ইবনে মাসউদ রা. সূরা ফালাক এবং নাস কে কুরআনের অংশ মনে করতেন না?

আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত সাহাবিদের একজন। ৫৯৪ সালে মক্কার তামিম গোত্রে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াতপ্রদান শুরু করলে প্রথম দিকেই তিনি ইসলামগ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে চারজন ব্যক্তি থেকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশপ্রদান করেছিলেন সাহাবিদেরকে, তিনি তাদের একজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ
رضيت لأمتي ما رضي لها ابن أم عبد
অর্থাৎ, আমি উম্মতের জন্য সে বিষয়ের উপর সন্তু’, যে বিষয়ের উপর ইবনে মাসউদ সন্তু’। আল মুসতাদরাক, হাদীস নং, ৫৩৮৩৪, মুসতাফা আবদুল কাদির আতা তাহকিককৃত।

আলি রা. খেলাফত লাভ করার মুসলমানদের রাজধানী মদিনা থেকে ক‚ফায় স্থানান্তর করেন। ক‚ফায় তিনি যখন যান, তখন ইবনে মাসউদ রা. ইন্তেকাল করে পরকালের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। আর ইতিহাস বলে মুসলমানরা ১৭ হিজরিতে ক‚ফা বিজয় করেছিলো। ক‚ফার মানুষ তাদের শিক্ষক স্বরুপ সেখানে একজন সাহাবিকে প্রেরণ করার দাবি জানায়। উমর রা. তার প্রয়োজন থাকার পরও ইবনে মাসউদ রা. কে সেখানে প্রেরণ করেন। আলি রা. ক‚ফায় গিয়ে সেখানকার অবস্থা দেখে দোয়া করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ইবনে মাসউদ রা. এর উপর রহম করুন। তিনি পুরো ক‚ফা শহরকে ইলম এবং হিকমাহ দ্বারা ভরে দিয়েছেন।

প্রাচ্যবিদরা খুটিয়ে খুটিয়ে কুরআন, হাদীস পড়ে। কীভাবে কুরআন হাদীসের মোড়কে মানুষকে ইসলাম বিদ্বেষি বিষ খাওয়ানো যায়। কোথায় কোনোভাবে একটি পেয়ে গেলেই শুরু হয়ে যায় তাদের চেঁচামেচি! তাদের বিষ খুব ভালো করে চেটে খান আমাদের দেশের কিছু মুক্তমনা মুসলিম বিদ্বেষি।

ডেভিড স্যামুয়েল ম্যারগোলিয়থ খুব জোর দিয়ে একথা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, কুরআন অবিকৃত নয়। সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে যেভাবে ইচ্ছে দলিল উল্লেখ করেছেন! ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত একটি বর্ণনা দ্বারা তিনি উলঙ্গ উল্লাস প্রকাশ করেছেন! কুরআনের শেষ দুটি সূরা হলো সূরা ফালাক এবং নাস। ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, সূরা ফালাক এবং নাস কুরআনের অন্তরভ‚ক্ত নয়।

প্রথমে ইবনে মাসউদ রা. এর বর্ণনা উল্লেখ করছি। আবদুর রহমান বিন ইয়াজিদ বর্ণনা করেনÑ
كان عبد الله، ” يحك المعوذتين من مصاحفه، ويقول: إنهما ليستا من كتاب الله
অর্থাৎ আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. তার মুসহাফ থেকে সূরা ফালাক এবং নাস মুছে ফেলেন। তিনি বলেন, এ দুটি সূরা কুরআনের অন্তর্ভূক্ত নয়। আল মুজামুল কাবির, তাবারানি, হাদিস নং ৯১৫০
এ বর্ণনায় ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, এ দুটি সূরা কুরআনের অন্তর্ভূক্ত নয়। সুতরাং আর তাদের আটকায় কে? এবার আপনাদের বিপরিত আরেকটি চিত্র দেখাই।

জয়িফ সনদে দাইলামি ইবনে মাসউদ রা. এর একটি উক্তি বর্ণনা করেছেন। আলি মুত্তাকি হিন্দি এবং জালালুদ্দিন সুয়ূতি রহ. সেটি উল্লেখ করেছেন। ইবনে মাসউদ রহ. বলেনÑ
استكثروا من السورتين يبلغكم الله بهما في الآخرة المعوذتين
অর্থাৎ তোমরা সূরা ফালাক এবং নাস বেশি করে তেলাওয়াত করো। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে তোমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ২৭৪৩; জামিউল আহাদিস, হাদিস নং ৩৩২৮,

ইবনে মাসউদ রা. আগে বললেন যে, এটি কুরআনের অন্তর্ভূক্ত নয়। এখন আবার বলেন বেশি করে এ দুটি সূরা পড়তে! কি চমৎকার ডাবল স্ট্যান্ডার্ড! বাস্তবতা কিন্তু এমন না। উম্মাহর গবেষক আলেমকগণ বলেছেন যে, ইবনে মাসউদের যে বর্ণনা তাবারানি উল্লেখ করেছেন, সেটি বাতিল। বিশুদ্ধ নয়। মাত্র কয়েকজনের বক্তব্য আমি এখানে উল্লেখ করছি।
ইমাম নববি রহ. বলেনÑ
أجمع المسلمون على أن المعوذتين والفاتحة من القرآن وأن من جحد منها شيئا كفر وما نقل عن ابن مسعود باطل ليس بصحيح.
অর্থাৎ সকল মুসলমান এ বিষয়ে একমত যে, সূরা ফালাক, নাস এবং ফাতেহা কুরআনের অন্তর্ভূক্ত। কেউ অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে। আর ইবনে মাসউদ রা. থেকে যে কথা বর্ণিত হয়েছে, সেটি বাতিল। সহিহ নয়। আল মাজমু শারহুল মুহাজ্জাব, ৩/৩৯৬, দারুল ফিকর, বায়রুত।

ইমাম ইবনে হাজম জাহিরি রহ. বলেন:
هَذَا كَذِبٌ عَلَى ابْنِ مَسْعُودٍ مَوْضُوعٌ وَإِنَّمَا صَحَّ عَنْهُ قِرَاءَةُ عَاصِمٍ عَنْ زِرٍّ عَنْ ابن مسعود وفيها الفاتحة والمعوذتان
এটি ইবনে মাসউদ রা. এর নামে মিথ্যাচার এবং তার নামে বানানো বর্ণনা। সহিহ বর্ণনায় ইমাম আসিমের কেরাতে যির ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। সেখানে সূরা ফাতেহা, ফালাক এবং নাস রয়েছে। আল মাজমু, ৩/৩৯৬

ইমাম আবু বকর বাকিল্লানি রহ. বলেন:
لم يصح عنه أنها ليست من القرآن ولا حفظ عنه. إنما حكها وأسقطها من مصحفه إنكارا لكتابتها لا جحدا لكونها قرآنا لأنه كانت السنة عنده ألا يكتب في المصحف إلا ما أمر النبي صلى الله عليه وسلم بإثباته فيه ولم يجده كتب ذلك ولا سمعه أمر به.
এটি মোটেও ইবনে মাসউদ রা. থেকে প্রমাণিত নয় যে, এই সুরাদ্বয় কুরআনের অংশ নয়। কুরআনের অংশ হিসাবে অস্বীকার করে তিনি এই সুরাদ্বয়কে তার মুসহাফ থেকে মোছেননি বা বাদ দেননি।তার নিকট বিষয়টি এরূপ ছিল যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ব্যতিত কিছুই মুসহাফে লিখতেন না।এবং তিনি এ ব্যাপারে কিছু লিখিত পাননি বা এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ শোনেননি। আল ইতকান, ১/২৭১

আবু হাফস ইবন আদিল আল হাম্বলি রহ. লিখেন:
هذا المذهب عن ابن مسعود نقل كاذب باطل
অর্থাৎ ইবনে মাসউদ রা. এর থেকে বর্ণিত এই অভিমতটি মিথ্যা ও বানোয়াট। আলবাব ফি উলূমিল কিতাব, ১/১/২৪৯

আল খাফাজি রহ. বলেন:
وما نقل عن ابن مسعود رضي الله عنه من أنّ الفاتحة والمعوّذتين ليست من القرآن لا أصل له
‘অর্থাৎ ইবন মাসউদ রা. থেকে সুরা ফাতিহা, ফালাক এবং নাছ কুরআনের অংশ নয় মর্মে যা বর্ণিত হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই। ইনায়া আল কাযি ওয়া কিফায়া আর রাজি ‘আলা তাফসিরুল বাইযাওয়ি, ১/২৯

এছাড়া সকল মুতাওয়াতির কেরাতের মধ্যেই সুরা ফালাক ও সুরা নাস বিদ্যমান রয়েছে। (এবং অবশ্যই সুরা ফাতিহাও সেগুলোতে রয়েছে।)। এই কেরাতগুলোর মাঝে চারটি কেরাত এমন, যেগুলোর সনদ তথা বর্ণনাক্রম ইবনে মাসউদ রা. হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন ইবনে মাসউদ রা.। তার থেকে শুনেছেন অন্যান্যরা।
নিম্নে আবদুল্লাজ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণণাকৃত কিরাতগুলো একটু খেয়াল করুন।
* আসেম এর কেরাত। এ কেরাত আসেম বর্ণনা করেন যির থেকে, তিনি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। আন নাশর ফি কিরাআতিল আশর, ১/১৫৫
* হামজা এর কেরাত, হামজা বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। আন নাশর ফি কিরাআতিল আশর: ১/১৬৫
* কুসাই এর কেরাত, এর বর্ণণাক্রমও আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে।
* খালাফ এর কেরাত, এর বর্ণণাক্রমও আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। আন নাশর ফি কিরাআতিল আশর: ১/১৭২, ১৮৫

ই মুতাওয়াতির কিরাতগুলোর সনদ তথা বর্ণাক্রমের মধ্যে আবদুল্লাহ বিন মাসউ রা. রয়েছেন এবং কেরাতগুলোর প্রত্যেকটিতে সূরা ফাতিহা, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস রয়েছে। এরপরও যদি কেউ সন্দেহ করেন যে, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এগুলোকে কুরআন মনে করতেন না, তাহলে আপনি বাংলাদেশি হলে পাবানার টিকেট কনফার্ম করুন। ভালো চিকিৎসকের অধীনে নিবীড় চিকিৎসাগ্রহণ করুন।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *