কুরআন মজীদ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য পর্দার বিধান দান করেছে। এটি শরীয়তের একটি ফরয বিধান। একজন মুসলিম হিসেবে এ বিধানের প্রতি সমর্পিত থাকা ঈমানের দাবি।
আফসোসের বিষয় হলো- বর্তমানে ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান মুসলিম পরিচয় বহনকারীদের দ্বারা আক্রমণেরও শিকার। যার মধ্যে একটি হচ্ছে পর্দার বিধান। ইসলামের এই বিধানগুলো শুধু আমাদের আখেরাতে নাজাতেরই উপায় নয়, আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্থি ও পবিত্রতারও রক্ষাকবচ। পর্দার বিধান ইসলামী শরীয়তের পক্ষ থেকে সাধারণভাবে সমাজ-ব্যবস্থার এবং বিশেষভাবে উম্মতের মায়েদের জন্য অনেক বড় ইহসান। এই বিধানটি মূলত ইসলামী শরীয়তের যথার্থতা, পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের জন্য অমোঘ বিধান হওয়ার এক প্রচ্ছন্ন দলিল। এছাড়াও পর্দা নারীর মর্যাদার প্রতীক এবং ইফফাত ও পবিত্রতার একমাত্র উপায়।
পর্দা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য, একথা বললে ভুল হবে। ইসলাম পুরুষের জন্যেও পর্দার বিধান নাযিল করেছে। তবে নারীপুরুষ উভয়ের শরীরের কাঠামো অনুযায়ী পর্দার ধরণও ভিন্ন।
আল্লাহ তা’লা সুরা নুরে বলেন-
قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ
(হে নবী!) মুমীনদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। (আয়াত:২৯)
এর পরের আয়াতে নারীদেরকেও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে তাদেরকে বাহ্যিক পর্দার বিধানও জারি করা হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তার কারণে।
নারীর ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো, শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলাম নারীর জন্য পর্দার সীমারেখা দেওয়ার আগেও বলেছে তাদেরকে ঘরে থাকতে। ঘরে থাকাটা পর্দার সহিত বের হওয়ার চেয়েও নিরাপদ।
وقرن في بيوتكن ولا تبرجن تبرج الجاهليه الاولى
নিজেদের গৃহ মধ্যে অবস্থান করো এবং পূর্বের জাহেলী যুগের মতো সাজসজ্জা দেখিয়ে বেড়িও না। (সুরা আহযাব:৩৩)
ইসলাম কারও প্রয়োজনকে অস্বীকার করে না বলেই পর্দার সাথে বাইরে বের হতে অনুমতি দিয়েছে। তবে এমন পর্দা, যার দ্বারা পুরো শরীর আবৃত হয়। যাতে তাদের সৌন্দর্যের কিছুই দেখা না যায়। তবে যা অনিচ্ছায় বের হয়ে আসে তা ছাড়া। মূলত ফিৎনার আশংকাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাতিরেকেই এই নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম।
وقل للمؤمنات يغضضن من ابصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن الا ما ظهر منها
(হে নবী!) মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। (সূরা নূর : ৩১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, ‘সাধারণত যা প্রকাশিতথ অর্থ হচ্ছে কাপড়।-তাফসীরে তাবারী ১৮/১১৯
আল্লাহ তা’লা নারীদের প্রতি পুরুষের একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তা’লা বলেন-
زين للناس حب الشهوات من النساء
মানুষের জন্য নারীর প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে। (সুরা আলে ইমরান:১৪)
প্রত্যেকেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে।
বিজ্ঞান বলে- একজন পুরুষ যখন কোনো মহিলাকে অনাবৃত দেখে, তখন তার মস্তিষ্কের যে কোষ আছে, যেটা সেক্সুয়াল এক্টিভিটিসকে কন্ট্রোল করে, সেটা এক্টিভ হয়ে যায় এবং স্বাভাবিকভাবে সেক্সুয়াল থটস বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের সেই কোষ এক্টিভ হয়ে রক্তচলাচল বেড়ে গিয়ে নিচের দিকে স¤প্রসারিত হতে থাকে। ফলে মহিলার প্রতি তার একটি অস্বাভাবিক আকর্ষণ তৈরি হয়ে অনেকসময় এমন অবস্থারও তৈরি হয় যে, মস্তিষ্কের কোষটি বøক হয়ে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়। এর থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তা’লা নারী-পুরুষের ওপর পর্দার বিধান নাযিল করেছেন।
পুরো পৃথিবীতে সবচে বেশী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেসব দেশে, যেসব দেশে নারীরা পর্দাহী অর্ধলঙ্গ অবস্থায় চলাফেরা করে। ধর্ষণের মধ্যে একনাম্বারে আছে আমেরিকা। দৈনিক জনকন্ঠের একটি তত্ত¡মতে প্রতি ৬জনে একজন নারী ধর্ষিত হয় আমেরিকায়। এই তালিকায় দ্বিতীয়তে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তৃতীয়তে সুইডেন, চতুর্থতে ইন্ডিয়া ও পঞ্চমে আছে যুক্ত্রাজ্য। এসব দেশে লক্ষ্য করলে দেখবেন, নারী স্বাধীনতার নামে তারা মহিলাদেরকে অনাবৃত অবস্থায় চলাফেরা করতে উৎসাহিত করে। ফলে দিনদিন ধর্ষণের হার বাড়তেই থাকে।
পক্ষান্তরে সৌদি আরবে এমন ঘটনা বিরল। তারা পর্দার বিধান মেনে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করা এবং এর শাস্তি ইসলামি বিধান অনুযায়ী হওয়ায় এসব ঘটনা নেই বললেই চলে।
মূলত ইসলামই হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু আমাদের কিছু অতি বুদ্ধিজীবী লোকেরা ইসলামকে ওভারটেক করে নিজেদের ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে যত সমস্যা বাঁধায়। আসলে এরা নারীর অধিকার চায় না। তারা নারীদেরকে ভোগের বস্তুতে পরিণত করতে চায়। তারা চায় তাদের লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে নারীদেরকে উপভোগ করতে। শিয়াল সবসময় মুরগির স্বাধীনতা চায়, তবে সেটা কখনো মুরগির কল্যাণের জন্য না বরং তার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যেই।
পৃথিবীর সমস্ত মূল্যবান বস্তু আবৃত থাকে। হিরা, মণিমুক্তা, সোনারূপা থেকে নিয়ে পৃথিবীর যত দামী বস্তু আছে, সবকিছুই থাকে মাটির নিচে, সাগরের নিচে ঝিনুকের পেটে। আল্লাহ তা’লা নারীদেরকে বাড়তি সম্মান দিয়েছেন বলেই তাদেরকে পরপুরুষের সামনে আবৃত থাকতে বলেছেন। যাতে করে তার অধিকৃত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ লোলুপ দৃষ্টিতে দেখতে না পারে।
পর্দাহীনতার ক্ষতি
পর্দাহীনতার ক্ষতি বা অপকার অসংখ্য, যার কিছু হলো:
১. পবিত্রতা এবং সতীত্ব মানুষের সবচাইতে বড় সম্পদ। সতীত্ব মানুষের সম্পর্কের ভিত্তি। পারিবারিক সম্পর্কের মূল; এবং মানবীয় বংশ-প্রজন্মের সংরক্ষক। যদি সতীত্ব লীন হয়ে যায় তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে পড়ে।
২. মানুষের প্রতিপালনে ভালোবাসা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু যে পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যকার ভরসা নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে প্রতি মুহূর্তে ঘৃণা জন্ম নিতে থাকে। ভালোবাসার নামগন্ধও সেখানে নজরে পড়ে না। ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে সন্তান একেবারে বেপরোয়া হয়ে যায়। তার সঠিক প্রতিপালন আর সম্ভব হয় না। এভাবে ঘরও ধ্বংস হয়ে যায় এবং সন্তানও।
৩. পর্দাহীনতার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অবিশ্বাস তৈরি হয়। হার্দিক বোঝাপড়া থাকে না। ঘরের মধ্যে কোনো প্রকারের শান্তি ও প্রশান্তি আর দেখা যায় না।
৪. বংশ সমাজেরই একটি মৌলিক উপাধান। যখন বংশধারাই নড়বড়ে হয়ে পড়ে তখন সমস্ত সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
৫. মানুষ প্রতি মুহূর্তে প্রশান্তির সন্ধান করে। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই, সমাজে তার অবস্থান যেমনই হোক না কেন, প্রশান্তির সন্ধানে থাকে। কিন্তু আত্মার প্রশান্তি এবং শারীরিক ও দৈহিক স্বস্তি ব্যতীত বাস্তবিক প্রশান্তি কল্পনা করা যায় না। আর এমন প্রশান্তি কেবল স্ত্রীর সাথে বৈধ সম্পর্কের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। এই সম্পর্ককে মজবুত করবার জন্য প্রধান ভূমিকাই পালন করে পর্দা ও দৃষ্টির হেফাজত। বেপর্দা এবং বেপরোয়া নজর এই সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে মানুষকে সম্পূর্ণরূপে আত্মিক প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত করে ফেলে।
৬. পর্দাহীন পরিবেশ এবং সতীত্বমুক্ত সমাজে বংশধারা ও পরিবার-ব্যবস্থা একদমই ধ্বংস হয়ে পড়ে, সম্পর্কগুলো লীন হয়ে যায়। প্রতিটি সম্পর্কের সূচনার মূলে থাকে কেবল প্রবৃত্তির চাহিদা, যা কয়েক সপ্তাহ, আবার কখনো মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই ফুরিয়ে আসে।