সহীহ হাদীসের আলোকে শরে বারাত।(১)
শবে বারাত নিয়ে আমাদের সমাজে বাড়াবাড়ি, ছাড়াছাড়ি দুটিই চলছে।ছোট বেলায় গ্রামে দেখতাম শবে বারাত উপলক্ষে দেখতাম উদ্ভূট কিছু আমল। যার অনেকটি হল বেদয়াত। শবে বারাত উপলক্ষে সহীহ হাদীসে এমন কোন আমল বর্ণিত হয়নি। শবে বারাত উপলক্ষে প্রত্যেক বাড়ী থেকে শিরনী বিতরণ, মাগরিব পরে মিছিল, আগরবাতি জ্বালানো, কবরস্থানে ভীড় করাসহ আরো অনেক কিছু। বর্তমানে সমাজে আরো কছিু ভাই দাত গজিয়েছেন, যাদের কথা হল শবে বারাতের মর্যাদা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের অনেক পরে সূফীরা সৃষ্টি করেছেন!ফেইসবুকে আমার অনেক ভাই বেরাদর রয়েছেন, শবে বারাতকে ভিত্তিহীন প্রমাণিত করতে আধাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন! প্রতিদিন একাধিক পোষ্ট দেখতে হয়, যেখানে শবে বারাত নিয়ে হাসি, মশকারী করা হচ্ছে! শবে বারাতের নফল ইবাদত নিয়ে লেখার ইচ্ছা আদৌ ছিলনা। এছাড়া আমার এনেক মুহতারাম ভাইগণ এবিষয়ে লিখেছেন। তারপারও একটি লেখা আগেই সময় নিয়ে প্রস্তুত করেছিলাম। তাই আপনাদের খেদমতে পশে করলাম। আজকের পর্বে শুধু সহীহ হাদীসের আলোকে শবে বারাতের মর্যদা নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
*মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن )
আল্লাহ তায়ালা শা’বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে সৃষ্টিকূলের দিকে রহমতের নজরে থাকান। মুশরি এবং বিদ্ধেষ পোষণকারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন। ( সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং, ৫৬৬৫. শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত। আর রিসালাতুল আলাময়্যিাহ, প্রথম সংস্করণ. আল মু’যামুল আওসাত, ৬৭৭৬. দারুল হারামাইন, কাহেরা. আল মু’যামুল কাবীর, ২১৫. মাকতাবাতুল উলূমি ওয়াল হিকাম, ২য় সঙস্করণ. শুয়াবুল ঈমান, ৩৮৩৩. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ)
হাদীস সম্পর্কে ইমাম হাইছামী রহঃ বলেন:
رواه الطبراني في الكبير والأوسط ورجالهما ثقات
অর্থাৎ, হাদীসটি ইমাম তাবারানী রহঃ ‘আল মু’যামুল কাবীর’ এবং ‘আল মু’যামুল আওসাত’ এ বর্ণনা করেন। বর্ণনা সকলেই ছিকাহ। ( মাযমাউয যাওয়ায়িদ, ১২৮৬০. দারুল ফিকর)
হাদীসটি বর্ণনার পর ইমাম বায়হাকী রহঃ বলেন:
و قد روينا هذا من وجه و في ذلك دلالة على أن للحديث أصلا من حديث مكحول
হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এটা দালালাত করে , মাকহুল থেকে হাদীসের ভিত্তি রয়েছে।
‘সহীহ ইবনে হিব্বানের মুহাক্কিক শায়খ শুয়াইব আরনাউত হাদীসটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
حديث صحيح بشواهده.رجاله ثقات إلا أن فيه انقطاعا. مكحول لم يلق مالك بن يخامر.
অর্থাৎ, হাদীসটি সহীহ তার পক্ষে আরো অনেকগুরো হাদীস বর্ণিত হওয়ায়। বর্ণনাকারী সকলেই ছিকাহ। তবে সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। মাকহুল মালেক ইবনে উখামীর সাথে সাক্ষাত করেননি।
মাকহুল, মালেক ইবনে উখামীরের সাথে সাক্ষাৎ প্রমাণিত কিনা? সেটা শাস্ত্রীয় আলোচনা। এ ব্যাপারে ইমাম যাহাবী রহঃ লিখিত ‘সিয়ারু আ’লামিন নুবালা,৫/১৫৬) মাকহুলের জীবনি দেখা যেতে পারে।যদি সাক্ষাৎ প্রমাণিত নাও হয়, তারপরও শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহঃ বলেন:
و لولا ذلك لكان الإسناد حسنا , فإن رجاله موثوقون
যদি বাস্তবতা এমন হয়, তারপরও সনদ হাসান পর্যায়ের। কারণ বর্ণনাকারী সকলেই ছিকাহ।(সিলসিলাতুস সাহীহা, ১১৪৪)
শবে বারাতের মর্যাদা প্রমাণিত হওয়ার জন্য মুয়াজ বিন জাবালের একটি সহীহ হাদীসই যথেষ্ট। কারণ একটি বিষয়ে যদি মাত্র একটি সহীহ হাদীস পাওয়া যায়, সে বিষয়ের মর্যাদা প্রমাণিত হয়ে যায়। আর শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহ বান্দাদের দিকে রহমতের নজরে থাকান এবং মুশরিক ও বিদ্ধেষপোষণকারী ব্যতিত সকলকে মাফ করে দেন, এ মর্মে আরো অকেগুলো হাদীস রয়েছে। নিম্নে আরো কয়েকটি উল্লেখ করছি।
*আবু বকর সিদ্দীক রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
عَنِ الْقَاسِمِ بْنِ مُحَمَّدٍ ، عَنْ أَبِيهِ أَوْ عَمِّهِ ، عَنْ أَبِي بَكْرٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : إِذَا كَانَ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ يَنْزِلُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا ، فَيَغْفِرُ لِعِبَادِهِ إِلاَّ مَا كَانَ مِنْ مُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ لأَخِيهِ
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে সৃষ্টিকূলের দিকে রহমতের নজরে থাকান। মুশরিক এবং বিদ্ধেষপোষণকারী ব্যতিত সকলকে মাফ করে দেন।( মুসনাদুল বাযযার,হাদীস নং,৮০)
বাযযার রহঃ হাদীসটি বর্ণনা্ করার পর বলেন:
وَهَذَا الْحَدِيثُ لاَ نَعْلَمُهُ يُرْوَى عَنْ أَبِي بَكْرٍ إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ ، وَقَدْ رُوِيَ عَنْ غَيْرِ أَبِي بَكْرٍ ، وَأَعْلَى مَنْ رَوَاهُ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَبُو بَكْرٍ وَإِنْ كَانَ فِي إِسْنَادِهِ شَيْءٌ فَجَلالَةُ أَبِي بَكْرٍ تُحَسِّنُهُ ، وَعَبْدُ الْمَلِكِ بْنُ عَبْدِ الْمَلِكِ لَيْسَ بِمَعْرُوفٍ ، وَقَدْ رَوَى هَذَا الْحَدِيثَ أَهْلُ الْعِلْمِ وَنَقَلُوهُ وَاحْتَمَلُوهُ فَذَكَرْنَاهُ لِذَلِكَ
অর্থাৎ, আমার জানা মতে আবু বকর রাঃ থেকে হাদীসটি এ সনদ ছাড়া অন্য কোন সনদে বর্ণিত হয়নি। আবু বকর ছাড়া আরো অনেক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। আবু বকর রাঃ এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসের সনদে যদিও সমস্যা রয়েছে, কিন্তু আবু বকর রাঃ এর ব্যক্তিত্বের কারণে হাদীসটি হাসান পর্যায়ের।
ইমাম মুনযীরি রহঃ বলেন:
ورواه والبزار والبيهقي من حديث أبي بكر الصديق رضي الله عنه بنحوه بإسناد لا بأس به
অর্থাৎ, আবু বকর রাঃ এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি ইমাম বাযযার এবং বায়হাকী বর্ণনা করেছেন্ এমন সনদে, যে সনদে কোন সমস্যা নেই। ( আত তারগীব ওয়াত তারহীব, ৪১৯০. দারূল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রথম সংস্করণ)
লা মাযহাবী আলেম মাওলানা আবদুর রহমান মুবারকপুরীও ইমাম মুনযীরির বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন:
(وفي الباب عن أبي بكرالصديق) أخرجه البزار والبيهقي بإسناد لا بأس به كذا في الترغيب
والترهيب للمنذري في باب الترهيب من التهاجر
(তুহফাতুল আহওয়াযী, ৬/৪৬৬. মাকতাবাতুশ শামেলা)
ইমাম হাইছামী রহঃ বলেন:
رواه البزار وفيه عبد الملك بن عبد الملك ذكره ابن أبي حاتم في الجرح والتعديل ولم يضعفه وبقية رجاله ثقات
অর্থাৎ, হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন আবদুল মালিক বিন আবদুল মালেক। ইবনে আবি হাতিম ‘আল জারহু ওয়াত তা’দীল’ কিতাবে তার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাকে দুর্বল বলেননি। এছাড়া বাকী বর্ণনাকারী সকলেই ছিকাহ।(মাযমাউয যাওয়ায়িদ, হাদীস নং, ১২৯৫৭)
গ্রহণযোগ্য দুটি হাদীস উল্লেখ করলাম। এ মর্মে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। এ সম্পর্কে এখন পাঠকের সামনে শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানীর বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি বলেন:
حديث صحيح ، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذ
ابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة
و أبي بكر الصديق و عوف ابن مالك و عائشة
অর্থাৎ,শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবগত রাতের পফযীলত সংক্রান্ত পূর্বোক্ত হাদীসটি সহীহ। সাহাবায়ে কেরামের এক জামাত থেকে বিভিন্ন সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। যার একটি অপরটিকে শক্তিশালি করে। তারা হলেন, মুয়াজ বিন জাবাল, আবু ছা’লাবা আল খুশানি, আবদুল্লাহ বিন আমর, আবু মুসা আসআরী, আবু হুরায়রা, আবু বকর, আওফ বি মালেক এবং আয়েশা রাঃ।( সিলসিলাতুস সাহীহা, হাদীস নং, ১০৪৪)
আলবানী মরহুম যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাদের অধিকাংশ থেকে হাদীসটি হাসান পর্যায়ের সনদে বর্ণিত হয়েছে।
এখন আপনি বলুন, শবে বারাত উপলক্ষে সমাজে প্রচলিত কিছু আপত্তিকর আমলের কারণে যদি আপনি বলে দেন, শবে বারাত বলতে কিছুই নেই, তার সূফিদের সৃষ্টি, তাহলে আপনি কতগুলো সহীহ হাদীস অস্বীকার করলেন?