সাহাবীদের যুগে কী সিফাতের ক্ষেত্রে তাবিল ছিল না?
আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদার স্বীকৃত দুটি ধারা রয়েছে। একটি হলো, ‘তাফওয়িয’ এবং অপরটি হলো তাবিল। তাবিলের মর্ম হলো, আল্লাহর শান অনুযায়ী আরবী ভাষারীতি অনুযায়ী বিশুদ্ধ কোন ব্যাখ্যা করা।
আকিদার এ ধারা সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. কুরআন বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত সাহাবি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আপন চাচাতো ভাই। বিখ্যাত এ সাহাবি থেকে সিফাতের ক্ষেত্রে তাবিল সহিহ সনদে প্রমাণিত।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন:
يَوْمَ يُكْشَفُ عَن سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ
অর্থ, যে দিন গোছা পর্যন্ত পা উন্মোচন করা হবে। তাদের সিজদার জন্য আহবান করা হবে। কিন্তু তারা করতে পারবে না।
সূরা কলম: ৪২।
বাহ্যিকভাবে এ আয়াতে গোছা পর্যন্ত পা উন্মোচন করে সিজদা করার জন্য আহবান করার কথা বলা হয়েছে। আর আমরা জানি পা একটি অঙ্গ। সৃষ্টি অঙ্গের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ সৃষ্টির সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। তাহলে এ আয়াতের মর্ম কী? এ ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদার প্রথম ধারা হলো, আমাদের কাজ শুধু এগুলো পড়ে যাওয়া। অর্থ এবং মর্ম কী হবে? সেটা আমরা আল্লাহর উপর ন্যস্ত করে দিবো। আকিদার পরিভাষায় এটাকে বলে ‘তাফওয়িয’। আরেকটি হলো, আল্লাহর শান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা। সেটাকে ‘তাবিল’ বলা হয়।
ইবনে আব্বাস রাযি. এ আয়াতের তাবিল করেছেন। হাকিম নিশাপুরি রাহি. বর্ণনা করেন:
حدثنا أبو زكريا العنبري ثنا الحسين بن محمد بن القباني ثنا سعيد بن يحيى الأموي ثنا عبد الله بن المبارك أنبأ أسامة بن زيد عن عكرمة عن ابن عباس رضي الله عنهم : أنه سئل عن قوله عز و جل : { يوم يكشف عن ساق } قال : إذا خفي عليكم شيء من القرآن فابتغوه في الشعر فإنه ديوان العرب أما سمعتم قول الشاعر :
( أصبر عناق إنه شر باق قد سن قومك ضرب الأعناق )( و قامت الحرب بنا عن ساق )
قال ابن عباس : هذا يوم كرب و شدة
অর্থাৎ ইবনে মুবারক বর্ণনা করেছেন উসামা বিন যায়দ থেকে, তিনি ইকরিমা থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, তাকে কুরআনের এ আয়াতের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল “যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচন করা হবে”। জবাবে ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, কুরআনের কোন বিষয় আরবের কাব্য সমগ্রে সেটা অনুসন্ধান করো। এরপর কবিতা আবৃত করে বলেন: কুরআনে পায়ের গোছা উন্মোচন দ্বারা কিয়ামতের প্রচÐতা বুঝানো হয়েছে।
আল মুসতাদরাক: ৩৮৪৫।
এ হাদিস বর্ণনা করে হাকিম নিশাপুরি রাহি. বলেন:
هذا حديث صحيح الإسناد و هو أولى من حديث روي عن ابن مسعود بإسناد صحيح لم أستجز روايته في هذا الموضع
অর্থাৎ সনদের দিক থেকে এ বর্ণনা সহিহ।
ইমাম যাহাবি রাহি.ও ‘তালখিসুল মুসতাদরক’ এ বর্ণনাটি সহিহ বলেছেন।
এখানে ইবনে আব্বাস রাযি. পায়ের গোছা উন্মোচন দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন প্রচÐতা দিয়ে। আকিদার পরিভাষায় এটাকে তাবিল বলে।
পবিত্র কুরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন:
هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا أَن تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ
অর্থ. তারা কী এ বিষয়ের দিকে তাকিয়ে আছে যে তাদের কাছে ফিরিশতা আসবেন, কিংবা আপনার রব আসবেন।
সূরা আনআম: ১৫৮।
এ আয়াতে আল্লাহর আসার কথা বলা হয়েছে বাহ্যিকভাবে। অথচ, আল্লাহ তাআলা আসা, যাওয়া, স্থানান্তর হওয়া ইত্যাদি থেকে পবিত্র। আল্লাহর সৃষ্টির সব ধরণের সাদৃশ্য থেকে পবিত্র। তাহলে এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে কী?
এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইমাম কুরতুবি রাহি. লিখেন:
{أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ} قال ابن عباس والضحاك : أمر ربك فيهم بالقتل أو غيره
অর্থাৎ ইবনে আব্বাস রাযি. এবং যাহহাক বলেন, এখানে আল্লাহর আসা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে হত্যা এবং অন্যান্য আজাবের নির্দেশ আসা।
তাফসিরে কুরতুবি: ৭/১১৪।
এখানে ইবনে আব্বাস রাযি. আল্লাহর আসা দ্বারা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আসা ব্যাখ্যা করেছেন। আকিদার পরিভাষায় এটাকে ‘তাবিল’ বলা হয়।
কুরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ
অর্থ, আমি আইদ (ইয়াদ এর বহুবচন, শাব্দিক অর্থ হাত) দ্বারা আসমান নির্মাণ করেছি।
সূরা যারিয়াত: ৪৭।
এ আয়াতের শাব্দিক অর্থ হিসেবে হাতের সম্বন্ধ আল্লাহর দিকে করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাআলা সব ধরণের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ থেকে পবিত্র। তাহলে এ আয়াতের উদ্দেশ্য কী? এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইবনে জারির তাবারি রাহি. লিখেছেন:
حدثني علي، قال: ثنا أبو صالح، قال: ثني معاوية، عن علي، عن ابن عباس، قوله: والسماء بنيناها بأيد يقول: بقوة.
অর্থাৎ ইবনে জারির তাবারি রাহি. বর্ণনা করেছেন আলী থেকে, তিনি আবু সালিহ থেকে, তিনি মুআবিয়া থেকে, তিনি আলী থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, এখাতে হাত দ্বারা উদ্দশ্য হলো, শক্তি।
তাফসিরে তাবারি: ২৪৯৬২।
এখানে হাতের ব্যাখ্যা করেছেন ইবনে আব্বাস রাযি. শক্তি দ্বারা। আকিদার পরিভাষায় এটাকে ‘তাবিল’ বলে। শুধু ইবনে আব্বাস রাযি. না, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ এবং কাতাদা থেকেও এ ‘তাবিল’ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে জারির তাবারি বর্ণনা করেন:
حدثني محمد بن عمرو، قال: ثنا أبو عاصم، قال: ثنا عيسى وحدثني الحارث، قال: ثنا الحسن، قال: ثنا ورقاء جميعا، عن ابنأبي نجيح، عن مجاهد، قوله: بأيد قال: بقوة.
– حدثنا بشر،قال: ثنا يزيد، قال: ثنا سعيد، عن قتادة والسماء بنيناها بأيد: أي بقوة
অর্থাৎ মুজাহিদ এবং কাতাদা রাহি. এখানে দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন শক্তি।
তাফসিরে তাবারি: ২৪৯৬৩, ২৪৯৬৪।
পবিত্র কুরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন:
فَالْيَوْمَ نَنسَاهُمْ كَمَا نَسُوا لِقَاءَ يَوْمِهِمْ هَـٰذَا وَمَا كَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ
অর্থ, আজ আমি তাদের ভুলে যাব, যেমনভাবে তারা এ দিনের সাক্ষাতের কথা ভুলে গিয়েছিল।
সূরা আরাফ: ৫১।
বাহ্যিকভাবে এখানে আল্লাহর ভুলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ আমরা জানি ভুলে যাওয়া সৃষ্টির গুণ। আল্লাহ তাআলা এর থেকে পবিত্র। তাহলে এ আয়াতের উদ্দেশ্য? এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইমাম ইবনে জারির তাবারি রাহি. লিখেছেন:
حدثني المثنى، قال: ثنا عبد الله، قال: ثني معاوية، عن علي، عن ابن عباس،………: فاليوم ننساهم كما نسوا لقاء يومهم هذا أي ففي هذا اليوم وذلك يوم القيامة ننساهم، يقول: نتركهم في العذاب المبين جياعا عطاشا بغير طعام ولا شراب، كما تركو العمل للقاء يومهم هذا ورفضوا الاستعداد له بإتعاب أبدانهم في طاعة الله
অর্থাৎ ইবনে জারির তাবারি রাহি. বর্ণনা করেছেন মুছান্না থেকে, তিনি আবদুল্লাহ থেকে, তিনি মুআবিয়া থেকে, তিনি আলি থেকে, ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন: “আজ আমি তোমাদের ভুলে যাবো” এখানে দিন দ্বারা কিয়ামত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমি তোমাদের যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি, অনাহার এবং তৃষ্ঞায় নিক্ষেপ করব।
তাফসিরে তাবারি: ১১৪৫১।
এখানে ইবনে আব্বাস রাযি. আল্লাহর ভুলে যাওয়া তাদের জাহান্নামে কঠিন শাস্তি প্রদান উদ্দেশ্য নিয়েছেন। আকিদার পরিভাষায় এটাকে ‘তাবিল’ বলে।
ইমাম বুখারি ‘তাবিল’ করার কারণে আলবানি তার ঈমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন! জানি না ইবনে আব্বাস রাযি. এর মতো মহান সাহাবির ব্যাপারে আলবানি কী বক্তব্য দিবেন?
কথিত সালাফিদের একজন হলেন মুজাফফার বিন মুহসিন। তিনি “ভ্রান্ত আকিদা বনাম সঠিক আকিদা” নামে একটি বই লিখেছেন। সে বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন:
“কিছু বাতিল ফিরকা ও আক্বীদাভ্রষ্ট কতিপয় মুফাসসির আল্লাহর হাত, পা, চোখ, ও চেহারার রূপক অর্থ করেছেন।”
প্রিয় পাঠক, আল্লাহর হাত শক্তি রূপক অর্থ উদ্দেশ্য নিয়েছেন ইবনে আব্বাস রাযি.! পা দ্বারা প্রচÐতা উদ্দেশ্য নিয়েছেন ইবনে আব্বাস রাযি.! এবার একদিকে ইবনে আব্বাস রাযি. এর তাবিল রাখুন! তারপর মুজাফফারের মন্তব্য পড়ে হৃদয়ের গভীর থেকে তার হেদায়াতের দোয়া করুন।