ইসলামে বিবাহের বয়সসীমা নির্ধারিত নয় কেন?

ইসলামে বিবাহের বয়সসীমা নির্ধারিত নয় কেন?

যারা সবসময় ইসলামের ত্রুটি খুঁজতে ব্যস্ত, তাদের আরেকটি অভিযোগ হলো- ইসলামে বিবাহের কোনো বয়স সীমা নেই। একথা দ্বারা এটা বোঝাতে চায় যে, ইসলাম বয়স সীমা নির্ধারণ না করে জনগনের ওপর জুলুম করেছে।

যারা ইসলামের বিধান নিয়ে আপত্তি তোলার,যদি ইসলাম বিবাহের বয়স সীমা নির্ধারণ করে দিতো, তখনও তারা আপত্তি তুলত যে, ইসলাম বিবাহের বয়স নির্ধারণ করে জুলুম করেছে।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে-
وَابۡتَلُوۡا الۡيَتٰمٰى حَتّٰىۤ اِذَا بَلَغُوۡا النِّكَاحَۚ
তোমরা এতিমদের পরীক্ষা করতে থাকো, যতক্ষণ না তারা বিবাহের উপযুক্ত হয়।

হাদিস শরিফে অন্যত্র এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন-
ﻳَﺎﻣَﻌْﺸَﺮَ ﺍﻟﺸَّﺒَﺎﺏِ ﻣَﻦِ ﺍﺳْﺘَﻄَﺎﻉَ ﻣِﻨْﻜُﻢُ ﺍﻟْﺒَﺎﺀَﺓَ ﻓَﻠْﻴَﺘَﺰَﻭَّﺝْ، ﻓَﺈِﻧَّﻪُﺃَﻏَﺾُّ ﻟِﻠْﺒَﺼَﺮِ ﻭَﺃَﺣْﺼَﻦُ ﻟِﻠْﻔَﺮْﺝِ ﻭَﻣَﻦْ ﻟَﻢْ ﻳَﺴْﺘَﻄِﻊْ ﻓَﻌَﻠَﻴْﻪِﺑِﺎﻟﺼَّﻮْﻡِ ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻟَﻪُ ﻭِﺟَﺎﺀٌ

হে যুবসমাজ! তোমাদেরমধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিবাহ করা কর্তব্য। কেননা বিবাহ হয় দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোজা পালন করে। কেননা রোজা হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম। (বুখারী ৫০৬৫; মুসলিম ১৪০০)

আয়াত এবং হাদিস দ্বারা বোঝা যায় যে, ইসলাম বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা নির্ধারণ না করলেও একটা যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বরের ক্ষেত্রে মনোদৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্য তৈরি হলে এবং কনের ক্ষেত্রে অভিভাবকের উপস্থিতিতে নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী সকল বয়সে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। সর্বোপরি কোনো বয়সসীমা নয়, বরং ছেলেমেয়ের শারীরিক মানসিক ও আর্থিক যোগ্যতাই বিবেচিত হবে। বিয়ের জন্য ছেলেমেয়ের শারীরিক অবকাঠামোগত সামর্থ্য ও সাংসারিক ব্যয়ের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতা অবশ্যই জরুরি। বিবাহের পরেও দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়েরই শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত ও পরিপক্ব হওয়া আবশ্যক। শরয়ি ভাষায় যেটাকে বালেগ বা বালেগা বলে।

যেমন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়শা রা. কে ৬বছর বয়সে বিয়ে করলেও সাংসারিক জীবনে এনেছেন সাবালিকা হওয়ার পরে।
সুতরাং এর দ্বারা বোঝা যায়, বিবাহ করার পরও দৈহিক সম্পর্কের জন্য শারিরীক ও মানসিক পরিপক্বতা জরুরি।
যে বয়সে দৈহিক সম্পর্ক করলে নারীর স্বাস্থ্যহানী হবে। জরায়ু ক্যান্সার, রক্তশূন্যতা, অপুষ্ট শিশু জন্মের আশঙ্কা ইত্যাদি বাড়বে, সর্বোপরি মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে সে অবস্থায় অবশ্যই দৈহিক সম্পর্ক করা উচিত নয়। ইসলাম কখনই এসব সমর্থন করে না বরং অনুৎসাহিত করে ও নিষেধ করে।
বিপরীতে সামর্থ্যবান নারীপুরুষের শরীয়ত মতো বিয়ে অধিকার হরণ করার ক্ষমতাও ইসলাম কাউকে দেয়নি। অভিভাবকের সম্মতিতে, ছেলেমেয়ের শারীরিক মানসিক ও আর্থিক যোগ্যতা বিবেচিত হলে শুধু বয়স সীমার আপত্তি তোলে বিয়ে ভেঙে দেওয়া অনধিকারচর্চা। কারও জীবনে এই অনধিকারচর্চাটা অভিশাপ হয়েও দেখা দেয়।

বিয়ের বয়স একটি আপেক্ষিক বিষয়। বয়স সীমা নিয়ে চলমান যুক্তি তর্কও অবান্তর। অনেকটা গায়ে পড়ে পরের রান্নায় লবন দেওয়ার মতো। কোনো তর্কেই বিষয়টার চূড়ান্ত সমাধান নেই। চূড়ান্ত সমাধান দেয়নি ইসলামসহ কোনো ধর্মেও । স্থান কাল ও অবস্থাবেধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের। যুগ, দেশ এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনে মানুষের দৈহিক কাঠামোতেও পরিবর্তন ঘটে। আরবের মেয়েরা যে বয়সে বিবাহের জন্য উপযুক্ত হয়, আমাদের দেশের মেয়েরা সে বয়সে হয় না। আমাদের দাদিদের যে বয়সে বিয়ে স্বাভাবিক ছিল, বর্তমানে তা অপরাধ মনে করা হয়৷ সুতরাং কোনো ধর্ম কর্তৃক বিয়ের বয়স অনির্ধারিত থাকাটাই কাম্য। পক্ষান্তরে বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া একপ্রকার অনধিকারচর্চা।

স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যখন ১৩ ও বেগম ফজিলাতুন্নেসার বয়স যখন মাত্র তিন, তখন পরিবারের বড়রা তাদের বিয়ে ঠিক করেন। ১৯৩৮ সালে বিয়ে হবার সময় রেনুর বয়স ছিল ৮ বছর ও শেখ মুজিবের ১৮ বছর। অপর দিকে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বিয়ে করেন মৃণালিনী দেবী রায়চৌধুরীকে। বিয়ের সময় তার বয়স ছিল ৯ বছর আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ২২ বছর।
তখনকার সময়ে বিষয়টা তেমন অসামাজিক বা কলঙ্কের বিষয় ছিলো না বরং তা ছিলো খুবই স্বাভাবিক।

১৮৯১ সালের ইংরেজ শাসনামলে স্ত্রীর বয়স ১২ আইন পাস করা হলে হিন্দুসমাজে প্রচুর প্রতিবাদ ওঠে। ইংরেজরা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ ও হিন্দু সংস্কৃতি নষ্ট কারার অভিযোগও করেন হিন্দুরা। কারণ মনুসংহিতায় বলা হয়েছে- মেয়েদের আট বছর বয়সের মধ্যেই বিবাহ দিতে হবে। হিন্দুসমাজে আট বছরবয়সী মেয়েকে বলা হয় গৌরী। নয় হলে রহিনী। হিন্দু মেয়েদের এগারো বছরের আগে বিয়ে না হলে অভিভাবক নরকে যাওয়ার হুমকিও আছে।

বাস্তবতা হলো বিয়ের জন্য বয়স বাধা নয়। বাধা হলো যোগ্যতা। বয়স আঠারো হোক বা ষোল; বৃদ্ধ বাবা মা যদি যোগ্য ছেলেমেয়েকে সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম মেনে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের কি অধিকার আছে বাধা দেওয়ার? মেয়ের সামাজিক নিরাপত্তা, ছেলের চারিত্রিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য বৃদ্ধ বাবা মায়ের এই আয়োজন কি কল্যাণকর নয়? তাহলে বয়সের দোহাই তোলে বিয়ে বাড়িতে পুলিশি নাটক সাজিয়ে একজন উপযুক্ত ছেলে ও মেয়ের জীবনে অভিশাপের কলংক লেপন করার অধিকার সরকার সংরক্ষণ করে কি? নারীবাদী সমাজকর্মীদের আত্মচিৎকার,রাষ্ট্রের সব আইন ও ধর্মের সব বিধান যদি মানুষের কল্যাণে হয়, তাহলে স্থান কাল ও পাত্র কেন বিবেচিত হবে না ?

বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ থাকবে, বিয়ের জন্য বয়স সীমার নির্ধারণ করে আইন নয়; বরং নারীপুরুষের সামগ্রিক কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সরকারি নীতিমালা বা সুপারিশ থাকতে পারে।
সমাজে আমরা দেখে থাকি, কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা অবাধে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। ফ্রি মিক্সিং এবং অবাধ মেলামেশার কারণে অহরহ গণধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কোনো আইন নেই, কিন্তু যখন উভয়ের পরিবারের সম্মতিতে একজন ছেলে এবং মেয়েকে শরিয়তের আইন মেনে বিবাহ দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তখন এসে সব আইন প্রয়োগ করা হয়।

গল্প-নাটক বা সিনেমায় আমরা ১৪/১৫ বছরের কিশোরীদের প্রেম করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি, কিন্তু বিবাহ করাকে অপরাধ বলছি। আপনি এটা কীভাবে আলাদা করে ভাবেন, একটা কিশোরী প্রেম করার যোগ্য, ফ্রি মিক্সিংএর যোগ্য, কিন্তু বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত না?
একটা মেয়ে ১৮ বছরের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে পুলিশ আসে না বাসায়, ১৮বছরের আগে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেলেও কোনো আইনি পদক্ষেপ দেখা যায় না; কিন্তু ১৮বছরের আগে শরয়ীভাবে ছেলেমেয়ে এবং উভয় পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে দিলে বিয়ের আসরে পুলিশ আসে। আইনি জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *