আমরা জানি যে, সম্পূর্ণ কুরআন একসঙ্গে অবতীর্ণ হয় নি, বরং প্রয়োজন এবং অবস্থার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আয়াত বিভিন্ন সময় অবতীর্ণ হয়েছে। তাই রাসুল সাঃ-এর যুগে শুরু থেকে কুরআন লিখে রেখে সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কুরআন সংরক্ষণের জন্য স্মৃতি শক্তির উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হত। প্রথমদিকে যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ওহি অবতীর্ণ হত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার সেটা পড়তে থাকতেন ভালভাবে মুখস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য। আল্লাহ তাআলা তখন আয়াত নাজিল করলেন:
لا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ . إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ
অর্থ, কুরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে আপক্ষনি আপক্ষনার জিহবাকে দ্রম্নত আন্দোলিত করবেন না। নিশ্চয়ই এর সংরক্ষণ এবং পাঠ আমার দায়িত্বে। সূরা কিয়ামাহ: ১৬-১৭।
দেখা গেল, রাসুল সাঃ-এর উপর ওহি অবতীর্ণ হওয়ার পক্ষর এমনিতে তা মুখস্থ হয়ে যেত। এভাবেই রাসুল সাঃ-এর পবিত্র বক্ষে আল্লাহ তাআলা কোন ধরনের ভুল ভ্রান্তি ছাড়া কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন। তারপরও বাড়তি সতর্কতা হিসাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর রমজানে জিবরিল আ. কে পূর্ণ কুরআন শুনাতেন। হাদিসে এসেছে যে বছর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমেত্মকাল করেছেন, সে বছর জিবরিলের সঙ্গে দুইবার কুরআন শুনাশুনি করেছেন। ফাতহুল বারি: ৯/৩৬।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে কুরআনের শব্দ মুখস্থ করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতেন। সাহাবায়ে কেরাম কুরআন শেখা এবং মুখস্থ করার ব্যাপারে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, তারা প্রত্যেকে অন্য সাহাবিদের থেকে অগ্রগামী হওয়ার ব্যাপারে প্রতিযোগীতা করতেন। অনেক মহিলা সাহাবির জীবনীতে পাওয়া যায় যে তারা মোহর হিসাবে স্বামীর কাছে শুধু এতটুকু চাইতেন যে, তাকে কুরআন শেখাবেন।
উবাদা বিন সামিত রাযি. বর্ণনা করেন,
كان الرجل إذا هاجر دفعه النبي إلى رجل منا يعلمه القرآن وكان يسمع لمسجد رسول الله ضجة بتلاوة القرآن حتى أمرهم رسول الله أن يخفضوا أصواتهم لئلا يتغالطوا
অর্থাৎ কোন সাহাবি হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনায় আসলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যে কোন আনসার সাহাবির কাছে পাঠিয়ে দিতেন, যাতে তিনি তাকে কুরআন শিক্ষা দেন। মসজিদে নববিতে কুরআন শিক্ষার আসরে এতটাই শোরগোল হতো যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে আওয়াজ ছোট করার নির্দেশ দিতেন। যাতে কোন ধরণের ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। এ শব্দে বর্ণনাটি আমি পাই নি। তবে যুরকানি মানাহিলুল ইরফান এ বর্ণনা করেছেন। মানাহিলুল ইরফান: ১/১৬৯।
দেখা গেছে অল্প সময়ে একদল বিশাল সাহাবা গড়ে ওঠেছেন, যাদের পুরো কুরআন মুখস্থ ছিল। আবু বকর সিদ্দিক রাযি., উমর রাযি., উসমান রাযি., আলি রাযি., তালহা রাযি., সা’দ রাযি., ইবনে মাসউদ রাযি., হুজাইয়া ইবনুল ইয়ামান রাযি., আবু হুরায়রা রাযি., ইবনে উমর রাযি., ইবনে আববাস রাযি., আমর বিন আস রাযি., মুআবিয়া রাযি., আয়েশা রাযি., হাফসা রাযি. এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাওযিহুল কুরআন: ১/২৩।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখস্থ করার প্রতি এজন্য বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন, কারণ তখনকার যুগ চাহিদা হিসেবে এটাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর এবং নিরাপদ পন্থা। সে যুগে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। কাগজ ছিল না। প্রেস ছিল না। শুধু লেখার উপর নির্ভর করে নির্ভরযোগ্য পন্থায় কুরআন সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে যেত। আল্লাহ তাআলা সে যুগের আরবিদের এত মেধাশক্তি দান করেছিলেন যে, তারা একেকজন হাজার হাজার শ্লোক মুখস্থ করত। গ্রাম্য লোকও নিজেদের খানদানের পাশাপাশি ঘোড়া এবং উটের নসবনামা মুখস্থ বলতে পারত।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম মুখস্থ করা ছাড়াও কুরআন লেখার বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। যায়দ বিন ছাবিত রাযি. বর্ণনা করেন:
كنت أكتب الوحي لرسول الله وكان إذا نزل عليه أخذته برحاء شديدة وعرق عرقا شديدا مثل الجمان ثم سري عنه فكنت أدخل عليه بقطعة الكتف أو كسرة فأكتب وهو يملي علي فما أفرغ حتى تكاد رجلي تنكسر من ثقل القرآن وحتى أقول لا أمشي على رجلي أبدا فإذا فرغت قال اقرأه فأقرأه فإن كان فيه سقط أقامة ثم أخرج به إلى الناس
অর্থাৎ আমি রাসুল সাঃ-এর পক্ষ থেকে ওহি লিপিবদ্ধকরণের কাজ করতাম। যখন ওহি অবতীর্ণ হত, তখন প্রচণ্ড উত্তাপ অনুভব করতাম। তাঁর শরীরের ঘামবিন্দু মুক্তা দানার মত চকচক করত। তাঁর সে অবস্থা কেটে গেলে আমি উটের হাড় বা অন্য কোন টুকরো নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হতাম। তিনি বলতেন এবং আমি লিখতে থাকতাম। লেখা শেষ হলে কুরআন লেখার গুরুভারে মনে হত যেন আমার পায়ের গোছা ভেঙ্গে গেছে এবং আমি আর চলতে সক্ষম হব না। লেখা শেষ হলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলতেন, পড়। আমি পড়ে শোনাতাম। কোন ভুল হলে তিনি তা সংশোধন করে দিতেন। এরপর তা মানুষের সামনে নিয়ে আসতেন। আল মু’যামুল আওসাত: তাবারানি: ১৯১৩, মাজমাউয যাওয়াইদ: ৬৮৪।
জায়দ বিন ছাবিত রাযি. ছাড়াও আরও অনেক সাহাবি ওহি লেখার দায়িত্ব আদায় করতেন। খুলাফায়ে রাশেদিন, উবাই বিন কা’ব, জুবায়ের বিন আওয়াম, মুআবিয়া, মুগিরা বিন শু’বা, খালিদ বিন ওয়ালিদ, ছাবিত বিন কায়স, আবান বিন সাঈদ রাযি. এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সে যুগে কাগজের সংকটের কারণে পাথরের ফলক, চামড়া, খেজুরের ডাল, বাঁশের টুকরো, গাছের পাতা ও পশুর হাড়ে লিখে রাখা হত। তবে কাগজের টুকরোও মাঝে মাঝে ব্যবহার হয়েছে। এভাবে রাসুল সাঃ-এর যুগেই কুরআনের লিপিবদ্ধ একটি কপি তৈরী হয়ে যায়, যদিও তা গ্রন্থাকারে বিন্যস্থ ছিল না।
আবু বকর সিদ্দিক রাযি. খলিফা হওয়ার পর কুরআনের বিক্ষিপ্ত অংশকে একত্রিত করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। জায়দ বিন ছাবিত রাযি. বর্ণনা করেন:
أَرْسَلَ إِلَيَّ أَبُو بَكْرٍ مَقْتَلَ أَهْلِ الْيَمَامَةِ وَعِنْدَهُ عُمَرُ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ إِنَّ عُمَرَ أَتَانِي فَقَالَ إِنَّ الْقَتْلَ قَدْ اسْتَحَرَّ يَوْمَ الْيَمَامَةِ بِالنَّاسِ وَإِنِّي أَخْشَى أَنْ يَسْتَحِرَّ الْقَتْلُ بِالْقُرَّاءِ فِي الْمَوَاطِنِ فَيَذْهَبَ كَثِيرٌ مِنْ الْقُرْآنِ إِلَّا أَنْ تَجْمَعُوهُ وَإِنِّي لَأَرَى أَنْ تَجْمَعَ الْقُرْآنَ قَالَ أَبُو بَكْرٍ قُلْتُ لِعُمَرَ كَيْفَ أَفْعَلُ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ عُمَرُ هُوَ وَاللَّهِ خَيْرٌ فَلَمْ يَزَلْ عُمَرُ يُرَاجِعُنِي فِيهِ حَتَّى شَرَحَ اللَّهُ لِذَلِكَ صَدْرِي وَرَأَيْتُ الَّذِي رَأَى عُمَرُ قَالَ زَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَعُمَرُ عِنْدَهُ جَالِسٌ لَا يَتَكَلَّمُ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ إِنَّكَ رَجُلٌ شَابٌّ عَاقِلٌ وَلَا نَتَّهِمُكَ كُنْتَ تَكْتُبُ الْوَحْيَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَتَبَّعْ الْقُرْآنَ فَاجْمَعْهُ فَوَاللَّهِ لَوْ كَلَّفَنِي نَقْلَ جَبَلٍ مِنْ الْجِبَالِ مَا كَانَ أَثْقَلَ عَلَيَّ مِمَّا أَمَرَنِي بِهِ مِنْ جَمْعِ الْقُرْآنِ قُلْتُ كَيْفَ تَفْعَلَانِ شَيْئًا لَمْ يَفْعَلْهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ هُوَ وَاللَّهِ خَيْرٌ فَلَمْ أَزَلْ أُرَاجِعُهُ حَتَّى شَرَحَ اللَّهُ صَدْرِي لِلَّذِي شَرَحَ اللَّهُ لَهُ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ فَقُمْتُ فَتَتَبَّعْتُ الْقُرْآنَ أَجْمَعُهُ مِنْ الرِّقَاعِ وَالْأَكْتَافِ وَالْعُسُبِ وَصُدُورِ الرِّجَالِ
অর্থাৎ ইয়ামামার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবু বকর রাযি. একদিন আমাকে ডেকে পাঠালে আমি তার কাছে গেলাম। উমর রাযি. তখন তার কাছে ছিলেন। আবু বকর রাযি. বলেন, উমর রাযি. এসে মাত্র আমাকে বললেন যে, ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের হাফেজ অসংখ্য সাহাবি শাহাদাতবরণ করেছেন। এভাবে যদি বিভিন্ন যুদ্ধে কুরআনের হাফেজ সাহাবাগণ শহিদ হতে থাকেন, তবে আমার ভয় হয় যে কুরআনের বড় একটি অংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমার মত হল আপনি কুরআন সংকলনের কাজ শুরু করার আদেশ দিন। আমি উমরকে বললাম, যে কাজ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি, সে কাজ আমি কীভাবে করি?
উমর জবাব দিলেন, আল্লাহর কসম, এটি একটি ভাল কাজ হবে। এরপর উমর রাযি. আমাকে বারবার এ কথাটি বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে আমার বিষয়টি পুরোপুরি বুঝে এসেছে। এখন আমারও মত হল যা উমর বলেছেন।
এরপর আবু বকর রাযি. আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি একজন বুদ্ধিমান যুবক পুরুষ। আপনার সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। আপনি রাসুল সাঃ-এর সামনে ওহি লেখার কাজ করেছেন। আপনি খুঁজে খুঁজে কুরআন সংকলন করুন।
যায়দ বিন ছাবিত রাযি. বলেন, আল্লাহর কসম! যদি তারা আমাকে একটি পাহাড় স্থানান্তরিত করার হুকুম দিতেন, তাহলে আমার কাছে এতটা কঠিন মনে হত না, কুরআন সংকলনের কাজ যতটা কঠিন মনে হয়েছে। আমি তাদের বললাম, যে কাজ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি, আপনারা তা কীভাবে করছেন? আবু বকর রাযি. বললেন, আল্লাহর কসম! এটি ভাল কাজই হবে। এরপর আবু বকর রাযি. আমাকে বারবার এ কথা বলতে থাকলেন। এক পর্যায়ে আমি প্রশান্তি লাভ করলাম। এরপর আমি কুরআনের আয়াত অনুসন্ধানের কাজ শুরু করলাম। আমি খেজুরের ডাল পাথরের ফলক এবং মানুষের স্মৃতিপট থেকে কুরআন একত্র করতে থাকলাম। বুখারি: ৪৬৭৯।
একটি বিষয় খেয়াল করুন। জায়দ বিন ছাবিত রাযি. নিজে ছিলেন কুরআনের হাফেজ। তিনি চাইলে নিজের স্মৃতিশক্তি থেকে কুরআন লিখতে পারতেন। তিনি চাইলে আরও কয়েকজন হাফেজকে নিয়ে পরিষদ বানিয়ে কুরআন লিখতে পারতেন। এছাড়া রাসুল সাঃ-এর যুগে যে কপি তৈরী করা হয়েছিল, সেটা থেকে তিনি অনুলিপি তৈরী করতে পারতেন। কিন্তু অধিকতর সর্তকতা হিসাবে তিনি যে কোন একটি পন্থার উপর নির্ভর করেন নি। বরং উপরের সবগুলো মাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। লিখিত এবং মৌখিক সাক্ষী দ্বারা যতক্ষণ কোন আয়াত মুতাওয়াতির হওয়ার বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয় নি, ততক্ষণ তিনি সে আয়াতকে সংকলনে লিখেন নি।
তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, যার কাছে কুরআনের যে আয়াত রয়েছে, সে যেন তা জায়দ বিন ছাবিত রাযি. এর কাছে জমা দেয়। কেউ লিখিত কোন আয়াত নিয়ে আসলে চারভাবে সেটাকে সত্যায়িত করা হতো।
প্রথমত, নিজের হিফজের সঙ্গে মিলাতেন।
দ্বিতীয়ত, উমর রাযি. কুরআনের হাফেজ ছিলেন। আবু বকর রাযি. তাকে জায়দ বিন ছাবিত রাযি. এর সহযোগী নিযুক্ত করেছিলেন। কেউ কোন আয়াত নিয়ে আসলে তারা উভয়ে সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করতেন।
তৃতীয়ত, যখন নির্ভরযোগ্য দুইজন সাক্ষী সাক্ষীপ্রদান করত এ আয়াত রাসুল সাঃ-এর সামনে লেখা হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত লিখিত কোন আয়াত গ্রহণ করা হত না।
চতুর্থত, এরপর সে সকল লিপিবদ্ধ আয়াতকে সে সকল সংগ্রহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হত, যা বিভিন্ন সাহাবি তৈরী করেছিলেন। বিসত্মারিত দেখুন, ফাতহুল বারি: ৯/১১, আল ইতকান: ১/৬০, আল বুরহান: ১/২৩৮।
২৪ হিজরিতে উসমান রাযি. খলিফা নিযুক্ত হন। ইতিমধ্যে ইসলাম আরবের সীমা পেরিয়ে রোম, ইরান পক্ষর্যমত্ম পৌঁছে গেছে। যে এলাকার মানুষ যার মাধ্যমে মুসলমান হয়েছে, তার থেকে মানুষ কুরআন শিখত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বিভিন্ন সাহাবি বিভিন্ন কেরাত তথা পাঠরীতিতে কুরআন শিখেছিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল কেরাত অনুযায়ী তেলাওয়াত করার অনুমতি ছিল। দেখা গেল, যে সাহাবি যে কেরাতে রাসুল সাঃ-এর কাছে কুরআন শিখেছিলেন, তিনি তার শিষ্যদের সে পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছেন। কেরাতের ভিন্নতা যখন দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল, অনেকে এ ব্যাপারে না জানার কারণে অন্য কেরাতকে গলত সাব্যস্থ করতে থাকল। মুসলিম বিশ্বে তখন মদিনায় সংরক্ষিত জায়দ বিন ছাবিত রাযি. এর সংকলিত কপি ছাড়া নির্ভরযোগ্য আর কোন কপি ছিল না। বাকি কপিগুলো ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে লিখিত এবং সেগুলোতে সমস্ত কেরাতকে একত্রিত করার ব্যবস্থা ছিল না।
উসমান রাযি. তার খেলাফতকালে এ মহান খেদমত আঞ্জাম দেন। তিনি হাফসা রাযি. এর কাছে সংবাদ পাঠান যে, আপনার কাছে আবু বকর রাযি. কর্তৃক প্রস্ত্ততকৃত কুরআনের যে কপি রয়েছে, তা আমাদের কাছে পাঠান। আমরা সেটার কয়েকটি অনুলিপি তৈরী করে মূলকপি আপনাকে ফিরত দেব। হাফসা রাযি. সে কপি পাঠালে উসমান রাযি. চারজন সাহাবিকে দিয়ে একটি পরিষদ গঠন করলেন। তারা হলেন, জায়দ বিন ছাবিত রাযি., আবদুল্লাহ বিন জুবায়ের রাযি., সাঈদ ইবনুল আস রাযি., আবদুর রহমান বিন হারিছ রাযি.। তাদের দায়িত্ব ছিল আবু বকর সিদ্দিক রাযি. কর্তৃক তৈরীকৃত কপির অনুলিপি তৈরী করা।
চারজন সাহাবির মধ্যে কেবল জায়দা বিন ছাবিত রাযি. ছিলেন আনসারি সাহাবি। বাকি চারজন কুরাইশ গোত্রের। উসমান রাযি. তাদের নির্দেশ দিলেন যে, কুরআনের কোন আয়াতের কেরাত নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে কুরাইশের কেরাত অনুসরণ করে লিখবেন। কারণ, কুরআন তাদের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। মৌলিকভাবে দায়িত্ব এ চারজন সাহাবির থাকলেও পরে অন্যান্য সাহাবিদের তাদের সহযোগী নিযুক্ত করা হয়। তারা প্রথমত, আবু বকর সিদ্দিক রাযি. এর খেলাফতকালের তৈরী সংকলনে সূরার বিন্যাস ছিল না। তারা সবগুলো সূরা বিন্যস্ত আকারে একই কপিতে লিপিবদ্ধ করেন।
উসমান রাযি. এভাবে কুরআনের পাঁচটি কপি তৈরী করেন। কারও মতে সাতটি। একটি মক্কায়, একটি শামে, একটি ইয়ামানে, একটি বাহরাইনে, একটি বসরায়, একটি কুফায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একটি মদিনায় সংরক্ষণ করা হয়। এ সম্পর্কে বিসত্মারিত আলোচনা করেছেন ইমাম ইবনে হাজার আসকালনি রাহি.। দেখুন: ফাতহুল বারি: ৯/১৩-১৫।