খুৎবা চলাকালিন সময়ে কি তাহিয়্যাতুল মসজিদ দু রাকাত নামায পড়া যাবে?

খুতবা চলাকালিন সময়ে কি তাহিয়্যাতুল মসজিদ দু রাকাত নামায পড়া যাবে?

খুতবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা যাবে কিনা ? এবিষয়ে ইখতেলাফ চলে আসছে সাহাবা এবং তাবেয়ীনদের যুগ থেকে। খুলাফায়ে রাশেদীন এবং জমহুর সাহাবা ও তাবেয়ীনদের মতে খুৎবা চলাকালিন সময়ে নামায এবং কথা বলা নিষেধ। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক এবং অধিকাংশ ফকীহদের মতও এমনই। কুরআন, হাদীসের আলোকে এই মতটি অধিক যুক্তিসঙ্গত। এর বিপরীতে কিছু সাহাবা এবং তাবেয়ীন খুৎবা চলাকালিন তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার পক্ষে মতামত পেশ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমদও এমনটা বলেন। মোটকথা হলো, মাসআলা নিয়ে মতপার্থক্য চলে আসছে সাহাবাদের যুগ থেকে। কিন্তু একে অপরের বিরুদ্ধে লিফলেট চালাচালি করেননি! অপরের মাযহাবকে ভুল এবং হাদীসের বিপরীত বলে মত পেশ করেননি। কিন্তু বর্তমানে নিজের মতের বিপরীত মতকে জাল আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমাদের আমল সহীহ হাদীস অনুসারে নয়! এজন্য কুরআন এবং সহীহ হাদীসের আলোকে আমাদের মাযহাবের উপর পর্যালোচনা করছি আল্লাহ তাওফিকদাতা।

কুরআন থেকে দলীল
জুমার খুৎবা চলাকালিন সময়ে মুসল্লীদের কাজ হলো গভীর মনোযোগ সহকারে ইমামের খুৎবা শুনা। এ সময়ে মুসল্লীদের অন্য কোনো কিছু করার অনুমতি নেই। এমনকি নফল নামায পড়ারও। বিষয়টি কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَإِذَا قُرِئ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থ: যখন কুরআন পড়া হবে, তখন গরীব মনযোগ সহকারে শুনো এবং চুপ থাকো। যাতে করে তোমাদের উপর রহম করা হয়। সূরা আরাফ, আয়াত নং, ২০৪.

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-
وقد استفاض عن السلف أنها نزلت في القراءة في الصلاة وقال بعضهم في الخطبة وذكر أحمد بن حنبل الاجماع على أنها نزلت في ذلك
অর্থাৎ সালাফ থেকে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত যে, আয়াতটি নামাযের কেরাতের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, খুৎবার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এ ব্যাপারে ইজমা তথা ঐক্যমত নকল করেছেন যে, আয়াতটি নামায এবং খুৎবার ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। মাজমুয়াতু ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া, ২/২৮৬. দারুল মারেফা, বায়রুত, প্রথম সংস্করণ।

ইমাম আহমদের বক্তব্য অনুসারে আয়াতটি নামায এবং খুৎবা সম্পর্কে উম্মতের ঐক্যমত রয়েছে। সুতরাং কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, খুৎবার সময় মুসল্লীদের জন্য ওয়াজিব হলো খুৎবা শুনা। তাদের জন্য এমন কথা এবং কাজ নিষেধ করা হয়েছে যা শুনাতে বাধা সৃষ্টি করে। খুৎবাতে যেহেতু কুরআনের আয়াত শামিল থাকে, এজন্য হাদীসে খুৎবাকে ‘জিকির’ বলা হয়েছে এবং শ্রবণ করা ওয়াজিব বলা হয়েছে। খুৎবা শ্রবণের পথে বাধা সৃষ্টি করে, এমন কাজ নিষেধ করা হয়েছে। এজন্য শরীয়তের দৃষ্টিতে খুৎবা শুধুমাত্র নসীহতের নাম নয়। বরং তাতে নামাযের শান পাওয়া যায়। এজন্য জুমা সহীহ হওয়ার জন্য খুৎবা শর্ত করা হয়েছে। এজন্য সালাফের অনেকেই বলেছেন, যে ব্যক্তি খুৎবা পেল না, তার জন্য জুমার নামায নেই। সে যেন জোহরের নামায চার রাকাত আদায় করে। উমর রা. বলেনÑ
الخطبة موضع الركعتين من فاتته الخطبة صلى أربعا
অর্থাৎ জুমার খুৎবা হলো দু রাকাত নামাযের স্থলাভিষিক্ত। যার খুৎবা ছুটে গেলো, সে যেন জোহরের নামায চার রাকাত পড়ে। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস নং- ৫৪৮৫. আল্লামা হাবিবুর রহমান আযমী তাহকীককৃত।
তাউস রহ. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ এবং আতা রহ. থেকে বর্ণনা করেন-
فمن لم يدرك الخطبة صلى أربعا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি খুৎবা পাবেনা, সে যেন জোহরের চার রাকাত আদায় করে। মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস নং- ৫৪৮৮. আল্লামা হাবিবুর রহমান আযমী তাহকীককৃত।

যদিও অধিকাংশ ইমামের মত হলো, ঐ ব্যক্তি জুমা পড়বে এবং তার জুমার নামায আদায় হবে।
মোটকথা হলো, উপরোল্লিখিত আয়াত দ্বারা খুৎবা চুপ করে গভীর মনযোগ সহকারে শুনা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং খুৎবা চলাকালিন নামায পড়া, কথা বলা এবং এমন কাজ করা, যা শুনতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, করা যাবে না।

হাদীস থেকে দলীল
এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সালমান ফরসী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَا يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِه أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ثُمَّ يَخْرُجُ فَلَا يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الْإِمَامُ إِلَّا غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرَى
অর্থাৎ যে ব্যক্তি জুমার দিন গোছল করলো এবং ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করলো, এতপর সুগন্ধী জাতীয় কোনো কিছু ব্যবহার করলো, এরপর নামাযের উদ্দেশ্যে বের হলো, কাউকে মাড়িয়ে গেলোনা, এরপর নির্ধারিত নামায পড়লো, এরপর খুৎবার সময় চুপ থাকলো, আল্লাহ তায়ালা তার আগামী জুমা পর্যন্ত সকল গোনাহকে মাফ করে দেন। বুখারী, হাদীস নং, ৮৮৩. শায়খ যুহাইর বিন নাসের তাহকীককৃত।

এবিষয়ে ‘মুসলিম শরীফ’-এ আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস হলো-
فصلى ما قدر له ثم انتصت حتى يفرغ من خطبته ثم يصلي معه
অর্থাৎ মসজিদে আসার পর সে তার সামর্থ অনুযায়ী নামায পড়লো, এরপর ইমাম সাহবে খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত তা চুপ করে শুনলো, এরপর তার সাথে নামায আদায় করলো, তাহলে তার সামনের এক সপ্তাহের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। মুসলিম, হাদীস নং, ৮৫৭. শায়খ ফুয়াদ আবদুল বাকী তাহকীককৃত।

এবিষয়ে আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকেও হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
من اغتسل يوم الجمعة ومس طيبا إن كان عنده ولبس من أحسن ثيابه ثم خرج حتى يأتي المسجد فيركع ما بدا له ولم يؤذ أحدا ثم أنصت إذا خرج الإمام كانت كفارة لما بينها وبين الجمعة الأخرى
অর্থাৎ যে ব্যক্তি গোছল করলো, সুগন্ধী ব্যবহার করলো, সর্বোত্তম কাপড় পরিধান করলো, এরপর মসজিদে এসে কাউকে কষ্ট না দিয়ে সাধ্যমত নামায পড়লো, এরপর চুপ থেকে ইমামের খুৎবা শ্রবণ করলো, তাহলে তার আগামী পুরো সপ্তাহের গোনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। মুসনাদে আহমদ, ২৩৫৭১. শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত। মাযমাউয যাওয়ায়িদ, ৩০৩৮ দারুল ফিকর, বায়রুত।

এ বিষয়ে আরো কিছু হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস সমূহে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। একটি হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়ার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন খুৎবার পূর্ব পর্যন্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি খুৎবা শুরুর পর নামায পড়লো, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্ধারিত সময়ের বাহিরে নামায পড়লো।
দ্বিতীয়ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায এবং চুপ থাকাকে পরস্পর বিরোধি করে উল্লেখ করেছেন। খুৎবার পূর্বে নামায এবং খুৎবা চলাকালিন চুপ থাকার কথা বলেছেন। যা থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হলো যে, খুৎবা চলাকালিন নামায পড়া চুপ থাকাতে বাধা সৃষ্টি করে। আর সে সময় চুপ থাকা ওয়াজিব। নামায আর কথা যেহেতু চুপ থাকাতে বাধা সৃষ্টি করে, এজন্য খুৎবা চলাকালিন উভয়টি নিষিদ্ধ।
‘বুখারী’ শরীফে বর্ণিত আবু হুরায়রা রা. এর পূর্বোক্ত হাদীস। যেখানে জুমার নামায আদায়ের জন্য প্রথম দিকে মসজিদে আগমণকারী ব্যক্তির বিশেষ সওয়াবের কথা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে-
فَإِذَا جَلَسَ الإِمَامُ طَوَوُا الصُّحُفَ وَجَاءُوا يَسْتَمِعُونَ الذِّكْرَ
অর্থাৎ যখন ইমাম খুৎবা দেওয়ার জন্য বের হোন, তখন ফিরিশতারা তাদের খাতা পত্র গুঠিয়ে বসে যান। তারপর চুপ থেকে ইমামের খুৎবা শুনেন। বুখারী, হাদীস নং- ৩১২২, শায়খ যুহাইর বিন নাসের তাহকীককৃত

খাতা-পত্র গুঠিয়ে ফিরিশতাদের খুৎবা শুনা একথার দলীল যে, খুৎবার সময়ে একমাত্র কাজ হলো খুৎবা শুনা। শুনা ব্যতীত অন্য কোনো আমল সে সময়ে করা যাবেনা। চাই সেটা নামায হোক বা কথা হোক। আর এবিষয়টি একাধিক হাদীসে স্পষ্ট এসেছে। নুবাইশা হুযালী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
اِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ ثُمَّ أَقْبَلَ إِلَى الْمَسْجِدِ لَا يُؤْذِي أَحَدًا فَإِنْ لَمْ يَجِدْ الْإِمَامَ خَرَجَ صَلَّى مَا بَدَا لَهُ وَإِنْ وَجَدَ الْإِمَامَ قَدْ خَرَجَ جَلَسَ فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ حَتَّى يَقْضِيَ الْإِمَامُ جُمُعَتَهُ وَكَلَامَهُ إِنْ لَمْ يُغْفَرْ لَهُ فِي جُمُعَتِهِ تِلْكَ ذُنُوبُهُ كُلُّهَا أَنْ تَكُونَ كَفَّارَةً لِلْجُمُعَةِ الَّتِي قَبْلَهَا
অর্থাৎ মুসলমান যখন জুমার দিনে গোছল করে, এরপর মসজিদে আসে, কাউকে কষ্ট দেয়না, যদি গিয়ে দেখে যে, ইমাম সাহেব এখনো আসেননি, তখন সামর্থ অনুযায়ী নামায আদায় করলো, যদি ইমাম সাহবেকে এমন অবস্থায় পায় যে, তিনি খুৎবার জন্য বের হয়ে গেছেন, তাহলে বসে গভীর মনযোগ সহকারে খুৎবা সহ নামায শেষ করা পর্যন্ত, যদি তার গত সপ্তাহের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া না হয়, তাহলে গত সপ্তাহের গোনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং, ২০৭২১. শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত।
হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম হাইছামী রহ. বলেন-
رواه أحمد ورجاله رجال الصحيح خلا شيخ أحمد وهو ثقة
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদের শায়খ ছাড়া সকলেই সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী। ইমাম আহমদের শায়খও হলেন বিশ^স্ত এবং গ্রহণযোগ্য। মাযমাউয যাওয়ায়িদ, হাদীস নং, ৩০৪০. দারুল ফিকর, বায়রুত।

ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إذا دخل أحدكم المسجد والإمام يخطب على المنبر فلا صلاة ولا كلام حتى يفرغ الإمام
অর্থাৎ যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে এমতাবস্থায় যে, ইমাম সাহেব খুৎবা দিচ্ছেন, তাহলে তখন ইমাম খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত কোনো নামায এবং কথা নেই।
হাদীসটি ইমাম তাবারানী রহ. এর “আল মু’যামুল কাবীর” এর হাওয়ালায় ইমাম হাইছামী “মাযমাউয যাওয়ায়িদ”-এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি উল্লেখ করার পর তিনি বলেন-
رواه الطبراني في الكبير وفيه أيوب بن نهيك وهو متروك ضعفه جماعة وذكره ابن حبان في الثقات وقال : يخطئ
অর্থাৎ হাদীসটি ইমাম তাবারানী হাদীসটি “আল মু’যামুল কাবীর” এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন আইয়ুব বিন নুহাইক। তিনি মাতরুক। তাকে একদল মুহাদ্দিস জয়ীফ বলেছেন। ছিকাহ রাবীদের জীবনী শীর্ষক গ্রন্থ “কিতাবুছ ছিকাত” এর মধ্যে ইবনে হিব্বান তার কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, তিনি ভুল করেন। মাযমাউয যাওয়ায়িদ, হাদীস নং, ৩১২০. দারুল ফিকর, বায়রুত।

এ বর্ণনার একজন রাবী সম্পর্কে যদিও কথা রয়েছে, কিন্তু হাদীসের মর্মকথা পূর্বের উল্লিখিত কুরআনের আয়াত এবং হাদীসের সাথে মিল। এছাড়াও আরো অনেক হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, খুৎবার সময়ে কথা বলার অনুমতি নেই। এমনকি খুৎবা চলাকালিন যদি কেউ তার অপর সাথীকে চুপ থাকার কথা বলে, হাদীসে সেটাকেও অহেতুক কাজ বলা হয়েছে। অথচ ভালো কাজের আদেশ সব সময় ওয়াজিব। কিন্তু এমন ওয়াজিব পালন, যা চুপ থাকাতে বাধা সৃষ্টি করে, খুতবার সময়ে সে ওয়াজিবকেও নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং খুৎবার সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা। কেননা সেটা পড়াতো মুস্তাহাব।

সালাফে সালেহীন এর আমল
কুরআন এবং হাদীসের নুসুস উল্লেখ করার পর এ মাসআলায় সাহাবা এবং তাবেয়ীনদের কিছু আমল উল্লেখ করছি। যাতে করে বিষয়টি ভালোভাবে পরিষ্কার হয়।
* ছা’লাবা বিন আবু মালিক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

أنهم كانوا في زمان عمر بن الخطاب يصلون يوم الجمعة حتى يخرج عمر فإذا خرج عمر وجلس على المنبر وأذن المؤذنون قال ثعلبة جلسنا نتحدث فإذا سكت المؤذنون وقام عمر يخطب أنصتنا فلم يتكلم منا أحد قال بن شهاب فخروج الإمام يقطع الصلاة وكلامه يقطع الكلام
অর্থাৎ আমরা উমর রা. এর যুগে জুমার নামায পড়তাম। উমর রা. এমতাবস্থায় তাশরীফ আনতেন। উমর রা. যখন মিম্বরে বসতেন এবং মুয়াজ্জিন আজান শুরু করত, আমরা তখন বসে বসে কথা বলতাম। মুয়াজ্জিন যখন আজান শেষ করত এবং উমর রা. খুৎবা দেওয়ার জন্য দাড়াতেন, আমরা চুপ হয়ে যেতাম। আমাদের কেউ তখন কথাবার্তা বলত না।
ইবনে শিহাব যুহরী রহ. বলেন, ইমামের বের হওয়া নামাযকে বন্ধ করে দেয় এবং ইমামের খুৎবা শুরু করা কথাকে বন্ধ করে দেয়। মুয়াত্ত¡া মালেক, হাদীস নং, ৩৪৪ শায়খ মুসতাফা আযমী দা.বা. তাহকীককৃত।

ইবনে শিহাব যুহরী রহ. এর এই বক্তব্য তার নিজস্ব নয় , বরং সেটা হাদীস সমর্থিত। এপ্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে আবদিল বার আল মালেকী রহ. এর বক্তব্য দেখুন। তিনি বলেন-
لأن قوله خروج الإمام يقطع الصلاة وكلامه يقطع الكلام خبر عن علم علمه لا عن رأي اجتهده
অর্থাৎ ইবনে শিবাহ যুহরী রহ. এর বক্তব্য হাদীস থেকে চয়নকৃত। তিনি ইজতিহাদ করে আবিষ্কার করেননি। আল ইসতিযকার, ২/২৪ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বায়রুত। প্রথম সংস্করণ।

এছাড়াও তিনি এ মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
فذهب مالك وأبو حنيفة وأصحابهما والثوري والليث بن سعد إلى أن من جاء يوم الجمعة والإمام يخطب ودخل المسجد أن يجلس ولا يركع لحديث بن شهاب هذا وهو سنة وعمل مستفيض في زمن عمر وغيره
অর্থাৎ ইমাম মালেক, আবু হানিফা এবং তার উভয় সঙ্গী, সুফিয়ান ছাওরী, লাইছ বিন সাদ রহ. এর মত হলো, কোনো ব্যক্তি ইমাম সাহেব খুৎবা প্রদানকালিন সময়ে মসজিদে আসলো, সে বসে যাবে। তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়বেনা। তারা দলীল পেশ করেন ইবনে শিহাবের উল্লেখিত হাদীস দ্বারা। এটা হলো সুন্নাত। উমর রা. এবং অন্যান্যদের যুগে ব্যাপক প্রচলিত। আল ইসতিযকার, ২/২৪

ছালাবা রা. এর হাদীস “মূসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা”তেও বর্ণিত হয়েছে। সেখানে শব্দে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে-
أدركت عمر وعثمان فكان الامام إذا خرج يوم الجمعة تركنا الصلاة
অর্থাৎ আমি উমর এবং উসমান রা. এর যুগ পেয়েছি। জুমার দিনে ইমাম যখন বের হতেন, আমরা নামায ছেড়ে দিতাম।. মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস নং, ৫২১৬. শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দা.বা. তাহকীককৃত।

এ দুই হাদীস এবং ইবনে আবদিল বার মালেকী রহ. এর বক্তব্য সামনে রাখুন। উমর রা. এর যুগে ইমাম সাহেব যখন খুৎবার জন্য বের হতেন, সাহাবায়ে কেরাম নামায পড়া ছেড়ে দিতেন। অধিকাংশ বড় বড় সাহাবী তখন ছিলেন জীবিত। সকলেই এবিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন। এরপরও যারা বলবেন যে, হানাফীদের মাযহাব সহীহ হাদীসের বিপরীত, তাদের জন্য করুণা প্রদর্শন ছাড়া আর করার কিছুই নেই।
*সায়িব ইবনে ইয়াযিদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كُنَّا نُصَلِّي فِي زَمَنِ عُمَرَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، فَإِذَا خَرَجَ عُمَرُ، وَجَلَسَ عَلَى الْمِنْبَرِ قَطَعْنَا الصَّلَاةَ، وَكُنَّا نَتَحَدَّثُ وَيُحَدِّثُونَا، وَرُبَّمَا نَسْأَلُ الرَّجُلَ الَّذِي يَلِيهِ عَنْ سُوقِهِ وَمَعَاشِهِ، فَإِذَا سَكَتَ الْمُؤَذِّنُ خَطَبَ، وَلَمْ يَتَكَلَّمُ أَحَدٌ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ،
আমরা উমর রা. এর যুগে জুমার নামায আদায় করতাম। উমর রা. যখন বের হতেন এবং মিম্বরের উপর বসতেন। আমরা নামায পড়া বন্ধ করে দিতাম। কিন্তু পরস্পর কথা বলতাম। কখনো আমরা পাশের লোককে বাজার এবং তার ব্যবসা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। মুয়জ্জিন যখন আজান শেষ করত, তিনি খুৎবা দিতেন। খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত আমরা কথা বলতামনা। নাসবুর রায়াহ, ২/২০৪ শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দা.বা. তাহকীককৃত। হাদীসটি ইমাম যাইলায়ী রহ. ইসহাক বিন রাহওয়াই রহ. এর “মুসনাদ” এর সূত্রে উল্লেখ করেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. “আদ দিরায়া”তে হাদীসের সনদকে উত্তম বলেছেন।

এ হাদীসেও আমরা স্পষ্ট পেলাম যে, উমর রা. যখন খুৎবা দেওয়ার জন্য বের হতেন, সাহাবায়ে কেরাম নামায পড়া বন্ধ করে দিতেন। তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করতেননা।
*প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা রহ. ইবনে আব্বাস এবং ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন-
أَنَّهُمَا كَانَا يَكْرَهَانِ الصَّلاَة وَالْكَلاَمَ بَعْدَ خُرُوجِ الإِمَام.
অর্থাৎ তারা উভয়জন ইমাম সাহেব খুৎবা দেওয়ার জন্য বের হওয়ার পর নামায পড়া এবং কথা বলাকে পছন্দ করতেননা। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস নং, ৫২১৭ শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দা.বা. তাহকীককৃত।

“মূসান্নাফ” এর আরেক বর্ণনায় আলী রা., মুজাহিদ এবং আতা রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে:
أَنَّهُمْ كَرِهُوا الصَّلاَة وَالإِمَام يَخْطُبُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ.
অর্থাৎ তারা সকলেই ইমাম খুৎবা দেওয়ার জন্য বের হওয়ার পর নামায পড়াকে অপছন্দ করতেন। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস নং, ৫২১২.

এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু ঘটনা থেকেও বুঝা যায় যে, খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া যাবেনা। নি¤েœ একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
আবুয যাহিরিয়্যাহ বর্ণনা করেন-
كنا مع عبد الله بن بسر صاحب النبي صلى الله عليه و سلم يوم الجمعة فجاء رجل يتخطى رقاب الناس فقال عبد الله بن بسر جاء رجل يتخطى رقاب الناس يوم الجمعة والنبي صلى الله عليه و سلم يخطب فقال له النبي صلى الله عليه و سلم ” اجلس فقد آذيت ”
অর্থাৎ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী আবদুল্লাহ বিন বুসর রা. এর সাথে জুমার নামায আদায় করছিলাম। এমতাবস্থায় একজন লোক এসে মানুষকে মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তখন আবদুল্লাহ বিন বুসর রা. বললেন,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একজন লোক এমনটা করেছিল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, বসে যাও। তুমি মানুষদের কষ্ট দিচ্ছো! মুসনাদে আহমদ, সহীহ ইবনে হিব্বান,
এ হাদীসকে ইমাম ইবনে আবদিল বার মালেকী রহ. আমাদের মাযহাবের দলীল স্বরুপ উল্লেখ করেছেন। কেননা এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বসার নির্দেশ দিয়েছেন। নামায পড়ার আদেশ দেননি। যদি খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া যেতো, তাহলে অবশ্যই রাসূল তাকে আগে নামায পড়ার নির্দেশ দিতেন। ইবনে আবদিল বার মালেকী বলেন-
لم يأمره بالركوع بل أمره أن يجلس دون أن يركع
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নামাযের আদেশ দেননি, বরং বসে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আল ইসতিযকার, ২/২৫ দারুল কুতুবিল ইলমিয্যাহ, বায়রুত।

ইমাম বুখারী রহ. এর একটি ঘটনা দ্বারাও বিষয়টি বুঝা যায়। আনাছ বিন মালেক রা. বর্ণনা করেন-
أَنَّ رَجُلًا دَخَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ مِنْ بَابٍ كَانَ وِجَاهَ الْمِنْبَرِ وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَائِمٌ يَخْطُبُ فَاسْتَقْبَلَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَائِمًا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلَكَتْ الْمَوَاشِي وَانْقَطَعَتْ السُّبُلُ فَادْعُ اللَّهَ يُغِيثُنَا قَالَ فَرَفَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَيْهِ فَقَالَ اللَّهُمَّ اسْقِنَا اللَّهُمَّ اسْقِنَا اللَّهُمَّ اسْقِنَا قَالَ أَنَسُ وَلَا وَاللَّهِ مَا نَرَى فِي السَّمَاءِ مِنْ سَحَابٍ وَلَا قَزَعَةً وَلَا شَيْئًا وَمَا بَيْنَنَا وَبَيْنَ سَلْعٍ مِنْ بَيْتٍ وَلَا دَارٍ قَالَ فَطَلَعَتْ مِنْ وَرَائِهِ سَحَابَةٌ مِثْلُ التُّرْسِ فَلَمَّا تَوَسَّطَتْ السَّمَاءَ انْتَشَرَتْ ثُمَّ أَمْطَرَتْ قَالَ وَاللَّهِ مَا رَأَيْنَا الشَّمْسَ سِتًّا ثُمَّ دَخَلَ رَجُلٌ مِنْ ذَلِكَ الْبَابِ فِي الْجُمُعَةِ الْمُقْبِلَةِ وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَائِمٌ يَخْطُبُ فَاسْتَقْبَلَهُ قَائِمًا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلَكَتْ الْأَمْوَالُ وَانْقَطَعَتْ السُّبُلُ فَادْعُ اللَّهَ يُمْسِكْهَا قَالَ فَرَفَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَيْهِ ثُمَّ قَالَ اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا اللَّهُمَّ عَلَى الْآكَامِ وَالْجِبَالِ وَالْآجَامِ وَالظِّرَابِ وَالْأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ قَالَ فَانْقَطَعَتْ وَخَرَجْنَا نَمْشِي فِي الشَّمْسِ قَالَ شَرِيكٌ فَسَأَلْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ أَهُوَ الرَّجُلُ الْأَوَّلُ قَالَ لَا أَدْرِي
ঘটনার সারাংশ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লাম একদা জুমার খুৎবা দিচ্ছেলেন। তখন মিম্বরের দিকের দরজা দিয়ে একজন লোক মসজিদে প্রবেশ করলো। এরপর বললো, হে আল্লাহর রাসূল, পশু পাখি মরে যাচ্ছে অনাবৃষ্টিতে। আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুহাত তুলে দোয় করলেন।
আনাছ রা. বলেন, আকাশ তখন একেবারে পরিষ্কার ছিল। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়ার পর হঠাৎ করেই আকাশের রঙ পরিবর্তন হয়ে গেলো এবং মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো।
পরের জুমায় ঐ লোক আবার আসল এবং বললো, হে আল্লাহর রাসূল, সমস্ত সম্পদরাজি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনি আল্লাহর নিকট বৃষ্টি বন্ধের দোয়া করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বৃষ্টি বন্ধের দোয়া করলেন। আল্লাহ বৃষ্টি বন্ধ করে দিলেন। বুখারী, হাদীস নং, ১০১৩. শায়খ যুহাইর বিন নাসের তাহকীককৃত।

এ ঘটনাটিতে ভালো করে লক্ষ করুন। প্রথম দিন যখন ঐ লোক মসজিদে প্রবেশ করে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার নির্দেশ দেননি। যদি খুৎবার সময় তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া সুন্নাত হতো, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অবশ্যই তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার কথা বলতেন।
ইমাম আবু দাউদ রহ. ও এ ধরণের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। জাবের রা. বর্ণনা করেন-
لما استوى رسول الله صلى الله عليه و سلم يوم الجمعة قال ” اجلسوا ” فسمع ذلك ابن مسعود فجلس على باب المسجد فرآه رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال ” تعال يا عبد الله بن مسعود ”
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুৎবা দেওয়ার জন্য আসন গ্রহণ করলেন, তখন বললেন, তোমরা বসো। ইবনে মাসউদ রা. সে কথা শুনে মসজিদের দরজায় বসে গেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দৃশ্য দেখে বললেন, “ইবনে মাসউদ, তুমি আসো”। আবু দাউদ, হাদীস নং, ১০৯১ শায়খ মুহি উদ্দীন আবদুল হামীদ তাহকীককৃত।

এ হাদীসেও লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, ইবনে মাসউদ রা. যখন মসজিদে প্রবেশ করছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষনা শুনেই মসজিদে দরজায় বসে পড়েন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে তাকে সামনে আসতে বললেন। যদি খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া সুন্নাত হতো, তাহলে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তাকে আগে সুন্নাত পড়ার কথা বলতেন।
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে, খুৎবার সময় তাহিয়্যাতুল মসজিদ না ব্যাপারে যারা বলে থাকেন যে, এর পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই, তাদের বক্তব্য মারাত্মক ভুল। এছাড়া এমনটাতো শুধূ ইমাম আবু হানিফার মাযহাব নয়; বরং আরো অনেক ইমাম এমন বক্তব্য প্রদান করেছেন। যেমনটা ইবনে আবদিল বার মালেকী রহ. উল্লেখ করেছেন।

সুলাইক গাতফানী রা. এর ঘটনার ব্যাখ্যা
ইমাম শাফেয়ী রহ. সহ আরো যারা খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া সুন্নাত মনে করেন, তারা সুলাইক গাতফানী রা. এর ঘটনা দ্বারা দলীল পেশ করেন। প্রথমে ঘটনাটি উল্লেখ করছি।
عن جابر أنه قال جاء سليك الغطفاني يوم الجمعة ورسول الله صلى الله عليه و سلم قاعد على المنبر فقعد سليك قبل أن يصلي فقال له النبي صلى الله عليه و سلم أركعت ركعتين قال لا قال قم فاركعهما
জাবের রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে বসা, এমতাবস্থায় সুলাইক গাতফানী রা. আগমন করলেন। সুলাইক নামায না পড়ে বসে গেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “দু রাকাত নামায পড়েছ? তিনি বললেনন: না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দাড়িয়ে দু রাকাত নামায আদায় কর”। মুসলিম, ৮৭৫ শায়খ ফুয়াদ আবদুল বাকী তাহকীককৃত। মুসনাদে আহমদ, ১৪৪০৫ শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫২০৫ শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দা.বা, তাহকীককৃত।

এঘটনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে খুৎবা চলাকালিন সময়ে দু রাকাত নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর দ্বারা খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ দু রাকাত পড়া সুন্নাত প্রমাণিত হয়। এ হাদীস সম্পর্কে নি¤েœ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আল্লামা ইউসুফ লুধিয়ানভী রহ. প্রথমে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, “প্রথমত: উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, কুরআনে খুৎবাকে চুপচাপ শুনাকে ফরয সাব্যস্থ করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অগণিত হাদীস দ্বারা বিষয়টি শক্তিশালি হয়। খুলাফায়ে রাশেদীন, অধিকাংশ সাহাবা, তাবেয়ী কুরআন এবং হাদীসের নুসূসগুলো সামনে রেখে খুৎবা চলাকালিন সময়ে নামায পড়ার এবং কথা বলার প্রবক্তা ছিলেননা। আর একথা স্পষ্ট যে, সুলাইক গাতফানী রা. এর ঘটনা তাদের জানা ছিল। কেননা তাদের বর্ণনার কারণে আমরা রেওয়ায়াত সম্পর্কে জানতে পেরেছি। বড় বড় সাহাবারাতো সে ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী ছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল জুমার নামাযের ভরা মজলিসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুলাইক গাতফানীকে উদ্দেশ্য করে যা বলেছিলেন, সেটা তারা অবশ্যই শুনেছেন। এখানে একথা বলার অবকাশ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা সম্পর্কে তাদের জানা নেই।
আর একথাও বলার অবকাশ নেই যে, তারা কোনো ওজরের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত ছেড়ে দিযেছেন এবং সুন্নাত বিরোধি কথা বলেছেন। যদি এ সম্ভাবনা থাকে, তাহলে খুলাফায়ে রাশেদীন এবং সাহাবাদের উপর বিশ^াসে চিড় ধরবে। এ চিন্তা রাফেজীর আসতে পারে, কোনো সহীহ আকীদার অনুসারী ব্যক্তির আসতে পারেনা। আর একথাও সত্য যে, তারা আমাদের চেয়ে সুন্নতের বেশি অনুসারী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুলাইক গাতফানীকে নির্দেশ দিয়েছেন, যদি সে নির্দেশ সকলের জন্য ব্যাপক হত, তাহলে একথা অসম্ভব সকল সাহাবা বিশেষত খুলাফায়ে রাশেদীন সে নির্দেশের উপর আমল করবেননা।
দ্বিতীয়ত: পূর্বের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হলো যে, সাহাবায়ে কেরাম যে এ হাদীসের উপর আমল করেননি, তার একটি সুস্পষ্ট সঠিক ব্যাখ্যা তাদের কাছে ছিল। কি জবাব ছিল তাদের নিকট? এর জবাব দেওয়া শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়, বরং সে সকল লোকের, যারা সাহাবীদের ন্যায়পরায়ণতায় বিশ^াসী। ইখতেলাফে উম্মাত আওর সিরাতে মুসতাকিম, পৃষ্ঠা নং- ৩৯৫-৩৯৬
এবার আসুন জবাব উল্লেখ করি।

প্রথম জবাব
সুলাইক গাতফানীকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার নির্দেশ দেননি। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে বসেছিলেন, তখন সুলাইক গাতফানী আসলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার নির্দেশ দেন।
ইমামা নাসায়ী রহ.ও সুলাইক গাতফানী এর ঘটনা এনেছেন। কিন্তু তিনি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন এভাবে- الصلاة قبل الخطبة
এরপর তিনি সুলাইক গাতফানী রা. এর হাদীস এনছেন। হাদীসের মতন হলোÑ
عن جابر قال جاء سليك الغطفاني ورسول الله صلى الله عليه و سلم قاعد على المنبر فقعد سليك قبل أن يصلي فقال له النبي صلى الله عليه و سلم أركعت ركعتين قال لا قال قم فاركعهما
অর্থাৎ সুলাইক গাতফনী রা. এমতাবস্থায় মসজিদে আসলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে বসা ছিলেন। সুলাইক নামায পড়ার পূর্বে বসে যান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি দুরাকাত পড়েছো? তিনি বললেন, না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দু রাকাত পড়ে নাও। আস সুননানুল কুবরা, নাসায়ী, হাদীস নং- ৪৯৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বায়রুত, প্রথম সংস্করণ।
এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম নাসায়ী রহ. পরিচ্ছেদের নামকরণ করেছেন খুৎবার পূর্বের নামায সম্পর্কে। এরপর সুলাইক গাতফানী রা. এর হাদীস এনেছেন। এর দ্বারা বুঝা গেল যে, তার মতে সুলাইক গাতফানী রা. এর ঘটনা খুৎবা শুরু হওয়ার পূর্বে সংঘঠিত হয়েছে। খুৎবা চলাকালিন নয়। সুতরাং এ হাদীস দ্বারা খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া প্রমাণিত হয়না।

দ্বিতীয় জবাব
সুলাইক গাতফানীর ঘটনাটি হাদীসের কিতাবাদিতে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। পূর্বের রেওয়ায়াত অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা শুরুর পূর্বে সুলাইক গাতফানী এসেছিলেন এবং রাসূল তাকে নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার কিছু রেওয়ায়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি খুৎবা চলাকালিন সময়ে এসেছিলেন। কিন্তু নামায পড়ার সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা বন্ধ রেখেছিলেন। আনাছ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
دخل رجل من قيس ورسول الله صلى الله عليه و سلم يخطب فقال النبي صلى الله عليه و سلم قم فاركع ركعتين وأمسك عن الخطبة حتى فرغ من صلاته
মসজিদের প্রান্ত দিয়ে এক লোক মসজিদে প্রবেশ করল, এমতাবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দিচ্ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি দাড়িয়ে দুরাকাত নামায পড়। তিনি খুৎবা প্রদান থেকে বিরত থাকেন ঐ লোক নামায শেষ করা পর্যন্ত। সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং ১৬৩৭, মাকতাবাতুশ শামেলা।
এহাদীসে আমরা স্পষ্ট পেলাম যে, সুলাইক গাতফানী খুৎবা শুরুর আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিম্বরে বসা ছিলেন, তখন এসেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করা পর্যন্ত খুৎবা বন্ধ রেখেছিলেন। সুতরাং সুলাইক গাতফানী রা. এর ঘটনা দ্বারা খুৎবা চলাকালিন তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া সুন্নাত প্রমাণিত হয়না। কারণ তার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা বন্ধ রেখেছিলেন বিশেষ হেকমতে। প্রত্যেকের জন্যতো আর খুৎবা বন্ধ করা যাবেনা। এভাবে প্রত্যেকের জন্য কুতবা বন্ধ করলে ইমাম সাহেবের খুৎবা শেষ করতেই লেগে যাবে দীর্ঘ সময়।

৩য় জবাব
ঘটনাটি সুলাইক গাতফানি রা. এর সাথে নির্দিষ্ট। বিশেষ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। বাকী অন্য কারো জন্য অনুমতি নেই। সহীহ ইবনে হিব্বানের একটি বর্ণনা দ্বারা বিষয়ট স্পষ্ট হয়। জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
دخل سليك الغطفاني المسجد يوم الجمعة ورسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب الناس فقال له رسول الله صلى الله عليه وسلم اركع ركعتين ولا تعودن لمثل هذا فركعهما ثم جلس
অর্থাৎ সুলাইক গাতফানী রা. জুমার দিনে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার খুৎবা দিচ্ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি দু রাকাত নামায পড়। তবে আর কখনো এর পূণরাবৃত্তি করবেনা। এরপর তিনি দুরাকাত নামায পড়লেন। তারপর বসলেন। সহীহ ইবনে হিব্বান ২৫০৪, শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত।
‘সুনানে দারা কুতনী” তে রেয়ায়াতটি রয়েছেÑ
دَخَلَ سُلَيْكٌ الْغَطَفَانِىُّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” ارْكَعْ رَكْعَتَيْنِ وَلاَ تَعُدْ لِمِثْلِ هَذَا.)). قَالَ فَرَكَعَهُمَا ثُمَّ جَلَسَ .
অর্থাৎ সুলাইক গাতফানী রা. জুমার দিন মসজিদে প্রবেশ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি দু রাকাত নামায পড়। তবে সামনে আর পড়বে না। সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১৬৩৯

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ করে সুলাইক গাতফানী রা.কে এক দিনের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। তারপর আবার খুৎবার সময় সুন্নাত পড়তে বারণ করেছেন। সুতরাং ঘটনাটি তার একক বৈশিষ্ট। এর দ্বারা খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া সুন্নাত প্রমাণিত হয় না।
আবার অনেকে এ ব্যাখ্যাও দাড় করিয়েছেন যে, সুলাইক গাতফানী রা. এর ঘটনা কুরআনের পূর্বোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার আগে। তখন খুৎবা চলাকালিন তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ার অবকাশ ছিল। এরপর কুরআনের আয়াত নাজিল হলে তা রহিত হয়ে যায়। এজন্য খুলাফায়ে রাশেদীন এবং সকল সাহাবার আমল ছিল তারা ইমাম সাহেব খুৎবা দেওয়ার জন্য যখন বের হতেন, তখন নামায পড়া বন্ধ করে দিতেন এবং গভীর মনযোগ সহকারে খুৎবা শুনতেন।
আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল। আশা করি দীর্ঘ আলোচনার পর পাঠকের নিকট একথা স্পষ্ট হয়েছে যে, যারা বলে খুৎবা চলাকালিন সময়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ না পড়ার পক্ষে কোনো দলীল নেই, এটা ইমামদের ইজতিহাদ, তাদের কথা পরিষ্কার ভুল। এছাড়া এটা শুধু ইমাম আবু হানিফার একক মাযহাব নয়, বরং আরো অনেক ইমামের মাযহাব। আর সকল সাহাবার আমল ছিল এমনই। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন!

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *