সহিহ বর্ণনার আলোকে আসহাবে ফিলের ঘটনা

হস্তীবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে কুরআনে একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন। সিরাত এবং ইতিহাসের কিতাবে সে ঘটনা বিস্তারিতভাবে এসেছে। মুফাসসিররা তাফসিরের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ (১) أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ (২) وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيلَ (৩) تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ (৪) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ
‘আপনি কি দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তীবাহিনীর সাথে কীরূপ ব্যবহার করেছেন? তিনি কি তাদের চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দেননি? তিনি তাদের ওপর প্রেরণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, যারা তাদের ওপর পাথরের কঙ্কর নিক্ষেপ করছিল। অতঃপর তিনি তাদের ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দেন।’ -সুরা ফিল : ১-৪।
হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম   এ ঘটনার দিকে ইশারা করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদাইবিয়ার বছরযখন উমরা করার জন্য বের হলেন, ‘সানিয়া’ নাম জায়গায় আসার পর তাঁদের বাহন থেমে গেল। সামনে এগোতে চাইল না। মানুষ বলল, ‘হাল! হাল’! তারা বলল, ‘সম্ভবত বিশাল কোনো ঘটনা ঘটেছে।’
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কোনো কিছু ঘটেনি। হস্তীবাহিনীকে যিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আমাদের বাহনকে থামিয়ে দিয়েছেন।’ ফাতহুল বারি : ৫/৩৩৫।

আবু হাতিম আসসিরাতুন নাবাবিয়্যাহতে হস্তিবাহিনীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনা হলো—
ইয়ামানে একজন প্রভাশালী বাদশাহ ছিল। সে মূলত হাবশার বংশধর। তার নাম ছিল ‘আবরাহা’। সে ইয়ামানের রাজধানী সানায় একটি বিশাল গির্জা নির্মাণ করে। আরব ঐতিহাসিকগণ একে ‘আল কালিস’ বা ‘আল কুল্লাইস’ নামে উল্লেখ করেছেন। তার ইচ্ছে ছিল কাবার পরিবর্তে মানুষ এ ঘরের হজ করবে।
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনামতে—‘এ কাজটি সম্পন্ন করার পর সে হাবশার বাদশাহকে লিখে জানায়, “আমি আরবদের হজকে মক্কার কাবার পরিবর্তে সানার এ গির্জার দিকে ফিরিয়ে না দিয়ে ক্ষান্ত হব না। আমরা এখন থেকে প্রতিবছর এখানে হজের আয়োজন করব।” সিরাতে ইবনে ইসহাক : ১০৫।

ইবনে কাসির লিখেছেন—‘সে ইয়ামানি প্রকাশ্যে নিজের এই সংকল্পের কথা প্রকাশ করে এবং চতুর্দিকে ঘোষণা করে দেয়। আমাদের মতে তার এ ধরনের কার্যকলাপের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এর ফলে আরবরা ক্ষুব্ধ হয়ে এমন কোনো কাজ করে বসবে, যাকে বাহানা বানিয়ে সে মক্কা আক্রমণ করে কাবাঘর ধ্বংস করে দেওয়ার সুযোগ লাভ করবে।’ আসসিরাতুন নাবাবিয়্যাহ : ১/৩০-৩৮, ইবনে কাসির।

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন—‘তার এ ধরনের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে জনৈক আরব কোনোমতে তার গির্জার মধ্যে প্রবেশ করে সেখানে মল ত্যাগ করে।’ সিরাতে ইবনে ইসহাক : ১০৬।

ইবনে কাসির বলেন, ‘এ কাজটি করেছিল একজন কুরাইশি।’ আসসিরাতুন নাবাবিয়্যাহ : ১/৩৮, ইবনে কাসির।

অন্যদিকে মুকাতিল ইবনে সুলায়মানের বর্ণনামতে—‘কয়েকজন কুরাইশ যুবক গিয়ে সেই গির্জার আগুন লাগিয়ে দেয়।’
এর মধ্য থেকে যেকোনো একটি ঘটনাই যদি সত্যি ঘটে থাকে, তাহলে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, আবরাহার এ ঘোষণাটি ছিল নিশ্চিতভাবে মারাত্মক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। এ কারণে প্রাচীন জাহিলি যুগের কোনো আরব বা কুরাইশির অথবা কয়েকজন কুরাইশি যুবকের পক্ষে উত্তেজিত হয়ে গির্জাকে নাপাক করা অথবা তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া কোনো অস্বাভাবিক বা দুর্বোধ্য ব্যাপার ছিল না।

কিন্তু আবরাহার নিজের পক্ষেও নিজের কোনো লোক লাগিয়ে গোপনে গোপনে এই ধরনের কোনো কাÐ করে ফেলাটাও অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয় না। কারণ, সে এভাবে মক্কা আক্রমণ করার বাহানা সৃষ্টি করতে এবং কুরাইশদের ধ্বংস ও সমগ্র আরববাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দিয়ে নিজের উভয় উদ্দেশ্যে সফলকাম হতে পারবে বলে মনে করছিল।

মোটকথা, দুটি অবস্থার মধ্য থেকে যেকোনো একটিই সঠিক হোক না কেন—আবরাহার কাছে যখন এ রিপোর্ট পৌঁছল যে, কাবার ভক্ত-অনুরক্তরা তার গির্জার অবমাননা করেছে, তখন সে কসম খেয়ে বসে—‘কাবাকে গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি স্থির হয়ে বসব না।’

তারপর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে সে ৬০ হাজার পদাতিক, ১৩টি হাতি সহকারে মক্কার পথে রওনা হয়। পথে প্রথমে ‘জু-নফর’ নামক ইয়ামানের একজন সরদার আরবদের একটি সেনাদল সংগ্রহ করে তাকে বাধা দেয়। কিন্তু যুদ্ধে সে পরাজিত ও ধৃত হয়।

তারপর খাশআম এলাকায় নুফাইল ইবনে হাবিব খাশআমি তার গোত্রের লোকদের নিয়ে তার পথরোধ করে। কিন্তু সেও পরাজিত ও গ্রেপ্তার হয়ে যায়। সে নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য আবরাহার সেনাদলের পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

এ সেনাদল তায়েফের নিকটবর্তী হলে তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আবরাহার সাথে সাক্ষাত করে। তারা তাকে বলে, ‘আপনি যে উপাসনালয়টি ভাঙতে এসেছেন, আমাদের এ মন্দিরটি সে উপাসনালয় নয়। সেটি মক্কায় অবস্থিত। কাজেই আপনি আমাদেরটায় হাত দেবেন না। আমরা মক্কার পথ দেখাবার জন্য আপনাকে পথপ্রদর্শক সংগ্রহ করে দিচ্ছি।’

আবরাহা তাদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে বনু সাকিফের আবু রিগাল নামক ব্যক্তিকে আবরাহার পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করে। কিন্তু মুগাম্মিস নামক জায়গায় পৌঁছানোর পর সে ইনতেকাল করে। আরবরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত তার কবরে পাথর মেরে এসেছে। বনি সাকিফকেও তারা বছরের পর বছর ধরে এই বলে ধিক্কার দিয়ে এসেছে—‘তোমরা লাতের মন্দির বাঁচাতে গিয়ে আল্লাহর ঘরের ওপর আক্রমণকারীদের সাথে সহযোগিতা করেছ।’

‘আল মাগাম্মাস’ থেকে আবরাহা তার অগ্রবাহিনীকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। তারা তিহামার অধিবাসী ও কুরাইশদের উট, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি বহু পালিত পশু লুট করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবেরও ২০০টি উট ছিল। এরপর সে মক্কাবাসীর কাছে হুমাতা হিময়ারিকে দূত হিসেবে প্রেরণ করে। তার মাধ্যমে মক্কাবাসীদের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠায়—‘আমি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমি এসেছি শুধু এই ঘরটি (কাবা) ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। যদি তোমরা যুদ্ধ না করো, তাহলে তোমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পত্তির কোনো ক্ষতি আমি করব না।
তা ছাড়া তার এক দূতকে মক্কাবাসীর কাছেও পাঠায়। মক্কাবাসীরা যদি তার সাথে কথা বলতে, চায় তাহলে তাদের সরদারকে তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়।

আবদুল মুত্তালিব তখন ছিলেন মক্কার সবচে বড় সরদার। দূত তার সাথে সাক্ষাত করে আবরাহার পয়গাম তাঁর কাছে পৌঁছিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ‘আবরাহার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। এটা আল্লাহর ঘর। তিনি চাইলে তাঁর ঘর রক্ষা করবেন।’
দূত বলে, ‘আপনি আমার সাথে আবরাহার কাছে চলুন।’

তিনি সম্মত হয়ে দূতের সাথে আবরাহার কাছে যান। তিনি এতই সুশ্রী, আকর্ষণীয় ও প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, আবরাহা তাঁকে দেখে অত্যন্ত প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। সে সিংহাসন থেকে নেমে এসে নিজে তাঁর কাছে বসে পড়ে। সে তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী চান?’
তিনি বলেন, ‘আমার যে উটগুলো ধরে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আমাকে ফেরত দেওয়া হোক।’
আবরাহা বলল, ‘আপনাকে দেখে তো আমি বড়ই প্রভাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু আপনি নিজের উটের দাবি জানাচ্ছেন, অথচ এই যে ঘরটা আপনার ও আপনার পূর্বপুরুষদের ধর্মের কেন্দ্র, সে সম্পর্কে কিছুই বলছেন না। আপনার এ বক্তব্য আপনাকে আমার দৃষ্টিতে মর্যাদাহীন করে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি তো কেবল আমার উটের মালিক এবং সেগুলোর জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আর এই ঘরের একজন রব, মালিক ও প্রভু আছেন। তিনি নিজেই এর হেফাজত করবেন।’
আবরাহা জবাব দেয়, ‘তিনি একে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।’
আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘এ ব্যাপারে আপনি জানেন আর তিনি জানেন।’ এ কথা বলে তিনি সেখান থেকে উঠে পড়েন। আবরাহা তাঁকে তাঁর উটগুলো ফিরিয়ে দেয়।

ইবনে আব্বাস রা. ভিন্ন ধরনের বর্ণনা পেশ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় উট দাবির কোনো কথা নেই।
আবদ ইবনে হুমাইদ, ইবনুল মুনজির, ইবনে মারদুইয়া, হাকিম, আবু নুআইম ও বায়হাকি তাঁর থেকে যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন; তাতে তিনি বলেন,
আবরাহা আসসিফাই পৌঁছে গেলে আবদুল মুত্তালিব নিজেই তার কাছে যান এবং তাকে বলেন, ‘আপনার এখানে আসার কী প্রয়োজন ছিল? আপনার কোনো জিনিসের প্রয়োজন থাকলে আমাদের কাছে বলে পাঠাতেন। আমরা নিজেরাই সে জিনিস নিয়ে আপনার কাছে পৌঁছে যেতাম।’

জবাবে সে বলে, ‘আমি শুনেছি, এটি শান্তি ও নিরাপত্তার ঘর। আমি এর শান্তি ও নিরাপত্তা খতম করতে এসেছি।’
আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘এটি আল্লাহর ঘর। আজ পর্যন্ত তিনি কাউকে এর ওপর চেপে বসতে দেননি।’
আবরাহা জবাব দেয়, ‘আমি একে বিধ্বস্ত না করে এখান থেকে সরে যাব না।’
আবদুল মুত্তালিব বলেন, ‘আপনি যা কিছু চান আমাদের কাছ থেকে নিয়ে চলে যান।’ কিন্তু আবরাহা অস্বীকার করে। আবদুল মুত্তালিবকে পেছনে রেখে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন—
‘আবরাহার সেনাদলের কাছ থেকে ফিরে এসে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের বলেন, “নিজেদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে পাহাড়ের ওপর চলে যাও, এভাবে তারা ব্যাপক গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে।” সরাতে ইবনে ইসহাক: ৬৮

তারপর তিনি ও কুরাইশের কয়েকজন সরদার হারাম শরিফে হাজির হয়ে যান। তারা কাবার দরজার কড়া ধরে আল্লাহর কাছে এই বলে দুআ করতে থাকেন—তিনি যেন তাঁর ঘর ও তাঁর খাদিমদের হেফাজত করেন। সে সময় কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। কিন্তু এই সংকটকালে তারা সবাই এই মূর্তিগুলোর কথা ভুলে যায়। তারা একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার জন্য হাত ওঠায়।
ইতিহাসের বইগুলোতে তাদের প্রার্থনাবাণী উদ্ধৃত হয়েছে। তার মধ্যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নাম পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ইবনে হিশাম তার সিরাতগ্রন্থে আবদুল মুত্তালিবের নি¤েœাক্ত কবিতাসমূহ উদ্ধৃত করেছেন :
‘হে আল্লাহ, বান্দা নিজের ঘর রক্ষা করে তুমিও তোমার ঘর রক্ষা করো।’
‘আগামীকাল তাদের ক্রুশ ও তাদের কৌশল যেন তোমার কৌশলের ওপর বিজয় লাভ না করে।’
‘যদি তুমি ছেড়ে দিতে চাও তাদের ও আমাদের কিবলাকে, তাহলে তা-ই করো যা তুমি চাও।

সুহাইলি রওজুল উনুফ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত  কবিতাও উদ্ধৃত করেছেন :
‘ক্রুশের পরিজন ও তার পূজারিদের মোকাবিলায় আজ নিজের পরিজনদের সাহায্য করো।’

আবদুল মুত্তালিব দুআ করতে করতে যে কবিতাটি পড়েছিলেন ইবনে জারির সেটিও উদ্ধৃত করেছেন। সেটি হচ্ছে :
‘হে আমার রব, তাদের মোকাবিলায় তুমি ছাড়া কারও প্রতি আমার আশা নেই।
হে আমার রব, তাদের হাত থেকে তোমার হারামের হেফাজত করো।
এই ঘরের শত্রু তোমার শত্রু, তোমার জনপদ ধবংস করা থেকে তাদের বিরত রেখো।’

এ দুআ করার পর আবদুল মুত্তালিব ও তার সাথিরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর বর্ণনায় আবরাহা বাহিনীর ধ্বংস হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। পরের দিন আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু তার বিশেষ হাতি ‘মাহমুদ’; যা ছিল সবার আগে—হঠাৎ বসে পড়ে। কুড়ালের বাট দিয়ে তার গায়ে অনেকক্ষণ আঘাত করা হয়। তারপর বার বার আঘাত করতে করতে আহত করে ফেলা হয়। কিন্তু এত বেশি মারপিট ও নির্যাতনের পরেও সে একটুও নড়ে না। তাকে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে মুখ করে চালাবার চেষ্টা করলে সে ছুটতে থাকে; কিন্তু মক্কার দিকে মুখ ফিরিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ে। কোনোরকমেই তাকে আর একটুও নড়ানো যায় না।

এ সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ঠোঁটে ও পাঞ্জায় পাথরকণা নিয়ে উড়ে আসে। তারা এ সেনাদলের ওপর পাথর বর্ষণ করতে থাকে। যার ওপর পাথরকণা পড়ত, তার দেহ সঙ্গে সঙ্গে গলে যেতে থাকত।
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও ইকারামার বর্ণনামতে—সেটা ছিল বসন্ত রোগ এবং আরব দেশে সর্বপ্রথম এ বছরই বসন্ত দেখা যায়।
ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনামতে—যার ওপরই পাথরকণা পড়ত তার সারা গায়ে ভীষণ চুলকানি শুরু হতো এবং চুলকাতে চুলকাতে চামড়া ছিঁড়ে মাংস ও রক্ত পানির মতো ঝরতে থাকত এবং হাড় বের হয়ে পড়ত। আবরাহা নিজেও এই অবস্থার সম্মুখীন হয়। তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়ত এবং যেখান থেকে এক টুকরো গোশত খসে পড়ত সেখান থেকে রক্ত ও পুঁজ ঝরে পড়তে থাকত। বিশৃঙ্খলা ও হুড়োহুড়ি-ছোটাছুটির মধ্যে তারা ইয়ামানের দিকে পালাতে শুরু করে।
‘খাশআম’ এলাকা থেকে যে নুফাইল ইবনে হাবিব খাশআমিকে তারা পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়ে আসে, তাকে খুঁজে পেয়ে সামনে নিয়ে আসা হয় এবং তাকে ফিরে যাবার পথ দেখিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু সে সরাসরি অস্বীকার করে বসে। সে বলে—
‘এখন পালাবার জায়গা কোথায়?
যখন আল্লাহ নিজেই করছেন পশ্চাদ্ধাবন?
আর নাককাটা আবরাহা পরাজিত
সে বিজয়ী নয়।’
এই পলায়ন তৎপরতার মধ্যে লোকেরা পথে-ঘাটে, এখানে-সেখানে পড়ে মরতে থাকে।
আতা ইবনে ইয়াসার বর্ণনা করেছেন, ‘তখনই একসাথে সবাই মারা যায়নি; বরং কিছু লোক সেখানে মারা পড়ে আর দৌড়াতে দৌড়াতে কিছু লোক পথের ওপর পড়ে যেতে থাকে। এভাবে সারাটা পথে তাদের লাশ বিছিয়ে থাকে। আবরাহাও খাশআম এলাকায় পৌঁছে মারা যায়।’

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *