প্রাচ্যবিদরা একটি মাত্র অভিযোগ তুলে কেল্লা ফতেহ ভেবে বসে থাকার লোক নয়। বরং হাদীস এবং সুন্নাহ সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন ক‚টচালের আশ্রয় নিয়েছে। এরপক্ষে আরো কিছু দলিল উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। এ ধরণের একটি দলিল নিয়ে আলোচনা করছি।
সুন্নাহর প্রামাণিকতা অস্বীকারকারীরা আরেকটি কথা খুব জোশের সাথে প্রচার করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“إذا جاءكم عني حديث فاعرضوا على كتاب الله,فما وافقني فخذه. وما خالفه فاتركوه”
অর্থাৎ যখন তোমাদের নিকট কোন হাদীস বর্ণনা করা হবে, সেটাকে কুরআনের সাথে মিলাবে, যদি সেটা কুরআনের বিধানের সাথে মিলে যায়, তাহলে আঁকড়ে ধরো। আর যে বিধান কুরআনের বিরোধি হবে, সেটাকে ছুঁড়ে ফেলো।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম হাদীসের উপর আমল করার আগে তা কুরআনের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন। যদি হাদীস কুরআনের বিধানের মতে হয়, তাহলে আমল করবে,অন্যথায় নয়।
এর দ্বারা বুঝা গেল, হাদীসের আলাদা কোনো প্রামাণিকতা নেই। বরং কুরআনই হল মূল। এ জন্য আমরা সরাসরি কুরআনের উপর আমল করব। হাদীসের প্রয়োজন নেই।
কিন্তু কথা হলো অন্য জায়গায়। প্রাচ্যবিদদের জন্য জরুরী ছিলো অভিযোগ করার আগে বর্ণনাটি সহিহ নাকি দুর্বল? সে কথা প্রমাণ করা। কারণ দুর্বল বা বানোয়াট বর্ণনা দ্বারাতো এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে দলিল পেশ করা যাবে না। কিন্তু তরাা সেটা পরীক্ষা করার তোড়াই কেয়ার করেছেন। নিজের উদ্দেশ্য হাসিল হলেই হলো! জাল জয়িফ দিয়ে আমি কি করব?
কিন্তু আমরা দেখি যে, হাদীস বিশারদরা একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, উক্তিটি মনগড়া। মিথ্যুকরা বানিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এর নামে চালিয়ে দিয়েছে তাদের খারাপ উদ্দেশ্যকে প্রমাণিত করার জন্য। কয়েকজন হাদীস বিশেষজ্ঞ আলেমের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করছি।
ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদি বলেন,
الزنادقة والخوارج وضعوا ذلك الحديث
অর্থাৎ জিনদিক এবং খারিজিরা হাদীসটি বানিয়েছে।- জামিয়ূ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাজলিহি, হাদিস নং ১৪২০
ইমাম ইবনে আবদিল বার মালেকি রহ. বলেন,
وهذه الألفاظ لا تصح عنه صلى الله عليه وسلم عند أهل العلم بصحيح النقل من سقيمه وقد عارض هذا الحديث قوم من أهل العلم فقالوا : نحن نعرض هذا الحديث على كتاب الله قبل كل شيء ونعتمد على ذلك ، قالوا : فلما عرضناه على كتاب الله عز وجل وجدناه مخالفا لكتاب الله ؛ لأنا لم نجد في كتاب الله ألا نقبل من حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم إلا ما وافق كتاب الله ، بل وجدنا كتاب الله يطلق التأسي به والأمر بطاعته ويحذر المخالفة عن أمره جملة على كل حال
অর্থাৎ এ উক্তিগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহিহ এবং দুর্বল কোনো সূত্রে প্রমাণিত নয়। অনেক বরেণ্য হাদীসবিশারদ আলোচিত উক্তিটি সম্পর্কে গবেষণা করে বলেছেন, আমরা এ কথাকে সবার আগে কিতাবুল্লাহর সাথে মিলিয়েছি। কিন্তু আমরা কিতাবুল্লাহর বিপরিত পেয়েছি। কেননা কুরআনের কোথাও একথা নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাহি ওয়াসাল্লাম এর যে হাদীসগুলো কুরআনের মুওয়াফিক হবে, সেগুলোকে গ্রহণ করতে এবং বাকীগুলো ছেড়ে দিতে। বরং কুরআনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এর সকল হাদীসের উপর আমল করতে বলা হয়েছে এবং সর্বাবস্থায় হাদীসের বিরোধিতা থেকে বেঁচে থাকতে কঠোর ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জামিয়ূ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাজলিহি, হাদিস নং ১৪২০.
এভাবে স্বয়ং কুরআন দ্বারা আলোচিত উক্তিটি জাল প্রমাণিত হয়। আর হাদীস জাল হওয়ার একটি নিদর্শন হলো কুরআনের আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া। জাল এবং বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ‘লামাহাত মিন তারিখিস সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থে। ( ৭৯-১৩৭পৃষ্ঠা) আগ্রহী পাঠক সেটি অধ্যয়ন করতে পারেন।
আল্লামা শাওকানি রহ. বলেন,
“عرضنا هذا الحديث على كتاب الله تعالى فوجدناه مخالفا له.لأن وجدناه في كتاب الله”ماأتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا” ووجدنا فيه “قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله”ووجدنا فيه”من يطع الرسول فقد أطاع الله”
অর্থাৎ উক্তিটিকে আমরা কুরআনের সাথে মিলিয়েছি। কিন্তু আমরা কুরআনের অসংখ্য আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক পেয়েছি। কেননা কুরআনের এক জায়গায় আল্লাহ বলেন,
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন,তা ভালোভাবে আকড়ে ধর এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বেঁচে থাকো।’
আরেক জায়গায় এসেছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভলোবাসো,তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন।’
আরেক জায়গায় এসেছে, ‘যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করল, সে আল্লাহর অনুসরণ করল।’ ইরশাদুল ফুহুল, পৃষ্ঠা নং ৯২, শায়খ আহমদ ইনায়াহ তাহকিককৃত
এরপর আল্লামা শাওকানী রহ. বলেন,
والحاصل أن ثبوت حجية السنة المطهرة واستقلالها بتشريع الأحكام ضرورة دينية ولا يخالف في ذلك إلا من لا حظ له في دين الإسلام.
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস এবং সুন্নাহ স্বতন্ত্র দলীল হওয়া দ্বীনের অবিচ্ছেদ্দ অংশ। কেউ একথা অস্বীকার করতে পারবে না মুরতাদরা ছাড়া। ইরশাদুল ফুহুল, পৃষ্ঠা নং ৯২.শায়খ আহমদ ইনায়াহ তাহকীককৃত
আল্লামা ড. আবু শাহাবা রহ. বলেন,
و مثل حديث عرض السنة على القراّن فهو موضوع باتفاق الأئمة
অর্থাৎ উক্তিটি ইমামদের ঐক্যমতে জাল এবং বানোয়াট। দিফা’ আনিস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা নং ১৮. মাকতাবাতুস সুন্নাহ
ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন,
والحديث الذي روى في عرض الحديث على القرآن باطل لا يصح وهو ينعكس على نفسه بالبطلان فليس في القرآن دلالة على عرض الحديث على القرآن .
অর্থাৎ এ উক্তিটি বাতিল ও ভিত্তিহীন। সহিহ নয়। একথাটিই বাতিল হওয়ার দলীল। এছাড়া কোরআনেও এ ব্যপারে কোন কথা নেই। মিফতাহুল জান্নাহ, পৃষ্ঠা নং ১০. মদিনা বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত
মোটকথা হলো উক্তিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস নয়। বরং হাদীস অস্বীকারকারীরা নিজেদের কূমতলব প্রতিষ্ঠা করার জন্য মনগড়া এ উক্তিটি বানিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে চালিয়ে দিয়েছে। অথচ এ কথাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একাধিক সহিহ হাদীসের বিপরিত। কেননা তিনি উম্মতকে সতর্ক করে গেছেন যে, অচিরেই উম্মতের মধ্যে এমন এক দল লোকের অবির্ভাব হবে, যারা শুধুমাত্র কুরআন কে দলীল মানবে, হাদীসকে অস্বীকার করবে। আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬০৬. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৭২১৩. আল ম’ুযামুল কাবীর, হাদিস নং ৬৭০
এছাড়া হাদীস বিশেসজ্ঞরা এব্যপারে একমত যে,সহীহ হাদীস কখনো কিতাবুল্লাহর বিপরিত হতে পারে না। যদি কোন হাদীস এমন হয়,তাহলে বুঝতে হবে এ হাদীস অবশ্যই পরিত্যাজ্য। সহিহ তথা বিশুদ্ধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ইমাম ইবনে হাজম রহ. বলেন,
وأما من تعلق بحديث التقسيم فقال ما كان في القرآن أخذناه وما لم يكن في القرآن لا ما يوافقه ولا ما يخالفه أخذناه وما كان خلافا للقرآن تركناه فيقال لهم ليس في الحديث الذي صح شيء يخالف القرآن
অর্থাৎ হাদীসের মধ্যে যারা বিভাজন করে, যে হাদীস কুরআনের মুওয়াফিক হবে, সেটাকে আমরা গ্রহণ করবো। বিপরিত হলে ছেড়ে দিব। তখন তাদের কে বলা হল, কুরআনের বিপরিত কোনো সহিহ হাদীস নেই। আল ইহকাম ফি উসূলিল আহকাম ২/৮০.
আল্লামা শাতিবি রহ. বলেন,
فإن الحديث إما وحي من الله صرف وإما اجتهاد من الرسول عليه الصلاة و السلام معتبر بوحي صحيح من كتاب أو سنة وعلى كلا التقديرين لا يمكن فيه التناقض مع كتاب الله لأنه عليه الصلاة و السلام ما ينطق عن الهوى إن هو إلا وحي يوحى
অর্থাৎ হাদীস হয়ত আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাপ্ত হবেন, অথবা ইজতেহাদ করে বলবেন। ইজতেহাদের ভিত্তি হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সরাসরি ওহীর উপর,অথবা ওহী সুত্রে প্রাপ্ত হাদীসের উপর,অথবা উভয়টির উপর। আর এমন কথা কুরআনের বিপরিত হতে পারে না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে কথা বলেন না।বরং তার কথাও ওহি সুত্রে প্রাপ্ত। আল মুওয়াফাকাত ৪/২১.দারুল মা’রেফা,বাইরুত
বুঝা গেল, রাসূলাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস কখনো কুরআনের বিপরিত হতে পারে না। হ্যাঁ! এতটুকু হতে পারে যে, হাদিসে এমন বিষয় এসেছে, যেটার পক্ষে বিপক্ষে কোনো কিছু কুরআন হাদিসে পাওয়া যায় না। এমনটা হওয়াতো স্বাভাবিক। এজন্যইতো কুরআনের অসংখ্য আয়াতে হাদীসের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
এজন্য এ মনগড়া উক্তির উপর ভিত্তি করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। এ ধরণের ঈমান বিধ্বংসী আকিদা থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।