রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছোটবেলায় কেন বকরি চরিয়েছেন?

 

আবু তালিবের ঘরে খাবারের স্বল্পতা ছিল। এ জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বকরি চরানোর কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি নিজেই সে সম্মানিত কাজ সম্পর্কে বলেছেন। এটাও বলেছেন যে, পূর্ববর্তী সকল নবিই বকরি চরিয়েছেন। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا بَعَثَ اللَّهُ نَبِيًّا إِلَّا رَعَى الْغَنَمَ فَقَالَ أَصْحَابُهُ وَأَنْتَ فَقَالَ نَعَمْ كُنْتُ أَرْعَاهَا عَلَى قَرَارِيطَ لِأَهْلِ مَكَّةَ
‘আল্লাহর প্রেরিত সকলই নবিই বকরি চরিয়েছেন।’
সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘আপনিও চরিয়েছেন?’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আমি মক্কার বিভিন্ন উপত্যকায় বকরি চরিয়েছি।’ বুখারি : ২২৬৮।

বকরি চরানোর দ্বারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাঝে শান্ত ভাব সৃষ্টি হয়। আল্লাহর বিশাল সৃষ্টি মরুভ‚মি অবলোকনের সুযোগ হয়। রাতের নিকষ অন্ধকার এবং চাঁদের আলোতে কায়মনোবাক্যে মুনাজাতের আগ্রহ তৈরি হয়। ধৈর্য, অল্পেতুষ্টি, নিবিষ্টতা, দুর্বলের ওপর অনুগ্রহ করার মানসিকতা তৈরি হয়। মানুষের শক্তিধর সত্তা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর দ্বারা তাঁর মাঝে দুর্বলকে ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা বেড়ে ওঠে। উর্বরতা এবং শুষ্কতা অনুধাবন করতে শেখে। ধ্বংস এবং অন্যের বস্তু নষ্ট করার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারে। একটি দুর্বল প্রাণী পোষমানা প্রাণী চরানোর দ্বারা মানুষের মাঝে এত গুণের সমাহার ঘটে। আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ আস সাহিহা : ১/১০৬,

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদিসে মুসলমানদেরকে প্রাণীদের সাথে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর বকরি চরানোর কারণে পরবর্তীতে সেটা উম্মাতের অবস্থা অনুধাবন করতে সহযোগিতা করেছে।

ছাগল চরালে রাখালের মাঝে বেশ কিছু ভালো গুণের সমাহার ঘটে :
 ধৈর্য
কারণ, রাখালকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বকরির খাবারের জায়গার দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন হয় রাখালের পর্যাপ্ত ধৈর্যের। এমনভাবে মানুষের তারবিয়াত প্রদানেও প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।
রাখাল কোনো প্রাসাদে এবং বিলাসিতায় বসবাস করে না। সে সূর্যের আলোতে প্রাণ ওষ্ঠাগত গরমে বকরি চরায়। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তার সুমিষ্ট পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু শুকনো খাবার ছাড়া অন্য কোনো কিছু তার ভাগ্যে জোটে না। এ অবস্থাতেও এগুলোর ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এভাবে তার ধৈর্যশক্তি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।

 বিনয়াবনতা

রাখালের কাজ হলো বকরির সেবা করা এবং তার পাহারায় নিজেকে নিযুক্ত রাখা। তাকে ঘুমাতে হয় বকরির কাছে। অনেক সময় বকরির পেশাব অথবা বিষ্ঠা তার শরীরে লাগে। কিন্তু তার ক্রোধ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বকরির সাথে লেগে থাকার কারণে তার অন্তর থেকে অহংকার এবং বড়ত্ব দূরীভ‚ত হয়। বিনয়াবনতার গুণে তার আত্মা সজীব হয়ে ওঠে। রাসুল  বলেন,
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ. قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً. قَالَ ্র إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ
‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ একজন লোক জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল, “একজন মানুষ যদি তাঁর পোশাক এবং জুতা উত্তম হওয়াকে পছন্দ করে?” তিনি বললেন, “নিশ্চয় আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। কিন্তু অহংকার সত্য সম্পর্কে অমনোযোগী এবং মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করতে শেখায়।” মুসলিম : ১৪৭

 বীরত্ব শিক্ষা দেয়

কারণ, বকরি রাখালকে সর্বদা হিংস্র প্রাণীর আক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে থাকতে হয়। এতে তার মাঝে বীরত্ব সৃষ্টি হয়। এতে করে সে হিংস্র প্রাণীর মোকাবিলা এবং তাদের আক্রমণ থেকে বকরির পালকে রক্ষা করতে পারে।

 দয়া এবং সৌহার্দ্য

রাখালকে সর্বাবস্থায় বকরির পরিচর্যা করতে হয়। চাই সে সুস্থ হোক, অসুস্থ হোক অথবা হাত-পা ভেঙে যাক। নিজের অসুস্থতার সময়ও প্রাণীর সাথে উত্তম আচরণ করতে হয়। যে প্রাণীর ওপর এতটা অনুগ্রহ করে, অবশ্যই সে মানুষের ওপর আরও বেশি অনুগ্রহ করবে। বিশেষত তিনি যদি হন আল্লাহর রাসুল, আর তাঁকে শিক্ষাদানের জন্য বকরি চরানো হয়। তাঁকে নির্বাচন করা হয় মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করে জান্নাতের পথে পথপ্রদর্শনের জন্য।

 নিজের  ঘাম ঝরানো কামাইয়ের প্রতি ভালোবাসা

আল্লাহ তাআলা চাইলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বকরি চরানো ছাড়াই শিক্ষা দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁকে এবং তাঁর উম্মাতকে নিজ হাতে কামাইয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদানের জন্য তিনি এ কাজ তাকে দিয়ে করিয়েছেন। বকরি চরানোও হাতে কামাইয়ের একটি প্রকার।
ইমাম বুখারি রাহ. মিকদাম রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘নিজের হাতে কামাইয়ের থেকে উত্তম কোনো খাবার নেই। আল্লাহর নবি দাউদ আ. নিজের হাতে কামাই করে খেয়েছেন।’ বুখারি : ২০৭২।

হালাল উপার্জন মানুষের স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত করে। সর্বদা সত্য এবং সঠিক কথা বলতে সাহায্য করে। কত মানুষ তাগুতের কাছে মাথা নত করে, তাদের বাতিল কথা এবং কাজকর্মের ব্যাপারে চুপ থাকে, তাদের কুপ্রবৃত্তির বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে।

খাবার এবং রিজিক অনুসন্ধানের জন্য রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বকরি চরানো তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। চাচাকে সাহায্য করার এ অনুভ‚তি আল্লাহ তাআলা তাঁর মাঝে জাগ্রত করেছিলেন। কারণ, চাচা তাঁকে তাঁর পিতার মতো ভালোবাসতেন। এ জন্য চাচা পুরোপুরি উপার্জনে সক্ষম না হওয়ার কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। এটা তাঁর উন্নত চরিত্রের নিদর্শন। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তাআলা এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি তাঁর পুণ্যবান বান্দাদের ক্ষেত্রে এমন জীবন পছন্দ করেন। আল্লাহ তাআলা রাসুলদের শুরুতেই কদর্যতামুক্ত সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত করেছেন।

রাসুলের বকরি চরানো থেকে মানুষের সবচে বড় শিক্ষা হলো, নিজের হাতের কামাইয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করা। কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *