সমাজে কিছু লোক এমন আছে, কুরআন, হাদীসে বর্ণিত সহীহ আমল সমূহ নিয়ে তাঁদের এমন মাথাব্যথা নেই। রুসম রেওয়াজ নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। আখেরী চাহারশোম্বা, ফাতেহায়ে ইয়াযদহম সহ আরো বিভিন্ন দিবস পালন করে। রসম রেওয়াজ আদায়কারী লোকেরা দীর্ঘদিন থেকে ফাতেহায়ে ইয়াযদহম নামে আরেকটি রসম পালন করে। ‘ইয়াযদহম’ শব্দের অর্থ হলো এগার। ফাতেহায়ে ইয়াযদহম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: রবিউস সানী মাসের বারো তারিখে কৃত ফাতেহা বা ঈসালে সওয়াব মাহফিল। তারা বলে থাকে, রবিউস সানী মাসের বারো তারিখে বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ. ইন্তেকাল করেছেন। তাই তাঁর ওফাত দিবস উপলক্ষে এ দিবস পালন করা হয়!
ইসলাম ধর্মে জন্ম বার্ষিকী এবং মৃত্যবার্ষিকী পালনের কোনো রসম নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগে পৃথিবীতে অনেক নবী রাসূল এসেছেন। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো জন্ম বা মৃত্যু বার্ষিকী পালন করেননি। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তাঁর অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্তেকাল করেছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদেজা রা.। মর্মান্তিকভাবে উহুদ যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হামযা রা.। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মৃত্যু বার্ষিকী পালন করেছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন সাহাবায়ে কেরাম। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম কখনো মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেননি। কেননা মৃত্যু বার্ষিকী যদি পাল করা শরীয়তসিদ্ধ হয়, তাহলে প্রত্যেক দিনই মৃত্যু বার্ষিকী পালন করতে হবে। কারণ বছরে দিন মাত্র তিনশত পয়ষট্টিটি। আর শুধুমাত্র ইসলামের ইতিহাসে কত মহা মানব জন্ম গ্রহণ করেছেন। বছরের প্রতিটি দিন কোনো না কোনো মহামানব মৃত্যুবরণ করেছেন! তখন উম্মত আর কোনো কাজ করার সুযোগ পাবে না! সারা জীবন শুধু মৃত্যুবার্ষিকী আর তাবারুকের পিছনে ব্যয় করতে হবে!
এছাড়া যার মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে, সেই বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ. জীবদ্দশায় কারো মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছেন, অথবা তাঁর কোনো শিষ্যকে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, এমনটা আপনি ইতিহাসে দেখাতে পারবেননা! এজন্য রবিউস সানী এর এগারো তারিখে মহাধুমধামে ফাতেহায়ে ইয়াযদহম পালন করা নিকৃষ্ট বেদয়াত। আপনি মন চাইলে একাকী কোনো ভালো কাজ করে বড়পীরকে ঈসালে সওয়াব করতে পারেন।
আবদুল কাদির জিলানী রহ.-এর মৃত্যু কত তারিখে?
এবার আমরা একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলাবো। একথা দেখার জন্য যে, আসলে বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ. কত তারিখে ইন্তেকাল করেছেন? আমরা দেখতে পাই যে, বড়পীর এগারো তারিখে ইন্তেকালের কথা ইতিহাসে নেই। আট, নয় বা দশ ৫৬১ হিজরীর কথা রয়েছে।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস এবং ইতিহাসবিদ ইমাম যাহাবী রহ. বলেন,
عاش الشيخ عبد القادر تسعين سنة، وانتقل إلى الله في عاشر ربيع الآخر سنة إحدى وستين وخمس مئة، وشيعه خلق لا يحصون، ودفن بمدرسته رحمه الله تعالى.
অর্থাৎ আবদুল কাদির জিলানী পৃথিবীতে বেঁচেছিলেন নব্বই বছর। ৫৬১ হিজরীর দশ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
ইমাম যাহাবী রহ. তাঁর ইতিহাস বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারিখুল ইসলাম’-এ বলেন,
توفي في عاشر ربيع الآخر سنة إحدى وستين وله تسعون سنة، وشيعة خلق لا يحصون.
অর্থাৎ আবদুল কাদির জিলানী ৫৬১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখে ইন্তেকাল করেছেন।
আল্লামা আবদুর রহীম লাজপুরী রহ. বলেছেন: “আবদুল কাদির জিলানীর মৃত্যু তারিখ নিয়ে শক্ত মতভিন্নতা রয়েছে। ‘তাফরীহুল খাতির ফি মানাকিবি আবদিল কাদির’ নামক গ্রন্থে প্রায় আটটি মত উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ এগারো তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তৃু সঠিক হলো দশ তারিখ”।
মোটকথা হলো: বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রহ. এর মৃত্যু তারিখ রবিউস সানীর এগারো তারিখ নয়। বরং দশ তারিখ। এজন্য এগারো তারিখ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা সম্পূর্ণ ভ্রষ্টতা এবং নিকৃষ্ট বেদয়াত। আল্লাহ তায়ালা পুরো মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন।
ফাতেহায়ে ইয়াযদাহম নামে শিরকী কথাবার্তা
ফাতেহায়ে ইয়াযদাহাম এমনিতেই ভ্রষ্টতাপূর্ণ বেদয়াত। এছাড়া ওইদিন বড়পীর আবদুল কাদির জিলানীর নামে যে সমস্ত কথাবার্র্তা বলা হয়, সেগুলো শিরক। যেমন ওইদিন আবদুল কাদির জিলানী রহ. এর কারামত আলোচনা করতে গিয়ে খুব জোরেশোরে প্রচার করা হয় যে, আবদুল কাদির জিলানী রহ. মৃতকে জীবিত করতে পারতেন! অথচ এটি একটি স্পষ্ট শিরকী কথা। কারণ জীবন মরণের একমাত্র মালিক আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কাউকে জীবিত এবং মৃত করার ক্ষমতা নেই। যদি কেউ এই আকীদা পোষণ করে যে, আবদুল কাদির জিলানী রহ. এর মৃতকে জীবিত করার শক্তি ছিল, তাহলে তাঁর ঈমান থাকবেনা।
এছাড়াও আবদুল কাদির জিলানীর নামে আরো অনেক অহেতুক বানোয়াট কিসসা খুব জোরেশোরে প্রচার করা হয়। যেমন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে বড়পীরের দোযখ দেখতে যাওয়া, মেরাজের রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকে উঠতে পারছিলেননা, বড়পীর পাথর হয়ে এসে ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাধে পা দিয়ে বোরাকে আরোহন করেন। মেরাজে যাওয়ার সময় বড়পীর আকাশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বোরাক আটকিয়ে তার সাথে কথা বলেন ইত্যাদি সহ আরো নানান বানোয়াট কিসসা কাহিনী। যে কাহিনীগুলোর পরতে পরতে রয়েছে ঈমান বিধ্বংসী কথাবার্তা। ফাতেহায়ে ইয়াযদাহম এমনিতেই বেদয়াত! কিন্তু বর্তমানে তা মানুষের ঈমান হন্তারক হয়ে দাড়িয়েছে। আল্লাহ পুরো মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন।