাতুর রাগায়িব’ হোক কিংবা ‘শবে ইসতেফতাহ’ এগুলো উদযাপন করা কিংবা কল্পিত ও ভিত্তিহীন বর্ণনার ওপর নির্ভর করে বিশেষ ধরণের আমল করা সবই পরিত্যাজ্য। এগুলো থেকে দূরে থাকাই একজন মুমিনের কর্তব্য। প্রচলিত ভুল, ১৭৯—১৮০, মারকাযুদ দাওয়াহ থেকে প্রকাশিত।
আশা করি এ বিস্তারিত আলোচনার পর রজব মাসের পনের তারিখের রাতের বিশেষ নামাযের বাস্তবতা পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। এজন্য এ সমস্ত রসম সর্বস্ব নামায থেকে মুসলামনরা বেঁচে থাকা জরুরী। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন!