ভিক্ষা বনাম ইসলাম, একটি পর্যালোচনা
মুসলামানদের মাঝে ভিক্ষাবৃত্তি করা মহামারির আকার ধারণ করেছে। যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ, মহিলা সকলেই ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা বানিয়ে নিয়েছে। এজন্য ভিক্ষাবৃত্তির মাসআলাটি নিয়ে আলোকপাত করছি। হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ مِنْهُ أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ
যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য অন্যের কাছে চাইলো, সে নিজের জন্য জাহান্নামের আগুনের টুকরো চাইলো। সুতরাং যার ইচ্ছা কম চাও আর যার ইচ্ছা বেশি চাও। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৭১৬৩ শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত কাবীসা রা. কে বলেছিলেন, তিন প্রকারের লোকদের জন্য ভিক্ষা করা জায়েয।
প্রথমত: যে ব্যক্তি কোন কারণে অন্যের সম্পদ জামানত হিসাবে রেখেছিলো। সে সে উক্ত সম্পদ আদায়ের জন্য চাইতে পারে।
দ্বিতীয়ত: এমন ব্যক্তি যার সমস্ত সম্পদ কোন ঘটনার কারণে ধ্বংশ হয়ে গেছে। তাঁর জন্য জীবন-যাপন পরিমাণ ভিক্ষা করা জায়েয আছে।
তৃতীয়ত: এমন ব্যক্তি যার আর্থিক অবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ের শোচনীয়তার দিকে। তাঁর জন্য জীবনধারণ পরিমাণ চাওয়া জায়েয আছে।
এই তিন প্রকারের লোক ছাড়া কারো জন্য ভিক্ষা করা জায়েয নেই। অপর আরেকটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দুই প্রকারের লোকের জন্য ভিক্ষা করা হারাম। ধনী এবং কর্মক্ষম। তবে যে ব্যক্তি দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে, তার জন্য জীবনধারণ পরিমাণ ভিক্ষা জায়েয আছে। মাল বৃদ্ধির জন্য যে ভিক্ষা করবে, কিয়ামতের দিন তাঁর চেহারা বিকৃত করে দেওয়া হবে।
ইবনে আব্বাস রা, বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি প্রয়োজন থাকা সত্বেও লোকদের থেকে লুকিয়ে রাখলো, আল্লাহ তাকে রিযিক এবং হালাল সম্পদ প্রদান করবেন।
অপর আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
مَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَسْأَلُ النَّاسَ حَتَّى يَأْتِيَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَيْسَ فِي وَجْهِهِ مُزْعَةُ لَحْمٍ
অর্থাৎ যে মানুষের নিকট কোন কিছু চাইবে, কেয়মাতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তাঁর চেহারায় গোশত থাকবেনা। বুখারী, হাদীস নং ১৪৭৪, শায়খ যুহাইর বিন নাসের তাহকীককৃত।
অপর আরেকটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে: “যে ব্যক্তি কারো কাছে চাওয়া শুরু করবে, দুনিয়া আখেরাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর জন্য দারিদ্রতার দরজা খুলে দিবেন।
আরেকটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ নিজের কোমরে রশি বেধে সামানা নিয়ে বিক্রিকারী ঐ ব্যক্তির চেয়ে উত্তম, যে ভিক্ষাবৃত্তি করে।”
শায়খুল হাদীস জাকারিয়া রহ. ‘ফাযায়েলে সাদাকাত’-এর মধ্যে এ সংক্রান্ত হাদীস একত্রিত করে দিয়েছেন।
ইমাম গাজালী রহ. বলেন: “ভিক্ষাবৃত্তি অনেক হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু হাদীস দ্বারা অনুমতিও বুঝা যায়। এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা হলো, স্বতন্ত্রভাবে ভিক্ষাবৃত্তি করা হারাম। কিন্তু অপারগতা অথবা অপারগতার নিকটবর্তী অবস্থা হলে জায়েয আছে। যদি অপারগতা অথবা তাঁর নিকটবর্তী না হয়, তাহলে ভিক্ষাবৃত্তি হারাম। হারাম হওয়ার কারণ হলো: কারো কাছে চাওয়া তিন অবস্থা থেকে খালি নয়।
প্রথমত: আল্লাহর ব্যাপারে অভিযোগ করা। তিনি নিয়ামত কম দিয়েছেন। তিনি কষ্টে ফেলেছেন।
দ্বিতীয়ত: ভিক্ষুক নিজেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে নত করে। অথচ এটা মুমিনের শানের পরিপন্থি।
তৃতীয়ত: এরদ্বারা অধিকাংশ সময় মানুষের কষ্ট দেওয়া হয়। কেননা অনেক সময় যাদের কাছে চাওয়া হয়, তারা অসন্তুষ্ট হয়। কেউ কেউ লজ্জিত হয়ে কিছু প্রদান করে। ইহইয়াউ উলূমিদ দ্বীন, ২/৩২১
আল্লামা মুরতাজা হাসান যাবেদী রহ. বলেন: “এ সমস্ত শাস্তির কথা হলো নিজের ব্যাপারে চাওয়ার ব্যাপারে। যদি কেউ অন্য কারো জন্য চায়, তাহলে সেটা এর মধ্যে শামিল নয়। ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন শরহে ইহয়ায়ি উলূমিদ দ্বীন ২/৩২১
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন-
“من كان عنده قوت يوم لايحل له السؤال لقوله عليه السلام: مَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَسْأَلُ النَّاسَ حَتَّى يَأْتِيَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَيْسَ فِي وَجْهِهِ مُزْعَةُ لَحْمٍ.ولأنه إذلال نفسه من غير ضرورة وإنه لايحل لمؤمن أن يذل نفسه”
অর্থাৎ যার কাছে একদিনের খাবার আছে, তাঁর জন্য অন্য কারো নিকট চাওয়া জায়েয নেই। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে মানুষের নিকট কোন কিছু চাইবে, কেয়মাতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তাঁর চেহারায় গোশত থাকবেনা। কেননা ভিক্ষা দ্বারা প্রয়োজন ছাড়া অন্যের কাছে নিজেকে নত করতে হয়। আর কোন মুসলমানের জন্য অন্যের কাছে নত হওয়া জায়েয নেই।
এ সমস্ত হাদীস এবং ফুকাহাদের বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হলো, কারো কাছে চাওয়া হারাম। অপারগতার সময় চাওয়া জায়েয আছে। বরং কিছু সময় চাওয়া জরুরী।
প্রয়োজণ পরিমাণের সীমারেখা হলো, কারো কাছে একদিনের খাবার থাকলে তার জন্য কারো কাছে চাওয়া জায়েয নেই। সুস্থ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি অন্য কারো নিকট চাওয়া জায়েয নেই। নিজের জন্য চাওয়া নিষেধ। কিন্তু অন্যের জন্য চাওয়ার অনুমতি আছে। ঝণ এবং অপরগতার সময় প্রয়োজন মাফিক চাওয়া জায়েয আছে। কোনো কারণ ছাড়া চাওয়া হারাম।
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন-
“নাবালেগ ছেলে-মেয়ের তারবিয়ত মাতা-পিতা এবং অভিভাবকের উপর ওয়াজিব। ছেলে-মেয়েদেরকে প্রয়োজন ছাড়া উপার্জনে লাগানো তাঁদের হক নষ্ট করার নামান্তর। আর তাঁদের দিয়ে ভিক্ষা করানো পরিস্কার হারাম। এমনিভাবে মহিলাদের খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা পুরুষের জন্য জরুরী। মহিলাদের জন্য ভিক্ষা করা হারাম এবং সমাজেও মানুষ খারাপ মনে করে।
জেনে রাখা ভালো, যে ব্যক্তি বাস্তবেই মুখাপেক্ষী অথবা দরিদ্র, মাযুর অথবা অপারগ, যে আসলেই আপনার অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য, তাকে দান করবেন। কেননা প্রয়োজনের সময় মানুষের জন্য চাওয়া জায়েয আছে। কিন্তু পেশাদার ফকীর এবং সুস্থ মানুষের জন্য চাওয়া হারাম। তাঁদেরকে দেওয়াও হারাম। কেননা তাকে দেওয়া মানে গুনাহের কাজে সাহায্য চাওয়া। হযরত খালিদ বিন আলী আল জুহানী রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ بَلَغَهُ مَعْرُوفٌ مِنْ أَخِيهِ مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ ، وَلاَ إِشْرَافٍ فَلْيَقْبَلْهُ ، وَلاَ يَرُدُّهُ ، فَإِنَّمَا هُوَ رِزْقٌ سَاقَهُ الله إِلَيْهِ.
অর্থাৎ যদি চাওয়া ব্যতিত তোমার কোন ভাই তোমাকে কোন কিছু পৌঁছায়, তাহলে তা ফিরিয়ে না দিয়ে গ্রহণ করো। কেননা এটা রিযিক আল্লাহ তোমাকে দান করেছেন। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৭৯৩৬, শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকীককৃত।
এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস রয়েছে। যদি চাওয়া ছাড়া কেউ কাউকে হালাল মাল প্রদান করে, তাহলে তা ফিরিয়ে দেয়া নিয়ামতের অস্বীকৃতি। এজন্য অধিকাংশ নবী ও রাসূল তাঁদের স্বভাব বিরোধি হওয়া সত্তে¡ও হাদিয়া কবুল করতেন।