ইসলামে সুন্নাহর অবস্থান

শরীয়তের প্রথম ভিত্তি হলো কুরআন। ‘সুন্নাহ’ হল ২য় ভিত্তি। সুন্নাহর মাধ্যমে কুরআনের অস্প’ বিষয়কে সুস্প’ করা হয়। কঠিন বিষয়াবলির ব্যাখ্যাপ্রদান করা হয়। ব্যাপক বিষয়গুলোকে নির্দি’ করা হয়। সংক্ষিপ্ত বিষয়াবলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম কখনো নিজের কথা দ্বারা, কখনো নিজের কর্ম দ্বারা, কখনো উভয়টি দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা করেন। কয়েকটি উদাহরণ পেশ করলে পাঠক বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন। পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় আল্লাহ তায়ালা বলেন,
الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ
যারা ঈমান আনবে এবং তাদের ঈমানের সাথে অন্ধকার মিশ্রিত করবে না, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারা সঠিক পথপ্রাপ্ত।- সূরা আনআম: ৮২।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, এ আয়াত যখন অবতীর্ণ হলো, সাহাবাদের অন্তরে চিন্তার ঝড় উঠলো! পরস্পর বলাবলি করতে থাকলেন যে, আমাদের কে নিজেদের ঈমানের সাথে অন্ধকার মিশ্রিত করেনি? সাহাবারা এসে মনের খটকা জানালেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনি বললেন, এখানে অন্ধকার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শিরক। তোমরা দেখোনি পবিত্র কুরআনে লুকমান হাকিম তাঁর ছেলেকে নসিহতে বলেছিলেন, ‘তুমি শিরক থেকে বেঁচে থাকো। কারণ শিরক হলো অনেক বড় অন্ধকার।’

বাহ্যিকভাবে এ আয়াত পড়েই অন্ধকার দ্বারা কি উদ্দেশ্য? সেটা কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই সেটার ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।

সুন্নাহর মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা করা হয়, এর কিছু উপমা নিম্নে তুলে ধরছি।

* আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের একাধিক জায়গায় বলেছেন:
‘তোমরা নামায আদায় কর এবং জাকাত প্রদান কর।’

কিন্তু কখন নামাজ পড়বে? কত ওয়াক্ত নামাজ পড়বে? কখন নামাজ কোন নামাজের ওয়াক্ত শুরু হবে এবং কখন শেষ হবে? কোন ওয়াক্ত নামাজ কত রাকাত পড়বে? নামাজ পড়ার পদ্ধতি কি? কি কি জিনিস নামাজে ফরজ? সে সম্পর্কে কুরআনে কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

সেগুলো সম্পর্কে উম্মতকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর কর্ম তথা সুন্নাহর মাধ্যমে মানুষ এগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছে।
এমনিভাবে জাকাত কখন ওয়াজিব হবে, তার নেসাব, পরিমান, কোন জিনিসের উপর জাকাত ওয়াজিব হবে? সে সম্পর্কে কুরআনে কোন কিছু বলা হয়নি। কুরআনে শুধুমাত্র জাকাতপ্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম সব বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

সুন্নাহর গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য মনে হয় একটি উদাহরণই যথেষ্ট। আপনি যদি সুন্নাহকে বাদ দিয়ে শুধু কুরআনের উপর আমল করতে চান, নিজেকে ‘আহলে কুরআন’ দাবি করেন, তাহলে ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজ পড়তে পারবেন না। কারণ কুরআনে শুধুমাত্র নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছে। বাকি সবকিছু রয়েছে সুন্নাহতে। এজন্য মুসলামনদের কাছে কুরআনের পরেই হলো সুন্নাহর অবস্থান।

* আরেক আয়াতে  তায়ালার দীপ্ত ঘোষনা,
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا
‘চুর পুরুষ এবং মহিলার হস্ত কর্তন কর কৃতকর্মের ফল হিসাবে। সুরা মায়েদা, আয়াত নং ৩৮

কিন্তু কথা হলো একজন সামান্য ঘাস চুরি করলো? অথবা কারো পকেট থেকে চকলেট খাওয়ার জন্য একটাকা নিয়ে গেলো? তার হাত কেটে ফেলা হবে? কত টাকা চুরি করলে হাত কাটা হবে? হাত কোন জায়গায় কাটবে? বারবার চুরি করলে কীভাবে তার হাত কাটা হবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি কুরআনে পাবেন না। অবশ্যই আপনাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর আশ্রয় নিতে হবে। সেখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা পেয়ে যাবেন।

* আল্লাহ তায়ালা বলেন,
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ ۖ
‘ব্যাভিচারি পুরুষ এবং ব্যাভিচারিণী মহিলাকে একশটি বেত্রাঘাত করো।’-সূরা নুর: ২।

মানুষ বিয়ে করার আগে ব্যভিচার করতে পারে। আবার বিয়ে করার পরও করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ শাস্তি কি সকলের জন্য? সুন্নাহ এসে পার্থক্য করেছে। বিবাহের আগে ব্যভিচার করলে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। কিন্তু বিবাহের পর কেউ ব্যাভিচার করলে তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে।

পাঠকের অনুধাবনের জন্য মাত্র কয়েকটি উপমা পেশ করলাম। এ ধরণের উপমার শেষ নেই। মোটাদাগে বলতে গেলে বলতে হয় যে, সুন্নাহ না থাকলে আমাদের জন্য কুরআন অনুধাবন করা সম্ভব ছিলো না। কারণ ইসলামের অনেক বিষয়াবলি সম্পর্কে কুরআনে শুধুমাত্র নির্দেশপ্রদান করা হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে সুন্নাহতে। এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবা এবং তাবেয়িনরা কুরআনের মতোই সুন্নাহর ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। কেউ সুন্নাহকে বাদ দিয়ে কুরআন নিয়ে পড়ে থাকতে চাইলে তাদের শক্তভাবে খণ্ডন করেছেন। এ সম্পর্কে কয়েকজনের বক্তব্য পাঠকের প্রশান্তির জন্য এখানে তুলে ধরছি।

আবদুল্লাহ  বিন মুবারক রহ. ইমরান বিন হুসাইন রা. এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তাঁর কাছে একজন লোক এসে জানতে চাইলো।
তিনি হাদীস থেকে উত্তরপ্রদান করলেন।
ওই ব্যক্তি বললো, আপনি কুরআন বাদ দিয়ে সারাদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস নিয়ে পড়ে থাকেন কেন?

প্রশ্ন শুনে ইমরান বিন হুসাইন রা. বললেন,
إِنَّكَ امْرُؤٌ أَحْمَقُ , أَتَجِدُ فِي كِتَابِ اللَّهِ أَنَّ صَلاةَ الظُّهْرِ أَرْبَعًا لا يُجْهَرُ فِيهَا , وَعَدَّدَ الصَّلَوَاتِ وَعَدَّدَ الزَّكَاةِ وَنَحْوَهَا , ثُمَّ قَالَ : أَتَجِدُ هَذَا مُفَسَّرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ , إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَحْكَمَ ذَلِكَ وَالسُّنَّةُ تُفَسِّرُ ذَلِكَ
তুমি একজন আহম্মক। তুমি কি কুরআনে পাবে জোহরের নামাজ চার রাকাত? তাতে কেরাত উচ্চস্বরে পড়া হবে না?
এতপর অন্যান্য নামাজ এবং জাকাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, উপরোক্ত বিষয়গুলো তুমি কি কুরআনে বিস্তারিতভাবে পাবে? কুরআনে বিষয়গুলোকে অস্প’ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘সুন্নাহ’তে বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হয়েছে।- মুসনাদে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারাক, হাদিস নং ২৩৩

ইমরান বিন হুসাইন রা. ওই ব্যক্তিকে বুঝানোর জন্য বাস্তবতা দ্বারা উপমা পেশ করেছেন। যে বাস্তবতা কোনো বিবেকবান অস্বীকার করতে পারবে না। এছাড়া ইমরান বিন হুসাইন রা. প্রশ্ন শুনে তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছেন। এতে সে পরিপূর্ণ আগ্রহের সাথে পরবর্তী কথা বুঝার চেষ্টা করবে। তিনি তাকে বুঝাতে চেয়েছেন যে, জীবনে চলতে হলে কুরআনের সাথে সাথে সুন্নাহরও প্রয়োজন।

* ইমাম মাকহুল রহঃ থেকে বর্ণিত:
“القراّن أحوج إلى السنة من السنة الى القراّن”
অর্থাৎ সুন্নাহ কুরআনের চেয়ে কুরআন সুন্নাহর বেশি মুখাপেক্ষী।- আল কিফায়া, পৃষ্ঠা নং ৩০.দারুল কিতাবিল আরাবি

মাকহুল রহ. তাবেয়িনদের মাঝে প্রসিদ্ধ মুফাসসিরদের একজন। তার একথা থেকে অনেকে সুযোগ নিতে চাইবে! বলবে যে, তিনি কুরআন থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সুন্নাহকে!

অথচ বাস্তবতা কিন্তু এমন না! ইসলামের সবার শীর্ষে হলো কুরআনের স্থান। এখানে মূলত তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, সুন্নাহর কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণের জন্য আমাদের কুরআনের কাছে যেতে হয় না! রাসূল সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই কথা, কর্ম বা মৌন সমর্থন দ্বারা আমাদের কাছে বিশ্লেষণ পেশ করে গেছেন। কিন্তু কুরআনের বহু আয়াত এমন রয়েছে, যেগুলোর সঠিক মর্ম উদ্ধার করতে হলে আমাদের সুন্নাহর কাছে যেতে হবে। পূর্বে এ সংক্রান্ত তিনটি উপমা পেশ করেছিলাম। এ দিক বিবেচনা করে তিনি উক্ত কথা বলেছেন। মূলত এরদ্বারা তিনি সুন্নাহর গুরুত্ব বুঝানোর চে’া করেছেন।

* আইয়ুব সাখতিয়ানি রহ. বলেন,
“أذا حدثت الرجل باالسنة فقال: دعنا من هذا و حدثنا من القران فاعلم أنه ضال مضل”
অর্থাৎ যখন তুমি কারো কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বর্ণনা করবে, সে তখন বলবে, এগুলো বাদ দিয়ে কুরআন থেকে বর্ণনা করো, তাহলে তুমি জেনে রাখ, নিশ্চই সে পথভ্র’। আল কিফায়া, পৃষ্ঠা নং ৩১, দারুল কিতাবিল আরাবি

পথভ্রষ্ট হওয়ার স্পষ্ট। এমনকি কিছু কিছু অস্বীকারের কারণে সে ঈমান হারিয়ে ফেলবে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণের নির্দেশপ্রদান করেছেন! এখন কেউ হাদীসকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশকে এড়িয়ে যাওয়া। যা অবশ্যই ভ্র’তা। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ঈমান হন্তারক হয়ে যাবে।

* ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদি রহ. বলেন,
الرجل إلى الحديث أحوج منه إلى الآكل والشرب.و قال:الحديث تفسير القراَن”
অর্থাৎ মানুষ খাওয়া-দাওয়া এবং পানাহারের চেয়ে হাদীসের অধিক মুখাপেক্ষী। আল কিফায়া, পৃষ্ঠা নং ৩১

আবদুর রহমান বিন মাহদি রহ. এর কথাটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। বিশেষত বর্তমানে যারা ‘আহলে কুরআন’ এর নামে হাদীসের প্রামাণিকতাকে অস্বীকার করতে চান। মানুষ একটানা কয়েকদিন না খেয়ে থাকতে পারে! ক’ করে জীবনধারণ করতে পারে! কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহকে বাদ দিয়ে সে এক ঘন্টাও চলতে পারবে না। কারণ ঘুমাতে গেলেও তাঁর সুন্নাত রয়েছে। হাটতে গেলে সেটার আলাদা সুন্নাত রয়েছে। খেতে গেলে সেটারও আলাদা সুন্নাত রয়েছে। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিক-নির্দেশনা প্রদান করে গেছেন! যাতে উম্মাত সে নির্দেশনা মেনে সহজেই জীবন পরিচালনা করতে পারে।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *