বেরলবিদের হাজির নাজির আকিদা: পর্যালোচনা (১)
বেরলবিদের সাথে আকিদাগত যে কয়েকটি মাসআলা নিয়ে যুগ যুগ থেকে আকাবিরে দেওবন্দের মতবিরোধ চলে আসছে, তার মাঝে অন্যতম হলো, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজির নাজির কি না? বেরলবি ভাইয়েরা যে কয়েকটি আকিদাকে এশকে রাসুলের মাপকাঠি বানিয়েছেন, তার মাঝে অন্যতম হলো, হাজির নাজির আকিদা। বাংলাদেশি অসংখ্য বেরলবি ভাইয়ের লিখনি এবং বক্তব্য অনায়াসে দেখানো যাবে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজির নাজির না মানলে তা*ক*ফি*রও করেছেন!
হাজির নাজির নিয়ে আলোচনা করলে প্রথম আমাদের জানতে হবে যে, বেরলবি ভাইয়েরা আসলে হাজির নাজির দ্বারা কী বুঝান? এজন্য সরাসরি আমাদের বেরলবিদের লিখিত কিতাব খুলতে হবে। তাহকিকেরও এটা মূলনীতি যে, কোন কিছুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে যারা দাবি করছেন, প্রথমে তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া। সরাসরি তাদের থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া গেলে নিজের থেকে আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না।
হাজির নাজির যেহেতু উপমহাদেশে তুমুল আলোচিত একটি বিষয়, এজন্য হাজির নাজির আকিদার পক্ষের বেরলবি আলেমরা এ আকিদা প্রমাণের জন্য উর্দূ, বাংলাতে অসংখ্য কিতাবাদি রচনা করেছেন। সে কিতাবগুলোতে তারা হাজির নাজির এর সংজ্ঞা করেছেন। এজন্য আমরা প্রথমে দেখব যে, বেরলবি ভাইয়েরা হাজির নাজির বলতে কী বুেেঝন?
বেরলবি ঘরণার অন্যতম আলেম হলেন আহমদ ইয়ার খান নাঈমী রাহি.। তিনি “জাআল হক” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে তিনি হাজির নাজির নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ছবিতে “জাআল হক” বইয়ের উর্দূ এবং বাংলা উভয় ভার্সনের স্ক্রীণ সর্ট রয়েছে। এক এবং দুই নং ছবি দেখুন। হাজির নাজির এর বিস্তারিত সংজ্ঞা করতে গিয়ে তিনি বলেন:
“তিনি পূতঃপবিত্র আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন পূন্যাত্মা, যিনি এক জায়গায় অবস্থান করে সমগ্র পৃথিবীকে স্বীয় হাতের তালু দেখার মতো স্পষ্টই দেখতে পান, নিকট ও দূরের আওয়াজ শুনতে পান; কিংবা এক মুহূর্তে সারা পৃথিবী পরিভ্রমন করেন, এং হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানকারী সাহায্যপ্রার্থীদের সাহায্য করেন। এ পরিভ্রমন কেবল রূহানী ও হতে পারে, বা জিসমে মিছালী সহকারেও হতে পারে। অথবা কবরস্থ বা অন্য কোন জায়গায় বিদ্যমান শরীরের সাহায্যেও সংঘটিত হতে পারে।” জাআল হক: উর্দূ: ১১৬।
উপমহাদেশে বেরলবি ভাইদের একটি নামকরা সংগঠনের নাম দাওয়াতে ইসলামী। পাকিস্তানভিত্তিক পরিচালিত এ সংগঠনের ওয়েবসাইটে আহমদ ইয়ারখান নাইমীর সংজ্ঞা আরেকটু বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় স্ক্রীণ সর্ট খেয়াল করুন। সেখানে হাজির নাজির এর পারিভাষিক সংজ্ঞা লেখা হয়েছে এভাবে:
حاضِر و ناظِر ہونے کا معنیٰ یہ ہے کہ قُدسی ( یعنی اللہ کی دی ہوئی) قوت والا ایک ہی جگہ رہ کر تمام عالَم (یعنی سارے جہان، زمین و آسمان، عرش و کرسی، لوح و قلم، ملک و ملکوت) کو اپنے ہاتھ کی ہتھیلی کی طرح دیکھے اور دُور و قریب کی آوازیں سُنے یا ایک آن (لمحہ بھر) میں تمام عالَم کی سیر کرے اور سینکڑوں مِیل دُور حاجت مندوں کی حاجت رَوائی کرے۔ یہ رفتار خواہ رُوحانی ہو یا جسمِ مثالی کے ساتھ ہو یا اسی مبارک جسم سے ہو جو قَبْر میں مَدفون ہے۔
অর্থাৎ পবিত্র আত্মা আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এক জায়গায় অবস্থান করে পুরো জাহান অর্থাৎ আসমান, জমিন, আরশ, কুরসি, লাওহ, কলম, ফিরিশতাদের হাতের তালুর মতো দেখতে পান। দূরের এবং কাছের আওয়াজ শুনতে পান। এক মুহূর্তে পুরো পৃথিবী সফর করতে পারেন এবং শত মাইল দূরের মুখাপেক্ষী ব্যক্তির প্রয়োজন পূর্ণ করেন। এ পরিভ্রমন কেবল রূহানী ও হতে পারে, বা জিসমে মিছালী সহকারেও হতে পারে। অথবা কবরস্থ বা অন্য কোন জায়গায় বিদ্যমান শরীরের সাহায্যেও সংঘটিত হতে পারে।” তৃতীয় ছবিতে স্ক্রীণ সর্ট দেখুন।
আহমদ ইয়ার খান নাঈমী এবং দাওয়াতে ইসলামীর বক্তব্য থেকে হাজির নাজির এর সংজ্ঞায় কয়েকটি বিষয় আমরা বুঝতে পেরেছি।
প্রথমত, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বক্ষণ হাতের তালুর মতো আসমান, জমীন, আরশ, কুরসী, লাওহ,কলম সবকিছু দেখতে পান। আরও মজার কথা হলো, বেরলবিদের আকিদা হলো, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মের আগেও সবকিছু হাতের তালুর ন্যায় দেখেছেন! জন্মের আগেও তিনি হাজির নাজির ছিলেন! নাউযুবিল্লাহ! সামনে এ ব্যাপারে তাদের কিতাবের স্ক্রীণ সর্ট তুলে ধরে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
বাংলাদেশি বেরলবি ঘরণার একাধিক আলেম হাজির নাজির ব্যাপারে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারা সেগুলোতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমরা বাংলাদেশি বেরলবি আলেমদের থেকে এখন হাজির নাজির এর সংজ্ঞা জানব।
বাংলাদেশে বেরলবি ঘরণার একজন পরিচিত আলেম হলেন এম, এ, মান্নান হা.। তিনি “হাযির নাযির” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি তার বইয়ে হাযির নাযির এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: চতুর্থ ছবির স্ক্রীণ সর্ট দেখুন:
“শরীয়তের পরিভাষায়, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা যদি এক জায়গায় অবস্থান করে সমগ্র বিশ্বকে আপন হাতের তালুর মতো দেখতে পান এবং দূরের ও কাছের আওয়াজ-আহবান শুনতে পান অথবা একই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের ভ্রমণ করতে সক্ষম হন, শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থানরত সাহায্যপ্রার্থী কিংবা সহযোগিতার মুখাপেক্ষী লোকদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ করেন, তিনিই হাযির-নাযির।” (হাযির-নাযির, পৃষ্ঠা নং ৫)
এম, এ মান্নান আহমদ ইয়ার খান নঈমীর সংজ্ঞাই নিজের মতো তুলে ধরেছেন। তার সংজ্ঞা থেকে আমাদের কাছে অন্তত এটা বুঝে এসেছে বেরলবি ভাইয়েরা হাযির- নাজির বলতে কী বুঝেন?
বর্তমান বাংলাদেশে বেরলবিদের প্রথিতযশা আরেকজন আলেম হলেন অধ্যক্ষ শেখ মুহাম্মাদ আবদুল করীম সিরাজনগরী হা.। আমার জানামতে তিনি ইসলামিক ফ্রন্ট একাংশের চেয়ারম্যান। তিনি “কুরআন সুন্নাহর দৃষ্টিতে হাজের-নাজের” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। জাগরণ প্রকাশনী চট্রগ্রাম থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ৫ম ছবির স্ক্রীণ সর্ট দেখুন। তিনি হাজির নাজির এর পারিভাষিক সংজ্ঞা করতে গিয়ে লিখেন:
“শরীয়তের দৃষ্টিতে হাজের ও নাজের শব্দের অর্থ হলো, যিনি খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে একই স্থান থেকে তাঁর পবিত্র দৃষ্টি শক্তি দ্বারা সারা পৃথিবীকে হাতের তালুর ন্যায় দেখতে পান, এবং বিশ্ব জগতের সবকিছু যার ক্ষমতার আওতাভ‚ক্ত। যিনি কাছের ও দূরের আওয়াজ শুনতে পান, কিংবা একই সময়ে সর্বত্র পরিভ্রমণ করতে পারেন, করে থাকেন। দূর দূরান্তের সকলের অভাব পূরণে তিনি সক্ষম। তিনিই হাজের ও নাজের। আর ইহা আল্লাহর পিয়ারা হাবীরের একটি অন্যতম গুণ।” “কুরআন সুন্নাহর দৃষ্টিতে হাজের ও নাজের: পৃষ্ঠা নং ৮)
আবদুল করিম সিরাজনগরী আহমদ ইয়ার খান নঈমীর সংজ্ঞার সাথে কয়েকটি বিষয় বাড়িয়েছেন! হাজির নাজির অর্থ হলো, বিশ্ব জগতের সবকিু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষমতার অন্তর্ভূক্ত! আল ইয়াযু বিল্লাহ! দ্বিতীয়ত সকলের অভাব পূরণে তিনি সক্ষম! এগুলো নিয়ে শারয়ী পর্যালোচনা পরে করব। আগে সংজ্ঞাগুলো সামনে আসুক।
বাংলাদেশি বেরলবি ঘরনার তরুণদের মধ্যে মাওলানা আলাউদ্দিন জি*হা*দি একজন পরিচিত আলেম। “কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইলমে গায়েব ও হাযির-নাযিরের চ‚ড়ান্ত সমাধান” নামে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমার কাছে বইটির হার্ড কপি রয়েছে। হার্ড কপির ৯১ নং পৃষ্ঠায় তিনি হাজির নাজির এর সংজ্ঞা করতে গিয়ে লিখেন:
“আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিতে আল্লাহর হাবীব হুজুর পুর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা বিশ্বের সব কিছুই সরাসরি দেখতে পান এবং আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় সারা জাহানে রুহানীভাবে হাযির নাযির তথা অদৃশ্য নুরানী দেহ মোবারক নিয়ে উপস্থিত হয়ে সব কিছু দেখেন ও শুনেন।” (প্রিয় নবীজির ইলমে গায়েব ও হাযির-নাযিরের চ‚ড়ান্ত সমাধান: পৃষ্ঠা নং ৯১)
বেরলবিদের শায়খুল তাফসির মাওলানা ফয়েয আহমদ উয়াইসি আরেক কাঠি সামনে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি “হাযির নাযির কা ছুবুত” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। শেষ ছবির স্ক্রীণ সর্টে তার বক্তব্য দেখুন। তিনি লিখেন:
“হাযির নাযির মাসআলায় আমাদের আমাদের আকিদা হলো সেটাই, যে আকিদা আমাদের সালাফের। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো জাহানের প্রত্যেকটি অংশে সর্বক্ষণ হাযির এবং নাযির।” (হাযির নাযির কা ছুবুত: পৃষ্ঠা নং ৪।)
আরও অসংখ্য কিতাব থেকে চাইলে এ ধরণের সংজ্ঞা দেখানো যাবে। প্রিয় পাঠক, এগুলো আপনাদের সামনে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য হলো, উপমহাদেশে যারা হাজির নাজির আকিদা লালন করেন, তারা সেটার ব্যাখ্যা কী করেন, সেটা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা। কারণ, বর্তমানে রুহ উপস্থিত হতে পারে কিনা? সেটাকে হাজির নাজির বলে চালিয়ে দিচ্ছেন!
রুহ হাজির হওয়া বা না হওয়া এবং বেরলবিদের হাজির নাজির আকিদা যে এক নয়, সেটা বুঝানোর জন্য এতগুলো সংজ্ঞা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। পরবর্তীতে দলিলের দিকে যখন আমরা যাব, তখন সেটা আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠবে। আমাদের আকিদা আল্লাহ ইলম এবং কুদরতিভাবে সব জায়গায় আছেন, বেরলবিরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রেও হাজির নাজিরের দলিল দিতে গিয়ে এ ধরণের কথা লিখেছে! সামনের কোন পর্বে সে ব্যাপারে আলোচনা হবে!
বেরলবি ভাইদের কাছে হাজির নাজির সংজ্ঞার মূলকথা হলো,
*রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতের তালুর ন্যায় সর্বদা সবকিছু দেখছেন!
* কাছে কিংবা দূরের সবকিছু তার ক্ষমতার অন্তর্ভূক্ত! তিনি যে কোন সময় যে কারও অভাব কিংবা প্রয়োজন পূর্ণ করতে সক্ষম!
* তিনি একই সময় পুরো পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে পারেন!
* সর্বদা দূরে কাছের সকল আওয়াজ শুনতে পান!
এগুলো তাদের ক*ল্পি*ত এবং বা*নো**য়াট আকিদা। কুরআন, সুন্নাহর সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নাই।
চলবে!