রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন হিলফুল ফুজুল গঠন করেছিলেন?

হারবুল ফিজার তথা অন্যায় যুদ্ধ থেকে ফেরার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হিলফুল ফুজুল’ পরিষদ গঠন করেন। কারণ ছিল, ‘জাবিদ’ গোত্রের একজন লোক মক্কায় কিছু পণ্য নিয়ে আসে। আস বিন ওয়াইল তার থেকে পণ্য ক্রয় করেন। কিন্তু মূল্য পরিশোধ করতে অস্বীকার করেন। জাবিদি ওই ব্যক্তি কুরাইশের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে তার মূল্যের কথা বলে। কিন্তু কেউ তাকে সহযোগিতা করেনি। সে তখন কাবার পাশে গিয়ে ফিহিরের পরিবার এবং বিবেকবান মানুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করেন :
“হে ফিহিরের পরিবার! একজন মাজলুম পাথেয় হারিয়ে, তোমাদের পথে, প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
আশআসের সম্ভ্রান্ত লোকেরা তার পাওয়া শোধ করেনি, হে যুবক! তুমি দুই পাথরের মধ্যখানে আছো।”

জুবায়ের বিন আবদুল মুত্তালিব তখন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তার অধিকার কেন পরিত্যাজ্য হবে?’
বনু হাশিম, জুহরা, বনু তাইম বিন মুররা আবদুল্লাহ বিন জুদআনের ঘরে একত্র হলো এবং তার জন্য খাবার তৈরি করল। সম্মানিত মাস জুলকাদাতে তারা আল্লাহর নামে শপথ করে এ বিষয়ে অঙ্গীকার করল যে, মাজলুমের পক্ষে জালিমের বিরুদ্ধে তারা একতাবদ্ধ থাকবে। তারা যেকোনো মূল্যে মাজলুম ব্যক্তির অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে।

এরপর তারা আস বিন ওয়ায়েলের কাছে গিয়ে তার থেকে জাবিদি গোত্রের মূল্য আদায় করে তার নিকট হস্তান্তর করল। কুরাইশরা এ একতাকে নামকরণ করল ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে। জুবায়ের বিন আবদুল মুত্তালিব হিলফুল ফুজুলের ব্যাপারে বলেন,
‘ফুজুলের যুবকেরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে যে, মক্কায় কোনো অত্যাচারী থাকতে পারবে না।
এ ব্যাপারে অঙ্গীকার এবং দীপ্ত শপথ নিয়েছে—প্রতিবেশী এবং দর্শনার্থী এখানে নিরাপদ থাকবে।’
রাসুল  এ সংঘে অংশগ্রহণ করেন এবং জুলুমের প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দেন। সত্যকে সমুন্নত করেন। এটাকে আরবের গর্বের বিষয় এবং মানুষের অধিকার আদায়ে তাদের ভ‚মিকা হিসেবে পেশ করা হয়। আস সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ : ১/২১৩, আবু শাহাবা।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘আমি আমার চাচার সাথে ছোট থাকাবস্থায় পুণ্যবানদের সংঘে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আরবের অসংখ্য লাল উটের মালিক হওয়া এর তুলনায় আমার নিকট প্রিয় ছিল না।’
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
‘আবদুল্লাহ বিন জাদআন-এর ঘরে আমি শপথ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। আরবের অসংখ্য লাল উটের মালিক হওয়া থেকে আমার নিকট বিষয়টি ছিল অধিক প্রিয়। যদি তাদের তখন ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়া হতো, তারা গ্রহণ করতো।’ সহিহুস সিরাতিন নাবাবিয়্যাহ : ৫৯

এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ন্যায়পরায়ণতা একটি ব্যাপক বিষয়। এটি কোনো গোত্রের সাথে নির্দিষ্ট নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুরুতেই গুরুত্বের সাথে ন্যায়পরায়ণতাকে মজবুত করার চেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও সে মানুষগুলো ছিল জাহেলি যুগের। তারপরও তাদের কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।

জাহিলি মরুদ্যানে হিলফুল ফুজুল পরিষদ গঠন থেকে এ বিষয়টি অনুধাবন করা যায় যে, অন্ধকারে পুরো পৃথিবী ছেয়ে গেলেও কিছু ভালো মানুষ তখনো ছিল। মক্কা ছিল মূর্খতা এবং মূর্তিপূজার তীর্থস্থান। এ ছাড়া অন্যান্য খারাপ কাজ, যেমন : অত্যাচার, ব্যভিচার এবং সুদের অভয়ারণ্য। এরপরও সেখানে বিবেকের অধিকারী কিছু মানুষ ছিলেন। যারা অত্যাচারকে অপছন্দ করতেন এবং সেগুলোর ধারে-কাছে যেতেন না। এ ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে ওই সমস্ত দায়িদের জন্য, যারা অনৈসলামিক সমাজে দাওয়াত প্রদান করে থাকেন।

জুলুম যেভাবেই হোক, সেটা পরিত্যাজ্য। ইসলাম জুলুমের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলাম মাজলুমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

কল্যাণের কাজে শপথ এবং সংঘ প্রতিষ্ঠা করা জায়িজ আছে। এটাও একপ্রকারের সাহায্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ أَنْ صَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَنْ تَعْتَدُوا وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الأِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
‘যারা পবিত্র মাসজিদ থেকে তোমাদের বাধা প্রদান করেছিল, সে সম্প্রদায়ের শত্রæতা যেন তোমাদের সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম এবং খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ এবং সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা কোরো না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তিদাতা।’ -সুরা মায়েদা : ০২।

এমন কোনো অবস্থায় মুসলমানদের জন্য একতাবদ্ধ হওয়া জায়িজ আছে। কেননা, এর দ্বারা শরিয়তসিদ্ধ কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করা হয়। তবে যেন সংঘ মাসজিদে জেরার-এর সদৃশ না হয়। যেখানে বসে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবে।

অত্যাচারকে দূর করার জন্য এবং মাজলুম ব্যক্তির সাহায্যের জন্য মুসলমানরা সংঘ করতে পারে। উদ্দেশ্য থাকতে হবে বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদের কল্যাণ। এতে ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। এ হাদিস এর পক্ষে প্রমাণ বহন করে। রাসুল  বলেছেন, ‘আরবের লাল উটের মালিক হওয়া থেকে বিষয়টি আমার নিকট অধিক প্রিয়।’

তিনি অত্যাচার দূর করাকে তৎকালীন আরবের সবচে মূল্যবান সম্পদ লাল উটের মালিক হওয়া থেকেও প্রিয় বলেছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা—‘যদি তাদের তখন ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়া হতো, তারা গ্রহণ করতো”—দ্বারা অনুধাবন করা যায় যে, জালিমের অত্যাচার রুখে দেওয়ার দ্বারা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতা তৈরি হয়। এ ছাড়া এ সংঘের বেশির ভাগ পরবর্তী সময়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

মুসলমানরা সবসময় সামাজিক কাজে অগ্রগামী থাকবে একতাবদ্ধ হয়ে। তারা কখনো বিক্ষিপ্ত থাকবে না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামাজিক জীবনের উপমা ছিলেন। তারা তাঁকে ‘আল আমিন’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেছিল। তাঁর উত্তম চরিত্রের কারণে সকলেই তাঁর দিকে ধাবিত হয়েছিল। এটা বৃদ্ধি পেতে পেতে তাঁর পুরো সম্প্রদায়ের অন্তর তার সাথে গেঁথে ছিল। এটা আমাদের উত্তম চরিত্রগঠনের নির্দেশনা প্রদান করে। সাথে সাথে চরিত্রবান লোককে সম্মান করার কথা বলে।

 

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *