এক. কুরআন অবিকৃত গ্রন্থ
আমাদের নবী হলেন সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। পূর্বেও আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন নবী এবং রাসূলদের উপর আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের উম্মতরা সেগুলো বিকৃত করে ফেলে। পূর্ববর্তি কোনো নবীর উপর অবতীর্ণ কোনো কিতাব আজ আমাদের কাছে অবিকৃত নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন একমাত্র কিতাব, যা কোনো ধরনের বিকৃতির সম্মুখীন হয়নি। মহান আল্লাহ তায়ালা যেভাবে আসমান থেকে অবতীর্ণ করেছেন, চৌদ্দশত বছর সেভাবে এখনো আছে।
পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। তিনি পবিত্র কুরআনে স্প’ ঘোষণা করেছেন ‘
‘নিশ্চয় আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষণাবেক্ষণ করব।’. সূরা হুজর, আয়াত নং ১০
ইসলামের প্রথম দিকে কাফেররা পবিত্র কুরআন নিয়ে সন্দেহ করেছে। কখনো বলেছে এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বানিয়েছেন। অথচ তারা সকলেই এটা জানতো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াবি শিক্ষা কারো থেকে অর্জন করেননি। এজন্য তিনি নিজের পক্ষ থেকে কুরআন বানিয়ে ফেলা সম্ভব ছিল না। কখনো বলেছে জ¦ীনরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এগুলো শিখিয়েছে। কখনো বলেছে তিনি একজন যাদুকর। যাদুর মাধ্যমে এ গ্রন্থ তৈরী করেছেন।
কুরআন জায়গায় জায়গায় তাদের চ্যালেঞ্জ করেছে। প্রথমে বলেছে, যদি তোমরা মনে করো যে, কুরআন মানুষের তৈরী, তাহলে কুরআনের মত আরেকটি কুরআন তোমরা সকলে মিলে বানিয়ে দেখাও। তারা এতে ব্যর্থ হয়েছে। কুরআন তাদেরকে আরেকটু সহজ চ্যলেঞ্জ দিয়েছে। তাহলে কুরআনের দশটি সূরার মত সূরা বানিয়ে দেখাও। কুুরআন তখন একেবারে সহজ চ্যলেঞ্জ দিয়েছে। তাহলে কুরআনের ছোট একটি সূরার মত সূরা বানিয়ে দেখাও। আরবের সকল বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিকগণ একত্রিত হয়েছে। দিনেরপর দিন প্রাণপণ চে’া করেছে। কিন্তু কুরআনের মত ছোট একটি সূরাও বানাতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তারা ঘোষণা করেছে যে, এটি মানুষের তৈরী কোনো গ্রন্থ নয়। এভাবে যুগেরপর যুগ কুরআন যুগের সকলকে চ্যলেঞ্জ দিয়ে রেখেছে। যদি কুরআন সম্পর্কে সন্দেহপোষণ করো, তাহলে কুরআনের ছোট সূরার মত একটি সূরা বানিয়ে দেখাও। কিন্তু আজও পর্যন্ত কেউ কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি।
দুই. প্রাচ্যবিদদের সুযোগ বুঝে কুপ মারার কৌশল
প্রাচ্যবিদরা অবশ্য সরাসরি কুরআনকে বা কুরআনের আয়াতকে অস্বীকার করার সাহস করেনি। করলে সেটা ধুপে ঠিকবে না। এজন্য তারা সুযোগ বুঝে কুপ মারার চেষ্টা করেছে। হাদীস ঘাটাঘাটি করে একটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা করেছে যে, কুরআনের কিছু আয়াত ছাগল খেয়ে ফেলেছিলো। আর যেগুলো ছাগল খেয়ে ফেলেছে, সেগুলোতো আমাদের কাছে পৌঁছেনি, এজন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কুরআন হুবহু আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেনি। কিছুটা কমবেশি হয়েছে!
প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ডেভিড স্যামুয়েল ম্যারগোলিয়থ এ অভিযোগ বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। নাস্তিকপাড়া এ অভিযোগ নিয়ে বেশ লাফালাফি করেছে। দলিলস্বরুপ ইবনে মাজায় বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়। মুক্তমনা ব্লগার কুখ্যাত অভিজিত রায়ের বক্তব্য দেখুন-
‘আয়শা বর্ণিত-পাথর মারা ও প্রাপ্ত বয়স্কদেরকে স্তন্য পান করানোর বিষয়ে যে আয়াত নাযিল হয়েছিল, তা একটা পাতায় লিখে আমার বিছানার নিচে রাখা হয়েছিল।যখন নবী মারা গেলেন আর আমরা তার দাফন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন একটা ছাগল ঘরে ঢুকে আয়াত লেখা পাতা খেয়ে ফেলে। ইবনে মাজা, হাদীস-১৯৩৪
এ থেকে বোঝা যায় সেই সময় কোরানের আয়াতসমুহ কি ভাবে বিরাজমান ছিল। এভাবে ছাগলে যদি আয়াত লেখা পাতা খেয়ে ফেলে, আরও কত ছাগল বা দুম্বা আয়াত লেখা পাতা খায় নি বা পাগলে আয়াত লেখা পাতা বা চামড়া ছিড়ে ফেলে নি তার নিশ্চয়তা কোথায় ? এসব হাদীস থেকে পরিস্কার যে- সেই সময়ে সুষ্ঠুভাবে কোরানের আয়াত গুলোকে সংরক্ষণ করা হতো না অথচ যা ছিল ইসলামের মতে দুনিয়ার সবচাইতে মূল্যবান দলিল।’
কি বুঝলেন? প্রাচ্যবিদদের অভিযোগকে রঙ লাগিয়ে কত সুন্দরকে উপস্থাপন করলেন অভিজিৎ রায়। এবার আসুন, এ হাদীস এবং তাদের আপত্তির জবাব নিয়ে আলোচনা করি।
তিন. কুরআন সংক্রান্ত অভিযোগ এবং জবাব
হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করার আগে আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলি। মনে করুন আপনার প্রিয় একজন শিক্ষক আছেন। তাকে আপনি সব সময় ফলো করেন। তিনি আপনাকে যে নির্দেশনা প্রদান করেন, আপনি সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তিনি যা করতে নিষেধ করেন, সেটা আপনি কখনো করতে যান না।
তিনি আপনাকে দির্দেশ দিয়েছেন প্রতিদিন সকালে হেটে এসে দুই গ্লাস পানি খেয়ে তারপর ঘুমাতে। নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে প্রতিদিন আপনি নির্দেশ পালন করা শুরু করে দিয়েছেন। তারপর একটি কাগজে লিখে সেটা ঘরের এক কোণে লিখে রাখলেন। আপনি প্রতিদিন তার নির্দেশ পালন করেই চলছেন। কয়েকদিন পর দেখলেন ছোট কাগজটি ইদুর খেয়ে ফেলেছে। এর অর্থটি আপনার শিক্ষরের নির্দেশনা একেবারে হারিয়ে গেছে?
সামান্য বিবেক থাকলে আপনি বলবেন, ইদুর খেয়ে ফেললেও আপনার শিক্ষকের নির্দেশনা হারিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আপনিতো প্রতিদিন তার নির্দেশনা পালন করে চলছেন। আপনি এখন চাইলে হুবহু আবার লিখে ফেলতে পারবেন।
এ সহজ বিষয়টি বারবার বুঝতে চায় না। ইনিয়ে-বিনিয়ে বারবার একই অভিযোগ তুলে বসে। কুরআনের নির্দেশনা মুসলমানদের উপর আসত, সাথে সাথে সেটার উপর তারা আমল শুরু করে দিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দি’ সাহাবাদের দ্বারা সেটা লিখে রাখতেন।
আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীস যদি সহিহ এবং রহিত না হয়, তারপরও আমরা বলব যে, কুরআনের কোনো বিধান কোনো সাহাবির সাথে নির্দি’ ছিলো না। কুরআনের বিধান সকল মুসলমানদের জন্য। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনসমক্ষে কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাতেন। সকলেই সাথে সাথে আমল শুরু করে দিত। সুতরাং ছাগল খেয়ে ফেললেও আয়াত হারিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্য কোনো সাহাবির কাছে নিশ্চয় সে আয়াত ছিলো।
এবার আসুন আয়েশা রা. এর বর্ণনা নিয়ে আলোচনা করি। হাদীস শাস্ত্রের একটি স্বীকৃত মূলনীতি হলো, কোনো বিষয় প্রমাণ করতে হলে সে সম্পর্কে বিশুদ্ধ বর্ণনা পেশ করতে হবে। অগ্রহণযোগ্য কোনো বর্ণনা পেশ করা যাবে না। ডেভিড স্যামুয়েল ম্যারগোলিয়থ এবং অভিজিৎ রায়ের জন্য জরুরী ছিলো, কুরআন সম্পর্কে অভিযোগ করার আগে হাদীস শাস্ত্রের এ সহজ মূলনীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া। অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য হলো, কোনোভাবে ইসলামকে কলুষিত করতে পারলেই হলো। সুতরাং তাদের কাছে নৈতকতার বয়ান করার অর্থ হলো অরণ্যে রোদন করা।
প্রথমে এ সংক্রান্ত আয়েশা রা. এর বর্ণনা দেখুন, তিনি বলেন, ‘রজমের ও বয়স্কদের দশ ঢোক দুধপানের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিলো হয়েছিল এবং সেগুলো একটি সহিফায় (লিখিত) আমার খাটের নিচে সংরক্ষিত ছিল। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন এবং আমরা তাঁর ইন্তিকালে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখন একটি বকরি এসে তা খেয়ে ফেলে।’ সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং ১৯৪৪
এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন মুহাম্মাদ বিন ইসহাক। তিনি عن (আন) শব্দ দ্বারা হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর মুহাম্মাদ বিন ইসহাক হলেন একজন তাদলিসকারী। যেসব বর্ণণাকারী তাদের ঊর্ধ্বতর বর্ণণাকারীর পরিচয়ের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেন তাদেরকে তাদলিসকারী বলা হয়)
এ বর্ণনাটি ইমাম আহমদ ‘মুসনাদে আহমদ’ এ উল্লেখ করেছেন। এ কিতাবের মুহাক্কিক, বিশি’ মুহাদ্দিস শায়খ শুয়াইব আরনাউত রহ. সেখানে হাদীসটিকে জয়িফ তথা দুর্বল বলেছেন। মুয়াত্তা মালেক, হাদিস নং২/২৩৭, ইফা; সনদ সহিহ।
আগে বলেছি যে, ছাগলে খেয়ে ফেলার হাদীসের বর্ণনাকারী হলেন ইবনে ইসহাক। এ হাদীস তিনি বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ বিন আবু বাকর থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাজাহ এবং মুসনাদে আহমদের সে বর্ণনায় ছাগলে খেয়ে ফেলার কথা রয়েছে। কিন্তু একই হাদীস আবু বাকরা থেকে আরো কিছু মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনার দিক থেকে যারা ইবনে ইসহাক থেকে শক্তিশালী।
হাদীসটি ইমাম মালেক রা. ‘মুয়াত্তা মালেক’ এ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মালেক রহ. বর্ণনা করেন আবদুল্লাহ বিন আবু বাকর থেকে, তিনি আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেন-
‘কুরআনে যা অবতীর্ণ হয় তাতে দশবার দুধ চোষার দ্বারা হারাম(মাহরাম) হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিলো। তারপর তা রহিত(মানসুখ) হয়ে যায় পাঁচবার দুধ চোষার দুধ চোষার হুকুম অবতীর্ণ হওয়ার দ্বারা। তারপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকাল হয় তখন পর্যন্ত পাঁচবার দুধ চোষার দ্বারা মাহরাম হওয়ার হুকুম সম্বলিত আয়াত তিলাওয়াত করা হতো।’ শারহু মুশকিলিল আছার, ৪৫৬১
বর্ণনাটি ভালো করে দেখুন! ইবনে ইসহাকের বর্ণনায়ও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মালেকের বর্ণনাও বিষয়টি এসেছে। কিন্তু ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় ছাগল কর্তৃক খেয়ে ফেলার কথা রয়েছে। কিন্তু ইমাম মালেক রহ. এর বর্ণনায় সে কথা নেই। ইমাম তাহাবি ‘শারহু মুশকিলিল আছার’ এর মধ্যেও বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। মুহাক্কিক শায়খ শুয়াইব আরনাউত সে বর্ণনাকে সহিহ বলেছেন। সে বর্ণনায়ও ছাগলে খেয়ে ফেলার কথা বর্ণিত হয়নি।
এর থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, ছাগলে খাওয়ার বিষয়টি ইবনে ইসহাক ভুলে যোগ করেছেন।
ইবনে মাজায় বর্ণিত আয়েশা রা. এর বর্ণনাটি যদিও সহিহও হয়, তারপরও কোনো সমস্যা নেই। কারণ-
এই রেওয়ায়েত অনুসারে দাবিকৃত ‘হারিয়ে যাওয়া’ আয়াত ছিলো দুটি। এরমাঝে ১টি আয়াত ছিল রজমের ব্যাপারে। রজম বলা হয়, বিবাহিত কোনো পরুষ বা মহিলা ব্যভিচার করলে তাদেরকে প্রস্তারাঘাতে মেরে ফেলা। কিন্তু অন্য একাধিক বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে যে, রজমের ব্যাপারে হুকুম অবতীর্ণ হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বিধান কুরআনের অংশ হিসাবে লিপিবিদ্ধ করতে নিষেধ করেন। যদি কুরআনের অংশ হতো এবং রহিত না হত, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্মিনকালেও নিষেধ করতেন না। রাসুলের নিষেধ করা থেকেই সহজেই প্রতিভাত যে, এটি রহিত হয়ে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নিষেধ করেছিলেন, এর প্রমাণ স্বরুপ কয়েকটি বর্ণনা দেখুন-
عن كثير بن الصلت قال : كان ابن العاص و زيد بن ثابت يكتبان المصاحف فمرا على هذه الآية فقال زيد : سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول : الشيخ و الشيخة إذا زنيا فارجموهما البتة فقال عمرو : لما نزلت أتيت النبي صلى الله عليه و سلم فقلت أكتبها فكأنه كره
কাসির বিন সালত থেকে বর্ণিত, জায়দ বিন ছাতি রা. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘যখন কোনো বিবাহিত পুরুষ কিংবা মহিলা ব্যাভিচার করে, তাদের উভয়কে রজম করো।’
এটি শুনেআমর বলেন, ‘যখন আয়াতটি নাজিল হয়েছিল, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম এবং এটি লিপিবদ্ধ করব কিনা তা জানতে চাইলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখতে অপছন্দ করলেন।’ আল মুসতাদরাক, হাদিস নং ৮০৭১; হাকিম নিশাপুরি রহ. বলেন, হাদিসটি সহিহ। যদিও ইমাম বুখারি এবং মুসলিম রহ. হাদিসটি উল্লেখ করেননি। ইমাম জাহাবি রহ.ও বর্ণনাটিকে সহিহ বলেছেন
عَنْ مُحَمَّدٍ قَالَ نُبِّئْتُ عَنِ ابْنِ أَخِى كَثِيرِ بْنِ الصَّلْتِ قَالَ : كُنَّا عِنْدَ مَرْوَانَ وَفِينَا زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ قَالَ زَيْدٌ كُنَّا نَقْرَأُ الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا فَارْجُمُوهُمَا الْبَتَّةَ. قَالَ فَقَالَ مَرْوَانُ : أَفَلاَ نَجْعَلُهُ فِى الْمُصْحَفِ قَالَ لاَ أَلاَ تَرَى الشَّابَّيْنِ الثَّيِّبَيْنِ يُرْجَمَانِ قَالَ وَقَالَ ذَكَرُوا ذَلِكَ وَفِينَا عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ أَنَا أَشْفِيكُمْ مِنْ ذَاكَ قَالَ قُلْنَا كَيْفَ قَالَ آتِى النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- فَأَذْكُرُ كَذَا وَكَذَا فَإِذَا ذَكَرَ الرَّجْمَ أَقُولُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَكْتِبْنِى آيَةَ الرَّجْمِ قَالَ فَأَتَيْتُهُ فَذَكَرْتُهُ قَالَ فَذَكَرَ آيَةَ الرَّجْمِ قَالَ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ أَكْتِبْنِى آيَةَ الرَّجْمِ. قَالَ :্র لاَ أَسْتَطِيعُ ذَاكَ
কাসির বিন সালত বলেন, তিনি এবং জায়দ বিন সাবিত ও মারওয়ান বিন হাকাম আলোচনা করছিলেন যে, কেনো আয়াতটি কুরআনের মুসহাফসমূহে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। উমর রা. তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং তাদের আলোচনা শুনছিলেন। তিনি বললেন, আমি এব্যাপারে তোমাদের থেকে বেশি জানি। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমাকে রজমের আয়াতটি লিখে দেওয়া হোক।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তা করতে পারব না।’ মুসলিম, হাদিস নং ১৪৫২, শায়খ ফুয়াদ আবদুল বাকি তাহকিককৃত।
যদি আলোচ্য আয়াত স্থায়ীভাবে কুরআনের অংশ হিসাবে অবতীর্ণ হতো, তাহলে কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা লিখিয়ে দিতে বললেন না? এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এটি ছিল সেই সমস্ত মানসুখ বা রহিত আয়াতের একটি, যা কোন নির্দি’ সময়ের জন্য অস্থায়ীভাবে অবতীর্ণ হয়েছিল। কাজেই সাহাবীগণ বা উম্মুল মু’মিনীনগণ এই আয়াত ‘হারিয়ে ফেলেছেন’ তা নিতান্তই অসার এবং অহেতুক কথা। প্রাচ্যবিদ এবং আমাদের দেশের কথিত মুক্তমনা নাস্তিকদের এতো কিছু ভাবার সময় কোথায়? ইসলামের বিরুদ্ধে কোনোভাবে বিষোধগার করতে পারলেই মনে করেন কেল্লা ফতেহ! হায় মানসিকতা! হায় উদারতা!
দ্বিতীয় যে আয়াত ‘হারিয়ে গেছে’ বলে দাবি করা হয়, সেটি বয়স্কদের দশ ঢোক দুধপানের ব্যাপারে। । কিন্তু বাস্তবে সেটিও মানসুখ বা রহিত আয়াত। এ ব্যাপারে সহিহ মুসলিমের বিশুদ্ধ বর্ণনার প্রতি পাঠক খেয়াল করলে বিষয়টি সহজেই স্প’ হয়ে যাবে। মুসলিম শরিফে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
كَانَ فِيمَا أُنْزِلَ مِنْ الْقُرْآنِ رَضَعَاتٍ مَعْلُومَاتٍ يُحَرِّمْنَ ثُمَّ نُسِخْنَ عَشْر
بِخَمْسٍ مَعْلُومَات فَتُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيمَا يُقْرَأُ مِنْ الْقُرْآنِ وَهُن فِيمَا يُقْرَأُ مِنَ الْقُرْآنِ.
কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছিল যে, দশবার দুধপানে বিবাহ হারাম হওয়া/মাহরাম হওয়া প্রমাণিত হয়। তারপর তা পাঁচবার দুধপান দ্বারা রহিত হয়ে যায়। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেন আর সেগুলো তো কুরআনের আয়াত হিসাবে তিলাওয়াত করা হত। মুসলিম, হাদিস নং ১৪৫২, শায়খ ফুয়াদ আবদুল বাকি তাহকিককৃত।
’
মুসলিমের এ বর্ণনায় সুস্প’ভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, দশবারের বিধান রহিত হয়ে গেছে।
পাঁচবার দুধপানের বিধানটিও একটি মানসুখ বা রহিত বিধান। এ ব্যাপারে স্বয়ং উম্মুল মু’মিনিনগণ থেকে একটি বর্ণনা রয়েছে। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন,
جَاءَتْ سَهْلَةُ بِنْتُ سُهَيْلِ بْنِ عَمْرٍو الْقُرَشِىِّ ثُمَّ الْعَامِرِىِّ – وَهِىَ امْرَأَةُ أَبِى حُذَيْفَةَ – فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا نَرَى سَالِمًا وَلَدًا وَكَانَ يَأْوِى مَعِى وَمَعَ أَبِى حُذَيْفَةَ فِى بَيْتٍ وَاحِدٍ وَيَرَانِى فُضْلاً وَقَدْ أَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِيهِمْ مَا قَدْ عَلِمْتَ فَكَيْفَ تَرَى فِيهِ فَقَالَ لَهَا النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- ্র أَرْضِعِيهِ গ্ধ. فَأَرْضَعَتْهُ خَمْسَ رَضَعَاتٍ فَكَانَ بِمَنْزِلَةِ وَلَدِهَا مِنَ الرَّضَاعَةِ فَبِذَلِكَ كَانَتْ عَائِشَةُ – رضى الله عنها – تَأْمُرُ بَنَاتِ أَخَوَاتِهَا وَبَنَاتِ إِخْوَتِهَا أَنْ يُرْضِعْنَ مَنْ أَحَبَّتْ عَائِشَةُ أَنْ يَرَاهَا وَيَدْخُلَ عَلَيْهَا وَإِنْ كَانَ كَبِيرًا خَمْسَ رَضَعَاتٍ ثُمَّ يَدْخُلَ عَلَيْهَا وَأَبَتْ أُمُّ سَلَمَةَ وَسَائِرُ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- أَنْ يُدْخِلْنَ عَلَيْهِنَّ بِتِلْكَ الرَّضَاعَةِ أَحَدًا مِنَ النَّاسِ حَتَّى يَرْضَعَ فِى الْمَهْدِ وَقُلْنَ لِعَائِشَةَ وَاللَّهِ مَا نَدْرِى لَعَلَّهَا كَانَتْ رُخْصَةً مِنَ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- لِسَالِمٍ دُونَ النَّاسِ.
‘ সাহলা বিনত সুহাইল রা. ছিলেন আমির ইবনে লুয়াই গোত্রের, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সালিমকে আমরা পুত্ররূপে গ্রহণ করেছিলাম। সে আমার কক্ষে প্রবেশ করে এই অবস্থায় যখন আমি একটি কাপড় পরিধান করে থাকি(অর্থাৎ মাথা খালি থাকে)। আর আমার ঘরও মাত্র একটি। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?’
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ এ বিষয়ে আমাদের কথা হল তাকে দুধ পান করাও।’ তিনি তাকে পাচঁ চোষ দুধ পান করান। ফলে সে তার দুধ সন্তানের মত হয়ে যায়। আয়েশা রা. তার ভাই এবং বোনের মেয়েদের কাউকে এভাবে পুত্র বানালে তাকে পাঁচ চোষ দুধ পান করানোর নির্দেশ প্রদান করেন।
উম্মে সালামা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য স্ত্রীগণ এভাবে দুধ পান করিয়ে হুরমত প্রমাণিত করার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাদের মতে শিশুকে দুধ পানের বয়সে থাকাবস্থায় দুধ পান করালে এ হুরমত প্রমাণিত হবে। তারা আয়েশা রা. কে বলেন, হয়ত এটি সালিমকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে সুযোগ প্রদান করেছিলেন। অন্য কারো জন্য এ বিধান প্রযোজ্য নয়। আবু দাউদ, হাদিস নং ২০৬১; মুহি উদ্দিন আবদুল হামিদ তাহকিক কৃত
এই বিবরণগুলো দ্বারা স্প’ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে পাঁচবার ও দশবার দুধপানের বিধান রহিত হয়েছিল।
এছাড়া আরেকটি বিষয় এখানে খেয়াল করি জরুরী। যতদিন ধরে কুরআন সংকলন হয়েছে, আয়েশা রা. তার পূর্ণ সময় জীবিত ছিলেন। আবু বকর রা. কর্তৃক সংকলন ও উসমা রা. কর্তৃক সংকলন উভয় সময়েই আয়েশ রা. একজন গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদানকারী ছিলেন। যদি বাস্তবেই কুরআনের আয়াত হারিয়ে যাবার মত এমন মহা দুর্ঘটনা ঘটতো , তাহলে আয়েশা রা. অবশ্যই সে ব্যাপারে সাহাবিদের দৃ’ি আকর্ষণ করতেন। এছাড়া সে সময়ে প্রচুর পরিমাণে কুরআনের হাফিজ সাহাবি জীবিত ছিলেন, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে কুরআন শিখেছেন। কিন্তু আয়েশা রা. কখনোই এমন কিছু করেননি।
বিষয়টি আরেকটু ক্লিয়ার করি। বর্তমানে বিভিন্নভাবে মানুষের কাছে কুরআন শরিফ রয়েছে। কারো কাছে প্রিন্ট কপি, কারো কাছে কলম দিয়ে লেখা কপি, কারো কম্পিউটারে বা ল্যাপটপে কুরআনের এপস রয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষ কুরআন তেলওয়াত করে। এখন ধরুন, বর্তমান পৃথিবীর কোনো প্রভাবশালী পাষণ্ড কুরআনের যত কপি আছে, চাই সেটা প্রিন্ট হোক বা হাতের লেখা হোক, এক জায়গায় একত্রিত করে জ¦ালিয়ে দিলো। মানুষের মোবাইলে এবং কম্পিউটারে যত এপস রয়েছে, সব ডিলেট করে দিলো। তাহলে কি পৃথিবী থেকে কুরআনকে মুছে ফেলা সম্ভব?
আপনি যদি সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী হোন, তাহলে বলতে বাধ্য হবেন যে, এভাবে কুরআনকে মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। কারণ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে লাখ লাখ কুরআনের হাফেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারা তাদের বক্ষে কুরআন শরিফকে মুখস্থ করে রেখেছে। মুহূর্তের মাঝে আবার কুরআন লিখে ফেলবে।
এ সহজ বিষয়কে মাথায় রেখে সামনে চলুন। সাহাবাদের যুগে বেহিসাব সাহাবা ছিলেন কুরআনের হাফেজ। তারা তাদের বক্ষে কুরআনকে ধারণ করে রেখেছিলেন। আয়েশা রা. এর কাছে লিখে রাখা আয়াত যদি রহিত নাও হতো, তাহলে সে সে কাগজ ছাগলে খেয়ে ফেলার বিষয়টি কিছু সময়ের জন্য বিশুদ্ধ ধরে নিলাম। প্রশ্ন হলো, সাহাবায়ে কেরামের বুক থেকে সে আয়াত কি ছাগলে খেয়ে ফেলেছিলো?
প্রাচ্যবিদ এবং মুক্তমনারা! আপাতো ডাস্টপিনে কিছু সময় লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখতে পারেন! ইসলাম ছিলো, আছে এবং থাকবে।