বাংলাদেশের বিভিন্ন দরবারে বিশেষ করে চট্রগ্রামের অনেক দরবারে দেখবেন রাতব্যাপী সেমা মাহফিলের নামে গান, বাজনা চলে। ওইদিন জামেয়া আহমদিয়ার একজন মুফতির বক্তব্য দেখলাম যে, মা’রেফতের নামে বাজনাসহ গান নামক সেমা জায়েজ ফতোয়া দিয়ে চলে এসেছেন!
ইসলামে বাজনা সুপ্রতিষ্ঠিত হারাম। চার মাজহাবের ইমামদের মতে হারাম। অসংখ্য নস দ্বারা প্রমাণিত হারাম। এক দুটি হাদিসের অপব্যাখ্যা করে যারা বাজনাকে হালাল বলতে চেয়েছেন, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রাহি. থেকে শুরু করে উম্মাহর মহান ইমামগণ সেগুলো শক্তহাতে খÐন করেছেন।
আজকের পর্বে বাজনা হারাম হওয়ার ব্যাপারে আমরা স্পষ্ট কয়েকটি হাদিস পেশ করছি। যাতে হাদিসের আলোকে বাজনার বিধান আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশনার পর আশা করি আমাদের আর কারও এ বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন পড়বে না।
১আবু মালিক আশআরি রাযি. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ وَلَيَنْزِلَنَّ أَقْوَامٌ إِلَى جَنْبِ عَلَمٍ يَرُوحُ عَلَيْهِمْ بِسَارِحَةٍ لَهُمْ يَأْتِيهِمْ يَعْنِي الْفَقِيرَ لِحَاجَةٍ فَيَقُولُونَ ارْجِعْ إِلَيْنَا غَدًا فَيُبَيِّتُهُمْ اللَّهُ وَيَضَعُ الْعَلَمَ وَيَمْسَخُ آخَرِينَ قِرَدَةً وَخَنَازِيرَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
অর্থাৎ আমার উম্মতে এমন কিছু লোক হবে, যারা ব্যাভিচার, রেশম, মদ, এবং বাজনাকে হালাল মনে করবে! আবু দাউদ, ৪০৪১, বুখারি ৫৫৯০।
এ হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কিয়ামতের আগে অকাট্য হারাম কিছু বিষয়কে একদল মানুষ হালাল মনে করবে। তার মাঝে একটি হলো, বাজনা।
২. আনাস বিন মালিক রাযি. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
صَوْتَانِ مَلْعُونَانِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ : مِزْمَارٌ عِنْدَ نِعْمَةٍ ، وَرَنَّةٌ عِنْدَ مُصِيبَةٍ
অর্থাৎ দুটি আওয়াজ দুনিয়া এবং আখেরাতে অভিশপ্ত। দুটির একটি হলো, বাজনার আওয়াজ এবং অপরটি জলো, কষ্টের সময় বিলাপের আওয়াজ।- মুসনাদে বাযযার: ৭৫১৩, আল আহাদিসুল মুখতারাহ: ৩/৩০২।
এ হাদিস সম্পর্কে ইমাম হাইছামি রাহি. বলেন:
رواه البزار ورجاله ثقات
অর্থাৎ হাদিসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী সকলেই বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য।-মাযমাউয যাওয়াইদ: ৪০১৭।
এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বাজনার আওয়াজ অভিশপ্ত দুনিয়াতে এবং আখেরাতে। এরপরও কেউ যদি এটাকে হালাল মনে করে, তারচেয়ে বড় হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নাই।
৩. ইমরান বিন হুসাইন রাযি. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
في هذه الأمة خسف ومسخ وقذف فقال رجل من المسلمين يا رسول الله ومتى ذاك ؟ قال إذا ظهرت القينات والمعارف وشربت الخمور
অর্থাৎ এ উম্মতের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ভূমিধ্বস, বিকৃতি এবং প্রস্তার নিক্ষেপের বিপদ আসবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাস করলেন, কখন আসবে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বলেন, যখন গায়িকা বেশি হবে, যখন বাজনা ব্যাপক হবে, মদপান করা হবে তখন।-তিরমিযি: ২২১২।
বাজনা হারাম হওয়ার জন্য এ একটি হাদিসই যথেষ্ট। কারণ, এটির কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব আসে। আর যে কাজ আল্লাহর গজব ডেকে নিয়ে আসে, তা হালাল হওয়ার কোন সূরতই নেই।
৪. নাফে’ বর্ণনা করেন:
أَنَّ ابْنَ عُمَرَ سَمِعَ صَوْتَ زَمَّارَةِ رَاعٍ فَوَضَعَ أُصْبُعَيْهِ فِي أُذُنَيْهِ وَعَدَلَ رَاحِلَتَهُ عَنْ الطَّرِيقِ وَهُوَ يَقُولُ يَا نَافِعُ أَتَسْمَعُ فَأَقُولُ نَعَمْ فَيَمْضِي حَتَّى قُلْتُ لَا فَوَضَعَ يَدَيْهِ وَأَعَادَ رَاحِلَتَهُ إِلَى الطَّرِيقِ وَقَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَسَمِعَ صَوْتَ زَمَّارَةِ رَاعٍ فَصَنَعَ مِثْلَ هَذَا
অর্থাৎ ইবনে উমর রাযি. একবার রাখালের বাজনার আওয়াজ শুনতে পান, তখন তিনি কানে আঙ্গুল দিয়ে দ্রæত রাস্তা পার হয়ে বললেন, এখনও কী শুনা যায়? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর যখন আওয়াজ শুনা গেলো না, তখন হাত ছেড়ে বললেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তার কানে বাজনার আওয়াজ আসলে তিনি কানে আঙ্গুল দিয়ে দ্রæত চলে গেছেন।Ñমুসনাদে আহমদ: ৪৫৩৫।
শায়খ শুআইব আরনাউত রাহি. এ বর্ণনাকে হাসান বলেছেন।
৫. আলী রাযি. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إ ذا فعلت أمتي خمس عشرة خصلة حل بها البلاء فقيل وما هن يا رسول الله قال إذا كان المغنم دولا والأمانة مغنما والزكاة مغرما وأطاع الرجل زوجته و عق أمه وبر صديقه وجفا أباه وارتفعت الأصوات في المساجد وكان زعيم القوم أرذلهم وأكرم الرجل مخافة شره وشربت الخمور ولبس الحرير واتخذت القنيات والمعازف ولعن آخر هذه الأمة أولها فليرتقبوا عند ذلك ريحا حمراء أو خسفا أو مسخا
অর্থাৎ যখন আমার উম্মত ১৫ টি কাজ করবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের উপর মুসবিত আসা বৈধ হয়ে যাবে। ১৫ টির দুটি হলো, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্র তারা গ্রহণ করবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব আসবে।-তিরমিযি: ২২১০।
৬. মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত বিচারক কাজী শুরাইহ এর একটি বিচার আপনি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আবু হাসিন বর্ণনা করেন:
أَنَّ رَجُلاً كَسَرَ طُنْبُوراً لرَجُلِ ، فَخَاصَمَهُ إلَى شُرَيْحٍ ، فَلَمْ يُضَمِّنْهُ شَيْئًا.
এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলে। শুরাইহ এর কাছে বিচার আসলে তিনি তার উপর জরিমানা আবশ্যক করেন নি। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ২৩৬৮৫।
এটা স্পষ্ট যে, বাদ্যযন্ত্র হারাম। আর হারামের জরিমানা হয় না।
এখানে উদাহরণস্বরুপ আমি ৫ টি হাদিস উল্লেখ করলাম। ৫ টি হাদিসই আমাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে যে, বাজনা হারাম। এর বিপরিত ঈদের দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে ঈদের দিন ছোট বাচ্চাদের আবৃত্তির হাদিস দিয়ে বাজনাকে হালাল করা হাস্যকর বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। যে হাদিস দিয়ে আপনি কথিত সেমা বৈধ করার চেষ্টা করছেন, সে হাদিস সম্পর্কে উম্মাহর মহান ইমামগণ যুগে যুগে পর্যালোচনা করে চলে গিয়েছেন! ইসলাম এতটা অসহায় হয়ে যায় নি যে, ভাণ্ডারিদের থেকে হাদিসের ব্যাখ্যা নিতে হবে। আগামী পর্বে আমরা সে হাদিসগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করব ইনশাআল্লাহ।