মসজিদ বানানো হবে জিকির করার জন্য। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ
অর্থ, মসজিদে তাদে আল্লাহর মহিমাত্ব এবং তাঁর নামের জিকির করার অনুমতিপ্রদান আল্লাহ দিয়েছেন। সূরা নুর : আয়াত নং ৩৬
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে বলেন,
‘মসজিদ বানানো হয়েছে আল্লাহর জিকির করা জন্য। মুসলিম, হাদীস নং ৫৬৯
সুতরাং কোন কাজ জিকির সংক্রান্ত না হলে মসজিদে সে কাজ করা নিষেধ। আমরা দেখি যে কিছু লেখক টাকা নিয়ে মসজিদের ভিতরে বসে লিখেন। এমনভাবে টাকার বিনিময় বিশেষ ছেলেদের মসজিদে পড়ানো যাবে না। তবে দরস, তাদরিস করানো যাবে। এজন্য এতেকাফকারীরা আল্লাহর জিকিরের নিয়তে মসজিদে বসবেন। তারা পণ্য উপস্থিত করা ছাড়া মসজিদে প্রয়োজনমাফিক বেচাকেনা করতে পারবেন। তবে এর কারণে যেন আল্লাহর জিকির থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে না যান। দেখা যায় ব্যবসায় ব্যস্ত লোকদের পক্ষে কখনো ইতেকাফে বসার সুযোগ হয় না। কারণ, তারা তো আর পণ্য নিয়ে মসজিদে যেতে পারবে না। তবে সংক্ষিপ্ত কোন কিছু হলে সেটা প্রয়োজনের কারণে মসজিদে উপস্থিত করা যেতে পারে। এমনভাবে ঘোষণা দিয়ে মসজিদে লেনদেন করার অনুমতি নেই। বাহিরে হারানো কোন জিনিসের ঘোষণা মসজিদে দেওয়া যাবে না। তবে মসজিদের ভিতরে হারালে ভিন্ন কথা।
এমনভাবে আপনার ব্যবসার প্রচার মসজিদে করা যাবে না। হাদীসে এটাকে কিয়ামতের আলামত বলা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَسَاجِدُهُمْ عَامِرَةٌ وَهِيَ خَرَابٌ مِنَ الْهُدَى
অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে মনে হবে তাদের মসজিদ আবাদ। কিন্তু সেটা হেদায়াত থেকে খালি হবে। শুআবুল ঈমান, বায়হাকি : হাদীস নং ১৭৬৩
অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে মসজিদের ভবন সুরম্য হবে। অনেক লোকও সেখানে নামাজ পড়তে একত্রিত হবে। কিন্তু দেখা যাবে ইখলাস থাকবে না। এর থেকে আগের কথা প্রমাণিত হয়ে যায়। একবার সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সর্বোত্তম এবং সর্ব নিকৃষ্ট জায়গা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জিবরিল আ. এর মাধ্যমে জেনে আপনাদের জানাব। জিবরিল আ. আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসা করে এসে বলেন, সর্বোত্তম জায়গা হল মসজিদ এবং সর্ব নিকৃষ্ট জায়গা হল বাজার।
বুঝতে হবে উভয়ের মাঝে কী পার্থক্য রয়েছে। মসজিদে আল্লাহর জিকির করা হয় এবং বাজারে দুনিয়ার আলোচনা করা হয়। এর থেকে আমরা জানতে পারলাম যে মসজিদের আলোচ্য বিষয় হল, আল্লাহর জিকির করা। এখানে দুনিয়ার আলোচনা করার অর্থ হল, মসজিদকে সর্ব নিকৃষ্ট জায়গায় পরিণত করা। এটা মসজিদ বিরাণ করার নামান্তর।
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং জিবরিল আ. আমি জানি না বলার দ্বারা আমাদের একটি শিক্ষা রয়েছে। কোন মাসআলা না জেনে ভুল জবাব প্রদান করা যাবে না। যারা কিতাব না পড়েও ছাত্রদের মত জবাব দেন, তাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে আমার জবাব দেওয়ার সময় এখনো আসে নি। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, আমি জানি না। আপনি অন্য কোন ভাল আলেমকে জিজ্ঞাসা করুন। একবার রাষ্ট্রের বেতনভ‚ক্ত একজন আলেমকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, আমি জানি না। সে বলল, সরকারের বেতন নেওয়ার পরও আপনি কেন জানেন না? তিনি বললেন, আমি জানা মাসআলার বিনিময় নেই। না জানা মাসআলার বিনিময় নিলে সরকারের রাজকোষ খালি হয়ে যাবে। জিবরিল আ. এবং আল্লাহর মাঝে ৭০ হাজার নুরের পর্দা রয়েছে। দুনিয়াতে সামান্য জিকির করে যারা আল্লাহকে দেখতে চান, এর মাঝে তাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। আপনারা কত বড় ভুলের মাঝে রয়েছেন। আপনি আল্লাহর সত্ত¡াকে দেখার আশা কখনো করবেন না। আপনি তার সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন। আল্লাহ নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।
তবে কিয়ামতের দিন আপনি সরাসরি আল্লাহকে দেখতে পারবেন। হাদীসে বলা হয়েছে সেদিন আল্লাহর বড়ত্বের চাদর ব্যতিত অন্য কোন চাদর থাকবে না। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আল্লাহকে সরাসরি দেখবেন। কিন্তু সম্মান এবং বড়ত্বের কারণে পুরোটা দেখা সম্ভব হবে না। দুনিয়াতে কখনো আপনি আল্লাহকে সরাসরি দেখতে পারবেন না। এটি হল আকিদা এবং শরিয়তের মাসআলা। আপনি আল্লাহকে দেখার আশা করলে সেটা কিয়ামতের জন্য করতে থাকুন। বড়পীর থেকে এ সংক্রান্ত কবিতা মূলত কিয়ামতের দিন আল্লাহকে দেখার আশা করার কথা বলা হয়েছে।
কিছু লোক সাহাবাদের ব্যাপারে অভিযোগ করে বলে, তারাও আমাদের মত মসজিদের দুনিয়াবি কথা বলতেন। এটা সম্পূর্ণ সাহাবাদের নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথার উপর আমল না করলে কে করবে? আপনি মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলে গুনাহ করছেন! অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো আবার সাহাবাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বসেছেন! লা হাওলা!
কিছু লোকের আরেকটি সমস্যা আছে। তারা প্রত্যেকটি কথাকে দুনিয়াবি কথা মনে করে। উদাহরণস্বরুপ অসুস্থ ব্যক্তি বা কোন মুসলমানের অবস্থা জিজ্ঞাসা করা। মনে রাখবেন অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ খবর নেওয়া এবং মুসলমানদের অবস্থা জিজ্ঞাসা করা শারয়ি নির্দেশ। এজন্য মসজিদে জিজ্ঞাসা করলে কোন অসুবিধা নেই। এমনভাবে মসজিদে কেউ হারিয়ে গেলে তার কথা জিজ্ঞাসা করতে কোন আপত্তি নেই। এমনভাবে এতেকাফকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় বেচাকেনা মসজিদে করার অনুমতি শরিয়ত প্রদান করেছে। যদি ব্যবসা একেবারে মসজিদে হারাম করে দেওয়া হত, তাহলে ব্যবসায়ী এতেকাফের মত গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে বঞ্চিত হয়ে যেত। এজন্য আপনাকে আগে বুঝতে হবে যে কোন কথা শরিয়ত সংক্রান্ত এবং কোন কথা দুনিয়া সংক্রান্ত। কিন্তু মনে রাখতে হবে যারা এতেকাফকারী নয়, তাদের জন্য মসজিদে কেনাবেচা করার অনুমতি নেই।
আমার এক বন্ধুর কাহিনী আমার খুব পছন্দ হয়েছিল একবার। সে মসজিদে বসে থাকাবস্থায় আমি এক রুপি দিয়ে রেজার কিনছিলাম। সে গিয়ে সতর্ক করে বলল, এটা বেচাকেনার অন্তর্ভূক্ত। মসজিদে না করাই ভাল হবে। এজন্য আহলে হকের আলামত হল, তারা বড়দেরও আদবের সাথে সতর্ক করবে। মাওলান আহমদ শহিদ রাহি. একবার নতুন বিয়ে করার কারণে ফজরের নামাজে আসতে একটু দেরি হল। তার মুরিদ মাওলানা আবদুল হাই সাহেব নামাজের পর বয়ান করার জন্য বসে গেলেন। তিনি বললেন, কিছু লোকের অবস্থা হল তারা স্ত্রীদের বগলদাবা হয়ে পড়ে থাকার কারণে ফজরের নামাজের তাকবিরে উলা ছুটে যায়। সায়্যিদ আহমদ শহিদ রাহি. তার অনেক শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আর এমনটি হবে না। বাহ্যিকভাবে আপনি আবদুল হাই সাহেবের এ আচরণ শিষ্টাচার বহির্ভূত মনে করতে পারেন। কিন্তু তিনি জানতেন সায়্যিদ সাহেব এ আলোচনার কারণে খুশি হবেন।
আয়েশা রা. এর ব্যাপারেও হাদীসে এ ধরণের একটি কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
إِنِّي لَأَعْلَمُ إِذَا كُنْتِ عَنِّي رَاضِيَةً، وَإِذَا كُنْتِ عَلَيَّ غَضْبَىগ্ধ قَالَتْ: فَقُلْتُ: مِنْ أَيْنَ تَعْرِفُ ذَلِكَ؟ فَقَالَ: ” أَمَّا إِذَا كُنْتِ عَنِّي رَاضِيَةً، فَإِنَّكِ تَقُولِينَ: لاَ وَرَبِّ مُحَمَّدٍ، وَإِذَا كُنْتِ عَلَيَّ غَضْبَى، قُلْتِ: لاَ وَرَبِّ إِبْرَاهِيمَ ”
তুমি কখন আমার উপর রাগ অবস্থায় এবং কখন খুশি অবস্থায় আছো, সেটা আমি বুঝতে পারি। তুমি রাগ থাকলে বল ‘ইবরাহিমের প্রভ‚র শপথ’, খুশি থাকলে বল ‘মুহাম্মাদের প্রভ‚র শপথ’। বুখারী: হাদীস নং ৫২২৮
বাহ্যিকভাকে কিছু কথা আপনার কাছে বেয়াদবি মনে হতে পারে। কিন্তু প্রেমিক ভালবাসার কারণে বুঝতে পারে যে প্রেমাষ্পদের কাছে সেটা বেয়াদবি নয়। বাহ্যিকভাবে সেটা বেয়াদবি মনে হলেও এর মাঝে আদব রয়েছে।
মূলকথা হল, দুনিয়ার কোন বিচারকের কাছে উপস্থিত হলে আপনার অন্তরের যে অবস্থায় হয়, মসজিদে যাওয়ার পর আপনার শরীর এবং অন্তরের সে রকম অবস্থা হতে হবে। মসজিদে সর্বক্ষণ এমন অবস্থা না থাকলেও অন্তত উপস্থিত হওয়ার সময় থাকা চাই।
উমর রা. এর যুগে একবার দুইজন লোক মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলছিল। তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলছ। তোমরা মুসাফির না হলে আমি তোমাদের শাস্তি প্রদান করতাম।’
মনে রাখবেন এ বিধান শুধুমাত্র মসজিদে নববির সাথে নির্দিষ্ট নয়। পৃথিবীর প্রত্যেক মসজিদ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর। তবে মসজিদে নববির আদবের ব্যাপারে অন্যান্য মসজিদ থেকে বেশি খেয়াল করা চাই। মসজিদের মত মসজিদবাসীকেও সম্মান করতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না, যার কারণে তাদের কোন প্রকারের কষ্ট হয়। উদাহরণস্বরুপ এমন কোন জায়গায় নামাজের জন্য দাঁড়াবেন না, যেখানে দাঁড়ালে অন্যান্য লোকদের আসা যাওয়া করতে কষ্ট হয়। কারণ, মসজিদের লোকদের কষ্ট দেওয়ার অর্থ হল, আল্লাহর জিকিরকারীদের কষ্ট দেওয়া। এমনভাবে কেউ নামাজ পড়তে থাকলে উচ্চস্বরে জিকির করবেন না। কারণ, এতে তার নামাজে সমস্যা হবে। আল্লাহ আমাদের আমল করারও তাওফিক দান করুন।
মূল: হাকিমুল উম্মাত আল্লামা আশরাফ আলি থানভী রাহি.।
অনুবাদ: রেজাউল কারীম আবরার