আল্লাহ তাআলার সিফাতের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা হলো, আল্লাহ তাআলার সিফাত তথা গুণাবলির ধরণ, আকৃতি, স্বরুপ নেই। ধরণ, স্বরুপ এবং প্রকৃতি সাব্যস্থ করা ছাড়া বিশ্বাস করতে হবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা এগুলোর উর্ধ্বে। এগুলোর এমন অর্থ করা যাবে না, যেগুলো ধারা আল্লাহ তাআলা শরীর কিংবা অপূর্ণতা আবশ্যক হয়ে যায়। এমনভাবে আল্লাহ তাআলার শানের সাথে যায় না, এমন কোন অর্থও করা যাবে না।
এ ব্যাপারে সালাফে সালিহীন এর আকিদা অত্যন্ত গোছালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ইমাম নববি রাহি.। তিনি সিফাতের আলোচনা করতে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এক জায়গায় তিনি বলেন:
اعلم أن لأهل العلم في أحاديث الصفات وآيات الصفات قولين: أحدهما وهو مذهب معظم السلف أو كلهم أنه لا يتكلم في معناها بل يقولون: يجب علينا أن نؤمن بها ونعتقد لها معنى يليق بجلال الله تعالى وعظمته مع اعتقادنا الجازم أن الله تعالى ليس كمثله شيء، وأنه منزه عن التجسم والانتقال والتحيز في جهة وعن سائر صفات المخلوق، وهذا القول هو مذهب جماعة من المتكلمين واختاره جماعة من محققيهم وهو أسلم.
وَالْقَوْلُ الثَّانِي وَهُوَ مَذْهَبُ مُعْظَمِ الْمُتَكَلِّمِينَ أنها تتأول على مايليق بِهَا عَلَى حَسَبِ مَوَاقِعهَا وَإِنَّمَا يَسُوغُ تَأْوِيلُهَا لِمَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِهِ بِأَنْ يَكُونَ عَارِفًا بِلِسَانِ الْعَرَبِ وَقَوَاعِدِ الْأُصُولِ وَالْفُرُوعِ ذَا رِيَاضَةٍ فِي الْعِلْمِ
অর্থাৎ আল্লাহর সিফাত তথা গুণাবলি সংক্রান্ত আয়াত এবং হাদীসের ব্যাপারে ইমামদের দুটি মত। অধিকাংশ সালাফ বা সালাফের সব ইমামদের মত হলো, এগুলোর অর্থের ব্যাপারে কোন কথা বলা যাবে না। তারা বলেন, আমাদের উপর ওয়াজিব হলো, আমরা এগুলোর উমর ঈমান আনব এবং আল্লাহ তাআলার মহান সত্ত¡ার সাথে সামঞ্জশ্যশীল অর্থ বিশ্বাস করব। এর সাথে সাথে আমরা দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করব যে, আল্লাহ তাআলা কোন কিছুর মতো নয়। তিনি শরীর, স্থানান্তর, দিক এবং সৃষ্টির সকল গুণ থেকে পবিত্র। মুতাকাল্লিমদের একটি জামাতেরও মত এমন। তাদের মাঝে মুহাক্কিকরা এ মত গ্রহণ করেছেন। আল্লাহর গুণাবলির ক্ষেত্রে এটাই নিরাপদ আকিদা।
অর্থাৎ দ্বিতীয় মত হলো অধিকাংশ মুতাকাল্লিম এর। সেটা হলো আল্লাহর শান উপযুক্ত কোন তাবিল তথা ব্যাখ্যা করা। তাবিল করবে এমন ব্যক্তি, যিনি আরবি ভাষা, মূলনীতি সম্পর্কে অবগত এবং ইলমে সিদ্ধহস্ত। মিনহাজ শরহে মুসলিম: ১০/৩০।
আকিদার প্রথম ধারাকে বলা হয়, তাফওয়িয। এ ধারা নিয়ে স্বতন্ত্র লেখায় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আজ আমরা দ্বিতীয় ধারা নিয়ে আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ। দ্বিতীয় ধারার মূলকথা হলো, আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে মূল অর্থ সাব্যস্ত না করে আল্লাহর শান অনুযায়ী সেগুলোর তাবিল তথা ব্যাখ্যা করা।
আকিদার প্রথম ধারা যেমন অসংখ্য ইমাম থেকে প্রমাণিত, তেমনিভাবে দ্বিতীয় ধারা তথা তাবিলও অসংখ্য ইমাম থেকে প্রমাণিত। খোদ ইমাম বুখারি রাহি. তাবিল করেছেন। কিন্তু মজার কথা হলো, বর্তমানের নব্য কথিত সালাফি ধারার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানি রাহি. এর মতে সিফাতের তাবিল কোন মুসলিম করতে পারে না! আলবানির বক্তব্যের পর্যালোচনা করার আগে আমরা ইমাম বুখারি রাহি. এর তাবিল দেখে আসি।
কুরআনে সূরা কাসাস এ আল্লাহ বলেন:
كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
অর্থ: আল্লাহর ওয়াজহ ব্যতিত সবকিছু ধ্বংসশীল।
ওয়াজহুন এর শাব্দিক অর্থ হলো, চেহারা। বাহ্যিকভাবে এ আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহর চেহারা ব্যতিত সবকিছু ধ্বংশশীল। এখানে চেহারা দ্বারা কী উদ্দেশ্য? ইমাম বুখারী রাহি. এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেন:
{ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ } إِلَّا مُلْكَهُ
সবকিছু ধ্বংসশীল আল্লাহর চেহারা ছাড়া। অর্থাৎ তাঁর রাজত্ব ছাড়া কারও রাজত্ব থাকবে না। বুখারী: ১৭৮৭।
“ওয়াজহ” এটি একটি গুণবাচক শব্দ। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা হলো, আল্লাহর আকৃতি নেই। কারণ, আকৃতি হয় মাখলুকের। এজন্য দেখেন ইমাম বুখারি “ওয়াজহ” এর ব্যাখ্যা করেছেন রাজত্ব দিয়ে। অর্থাৎ সবার রাজত্বের সমাপ্তি থাকলেও আল্লাহর রাজত্ব কখনও শেষ হবে না। এখানে যে তিনি ওয়াজহ দ্বারা রাজত্ব বুঝিয়েছেন, আকিদার পরিভাষায় এটাকে বলে তাবিল। আমরা দেখলাম ইমাম বুখারি রাহি.ও তাবিল করেছেন।
এবার আসুন, এ ব্যাপারে আমরা নাসির উদ্দিন আলবানি রাহি. এর বক্তব্য দেখে আসি। আলবানিকে বুখারি রাহি. এর তাবিল এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:
لأن تفسير قوله تعالى: { وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلالِ وَالْأِكْرَامِ } [الرحمن:২৭] أي: ملكه، يا أخي! هذا لا يقوله مسلم مؤمن، وقلت أيضاً: إن كان هذا موجوداً فقد يكون في بعض النسخ، فإذاً الجواب تقدم سلفاً،
অর্থাৎ ইমাম বুখারি রাহি. যে “ওয়াজহ” এর তাবিল করেছেন রাজত্ব বলে, প্রিয়ভাই, এমনটি কোন মুসলিম, মুমিন বলতে পারে না। এ ছাড়া বুখারির এ বক্তক্য থাকলেও কিছু নুসখায় আছে। (মাওসুুআতুল আল্লামা আলবানি: ৭/৩২৬)
তিনি ইমাম বুখারি রাহি. এর ব্যাপারে কত বড় স্পর্ধা দেখিয়েছেন! ইমাম বুখারির তাবিলের ব্যাপারে বলছেন যে, এটা কোন মুমিন, মুসলমান করতে পারে না! আলবানিকে জিজ্ঞাসা করা দরকার যে, তাহলে ইমাম বুখারিকে আপনি মুসলিম, মুমিন মনে করেন না!
প্রিয় পাঠক, শাখাগত মাসআলার ক্ষেত্রে এরা বুখারি মিছিল দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ফিতনা সৃষ্টি করে! তারাই আবার আকিদার প্রশ্নে ইমাম বুখারির ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তুলে!
এবার আমরা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহি. এর তাবিল দেখব। আলবানির ফতোয়া অনুযায়ী ইমাম আহমদও ইসলাম এবং ঈমান থেকে বের হয়ে গেছেন! ইমাম ইবনে কাছির রাহি. “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া” তে সনদসহ বর্ণনা করেছেন:
وروى البيهقي عن الحاكم عن أبي عمرو بن السماك عن حنبل أن أحمد بن حنبل تأول قول الله تعالى: (وجاء ربك) [ الفجر: ২২ ] أنه جاء ثوابه.
ثم قال البيهقي: وهذا إسناد لا غبار عليه.
অর্থাৎ ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেছেন হাকিম থেকে, তিনি আবু আমর বিন সিমাক থেকে, তিনি হাম্বল থেকে, তিনি বলেন: আল্লাহ তাআলার বাণী “এবং তোমার প্রভ‚ আসবেন” এর তাবিল করেছেন। প্রভ‚ আসার দ্বারা অর্থ হলো প্রভ‚র পক্ষ থেকে বিনিময় আসবে।
ইমাম বায়হাকী বলেন: বর্ণনার সনদে কোন অস্পষ্টতা নেই। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১০/৩৬১)
এখানে আল্লাহর আসা দ্বারা ইমাম আহমদ তাবিল করেছেন আল্লাহ পক্ষ থেকে বিনিময় আসা। এবার একপাশে আপনি ইমাম বুখারি এবং ইমাম আহমদের তাবিল রাখুন। আরেক পাশে আলবানির ফতোয়া রাখুন! আলবানির ফতোয়া মতে ইমাম বুখারি এবং মুসলিম যে কাজ করেছেন, সেটা কোন মুমিন, মুসলিম করতে পারে না! ঈমান বিধ্ব**ংসী কাজ উভয় ইমাম করে ফেলেছেন! লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ! আল্লাহ এদের হেদায়াত দান করুন!