“আমলে মুতাওয়ারাছ”,  লা মাজহাবিদের একটি মারাত্মক বিচ্যূতি

“আমলে মুতাওয়ারাছ”,  লা মাজহাবিদের একটি মারাত্মক বিচ্যূতি

আমলে মুতাওয়ারিছ’ কী কেন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে যদি কেউ বিস্তারিত পড়তে চান, তাহলে এ বিষয়ে লিখিত আল্লামা হায়দার হাসান খান টুনকীর রিসালাটি পড়তে পারেন। রিসালাটি আল্লামা আবদুর রশীদ নুমানী রহ. লিখিত “আল ইমাম ইবনু মাজাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনান” এর টিকায় শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. যুক্ত করে দিয়েছেন। সেখানে আমলে মুতাওয়ারিছের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সংক্ষেপে করা হয়েছে। আগ্রহ পাঠক উক্ত বইয়ের ৮৬-৯১ নং পৃষ্টা অধ্যয়ন করতে পারেন। এছাড়া বাংলাদেশের গর্ব আল্লামা আবদুল মালেক দা. বা. লিখিত “উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পন্থা” গ্রন্থের (১৬৪- ১৬৬ নং পৃষ্টায়) এবিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়ের প্রয়োজনিয়তা অনুভব করে এখানে পুরো আলোচনাটি নকল করা হল:-

“শরীয়তের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় দলীল হল কুরআন কারীম। এরপর সুন্নাহর স্থান। কিন্তু সুন্নাহের ব্যাপারে কতিপয় মানুষের এই ধারণা যে, যেসব হাদীস সুস্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা বা কাজ হিসাবে সহীহ বর্ণনা-পরম্পরায় এসেছে শুধু তাই সুন্নাহ। এই ধারণা ঠিক নয়। সুন্নাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও নির্দেশনাবলির নাম। এই শিক্ষা ও নির্দেশনা আমাদের কাছে সাধারণত মৌখিক বর্ণনা-সূত্রে পৌঁছে থাকে এবং সাধারণ পরিভাষায় এসব মৌখিক বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত রেওয়ায়েতগুলোকে ‘হাদীস’ বলা হয়। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা আমাদের কাছে মৌখিক বর্ণনার স্থলে কর্মের ধারাবাহিকতায় পৌঁছায়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজী থেকে কর্মের মাধ্যমে তা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের নিকট থেকে তাবেয়ীনগণ গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরি তার পূর্বসূরি থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে নবীজীর সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করেন। নবী- শিক্ষার এই প্রকারটিকে পরিভাষায় ‘আমলে মুতাওয়ারাস’ বা সুন্নতে মুতাওয়ারাসা বলে।

নবী-শিক্ষা ও নবী- নির্দেশনার অনেক বিষয় এই পথেই পরবর্তীদের হাতে পৌঁছেছে। এসব শিক্ষা- নির্দেশনা যদি মৌখিক বর্ণনাসমূহের মধ্যেও তালাশ করা হয় তাহলে অনেক সময় এমন হয় যে, হয়ত এব্যাপারে কোনো মৌখিক বর্ণনা পাওয়া যায়না অথবা পাওয়া গেলেও সনদের দিক থেকে তা যয়ীফ। এখানে এসে স্বল্প-জ্ঞান কিংবা স্বল্প- বুঝের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। তারা যখন বিশুদ্ধ মৌখিক বর্ণনাসূত্রে বিষয়টি খুঁজে পায়না তো নবীজীর এই শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বসে। অথচ মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালি সূত্র তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে বিষয়টি সংরক্ষিত।
তেমনি নবী- শিক্ষার একটি অংশ হল যা আমাদের কাছে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা- নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত আছে। বিষয়টি একটু খুলে বলি। সাহাবায়ে কেরামের অনেক নির্দেশনা এমন আছে যার ভিত্তি শরীয়তসম্মত কিয়াস ও ইজতিহাদ। এগুলো শরীয়তের দলীল হিসাবে স্বীকৃত। আবার তাদের কিছু নির্দেশনা ও কিছু ফতোয়া এমন আছে যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো কথা বা কাজ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্যকে শিখানোর সময় এর উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেননা প্রেক্ষাপট থেকে একথা স্পষ্ট ছিল যে, তাঁরা নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনার ভিত্তিতেই তা শিক্ষা দিচ্ছেন।

এখানে বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম যুহরী রহ. এর একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সালেহ ইবনে কায়সান বলেন, আমি ও ইবনে শিহাব (যুহরী) একসঙ্গে ইলম অন্বেষা শুরু করি। প্রথমে আমরা মনস্থ করি যে, সুন্নতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লিখব। এরপর আমরা যত হাদীসে রাসূল শুনেছি তা লিপিবদ্ধ করি। এরপর আমরা বলি (আলোচনা করি) যে, সাহাবীদের আছরও লিপিবদ্ধ করব। তখন আমি বলি, না আমি লিখব না। এগুলো ‘সুন্নাহ’ নয়। এরপর তিনি লিখেছেন, আমি লেখিনি। ফলে তিনি সফল হয়েছেন আর আমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ১১/২৫৮-২৫৯, বাবু কিতাবিল ইলম, বর্ণনা নং, ২০৪৮৭

এ-জন্য দ্বীনের ইমামগণের সর্বসম্মত নীতি হল, সাহাবায়ে কেরামের যে ফতোয়া বা নির্দেশনার ব্যাপারে এটা সুনির্দিষ্ট যে, এটা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা-নির্দেশনা থেকেই গৃহীত, এতে সাহাবীর ইজতিহাদ বা কিয়াসের কোন প্রভাব নেই তা মারফূ হাদীসেরই অন্তর্ভুক্ত। কোনো মাসআলায় এর মাধ্যমে প্রমাণ দেওয়া মারফূ হাদীসের দ্বারা প্রমাণ দেওয়ার শামিল। পরিভাষায় একে মারফূ হুকমী বলে। নিঃসন্দেহে এর ভিত্তি কোনো মারফূ হাকীকী বা স্পষ্ট মারফূ। তবে এটা জরুরী নয় যে, হাদীসের কিতাবসমূহে সেই স্পষ্ট মারফূ হাদীসটি সহীহ সনদে বিদ্যমান থাকবে। এখানে স্বল্প- বুঝের লোকেরা পদস্খলনের শিকার হয় এবং নবীজীর শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বলতে থাকে যে, এর কোনো ভিত্তি পাওয়া গেল না, অথচ মারফূ হুকমীর সূত্রে প্রমাণিত হওয়াও দলীল হিসাবে যথেষ্ট।

উদাহরণস্বরুপ ইমাম ইবনে রজব হাম্ভলী রহ.-এর হাওয়ালা উল্লেখ করা যায়। তিনি তাকবীরে তাশরীকের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন, তাকবীরে তাশরীক বিধিবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে আলেমগণ একমত। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সহীহ মারফূ হাদীস নেই। শুধু সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী ব্যক্তিদের থেকে কিছু আছর বর্ণিত হয়েছে এবং এরই উপর মুসলমানদের আমল রয়েছে।
এরপর লেখেন:
وهذا مما يدل على أن بعض ما أجمعت الأمة عليهِ لم ينقل إلينا فيهِ نص صريح عن النَّبيّ ( ، بل يكتفى بالعمل به .
অন্য কিছু হুকুমের সঙ্গে এই হুকুমটিও প্রমাণ করে যে, যেসব বিষয়ে উম্মতের ইজমা রয়েছে তার মধ্যে কিছু বিষয় এমনও আছে , যে সম্পর্কে আমাদের কাছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে স্পষ্ট কোনো নস বর্ণিত হয়ে আসেনি, বরং এ-বিষয়ে শুধু আমলে মুতাওয়ারাসের উপরই নির্ভর করতে হয়।-ফাতহুল বারী ফী শরহি সহীহিল বুখারী, ইবনে রজব হাম্ভলী, ৬/১২৪

একটি মাসআলায় ইমাম যুহরী রহ. মতামত প্রকাশ করার পর তাঁর শাগরেদ মা‘মার বিন রাশেদ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এ মাসআলা আপনি কার কাছে শুনেছেন। তিনি উত্তরে বলেছেন-
هذا ما اجتمع الناس عليه وليس في كل شيء نجد الإسناد
“এটি এমন বিষয় যার ব্যাপারে সবার ঐক্যমত রয়েছে। আর সব বিষয়ে আমরা সনদ খুঁজে পাইনা। (অর্থাৎ এমন সর্ববাদীসম্মত মাসআলায় নির্দিষ্ট সনদ খোঁজার দরকার নেই।)’- মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ১/৩৩২

সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন সুন্নাতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তাকে মজবুতভাবে অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-
إِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
“মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে তারা বহুমতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নত ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নতকে আঁকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে … এবং তোমরা (ধর্মীয় বিষয়ের) নবআবিস্কৃত বিষয়াদি থেকে খুব সতর্কতার সাথে বেঁেচে থাকবে। কেননা প্রতিটি নবআবিস্কৃত বিষয় বিদআত। আর প্রতিটি বিদআত গোমরাহি।” -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬০৭, জামে তিরমিযী ৫/৪৩, হাদীস ২৬৭৬, মুসনাদে আহমদ ৪/১২৬, হাদীস ১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫, জামে তিমিযীর ২২২৬ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পরে খেলাফতের মেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ভবিষ্যদ্ধাণী খোদ নবীজীই করে গেছেন। সে হিসাবে নবী পরিভাষায় খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন-১. আবু বকর রা. ২. উমর রা. ৩. উসমান রা. ৪. আলী রা.। তাঁর শাহাদত ৪০ হিজরীর রমযানে হয়েছে।

যেহেতু খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেনেছিলেন যে, তাঁদের জারিকৃত সুন্নতসমূহ নবী-শিক্ষার উপরই ভিত্তিশীল হবে, তাঁদের সুন্নতসমূহ নী-সুন্নতেরই অনুগামী হবে এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতকে ব্যাপকভাবে ঘোষণা দিয়ে বলে যান যে, তোমরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে রাখবে।
সুতরাং যখন উম্মতের সামনে কোনো বিষয়ে প্রমাণ হবে যে, এটি চার খলীফার কোনো একজনের সুন্নত তখন তার অনুসরণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরোক্ত ইরশাদটি যথেষ্ট। আমাদের জন্য আরও অগ্রসর হয়ে এটা ভাবার প্রয়োজন নেই যে, তাঁদের এই সুন্নতের ভিত্তি কী ছিল এবং তাঁরা এই সুন্নত কোন নবী-শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানেও স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প বুঝের লোকদের অভ্যাস হল, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের ভিত্তি হাদীসের কিতাবসমূহে খুঁজতে থাকে। এরপর সহীহ সনদে নবীজীর স্পষ্ট কোনো বাণী-বিশেষ এই ব্যাপারে না পেলে তখন অস্বীকার করে বসে এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে একে বিদআত আখ্যায়িত দিয়ে দেয়। অথচ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিন্দিত ইখতিলাফ থেকে বাঁচার এই পথই দেখিয়েছেন যে, আমার সুন্নত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অবলম্বন কর। এরপর বলেছেন যে, বিদআত থেকে বেঁচে থাক। একটু চিন্তা করুন , যদি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত বিদআতই হত তাহলে নবীজীর এই ইরশাদের অর্থ কী?

দীর্ঘ আলোচনাটি আমি আল্লামা আবদুল মালেক দা.বা. লিখিত “উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পন্থা” নামক বইয়ের ১৬৫-১৬৭ পৃষ্টা থেকে উল্লেখ করেছি। সেখানে এবিষয়ে আরো দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক দেখতে পারেন।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *