কুরআনের ব্যাপারে মুসলমানদের সরল আকিদা হল, কুরআন আল্লাহর কালাম। পক্ষবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ, মুশরিকদের কেউ আপক্ষনার কাছে আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিবেন। যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়। এরপর তাকে তার নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেবে। কারণ, তারা জানে না। সূরা তাওবা: ৬।
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:
يُرِيدُونَ أَنْ يُبَدِّلُوا كَلَامَ اللَّهِ
অর্থ, তারা চায় আল্লাহর কালামকে পরিবর্তন করে দিতে। সূরা ফাতহ: ১৫।
এ ধরণের আরও অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেখানে কুরআনকে আল্লাহর কালাম বলা হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা এবং তাবিয়িনদের যুগে কুরআন নিয়ে আকিদা কেন্দ্রিক কোন বিতর্ক ছিল না। তাদের সরল আকিদা ছিল, কুরআন আল্লাহর কালাম। কিন্তু অন্যান্য সভ্যতা এবং মতাদর্শের সঙ্গে বিশেষ করে গ্রীক মতাদর্শের সঙ্গে মুসলমানরা যখন পরিচিত হল, তখন কেউ কেউ কুরআন আল্লাহর কালাম এটা অস্বীকার করে। তারা বলতে বলতে থাকে কুরআন হলো মাখলুক তথা সৃষ্ট! জাদ ইবনে দিরহাম, জাহম ইবনে সাফওয়ান সহ কেউ কেউ এ মতাদর্শ প্রচার করেন। হকপন্থি আলেমগণ শক্তভাবে তাদের খণ্ডন করেন।
হিজরি তৃতীয় শতকে মুতাজিলাদের দ্বারা এ ফিতনা নতুন করে হাওয়া পায়। মুতাজিলা তাদের ভ্রান্ত আকিদার পক্ষে খলিফাকে পেয়ে যায়। হকপন্থি আলেমদের যারা প্রতিবাদ করতেন, তাদের বক্তব্য খণ্ডন করতেন। শুরু হল তাদের কন্ঠরোধ করা। জেল, জুলুমের দিকেও গড়ায় ব্যাপারটি। ইতিহাসে সে সময়টাকে ‘মিহনায়ে খলকে কুরআন’ বলা স্মরণ করা হয়। খলিফা মামুন, মুতাসিম এরা বিদায় নিলে ধীরে ধীরে সে ফিতনার আগুন নিভে যায়। ১৪ শত বছরের উম্মাহর অকাট্য আকিদা হলো, কুরআন আল্লাহর কালাম। মাখলুক নয়।
এখানে এ ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নেই। শুধু ইমাম তাহাবি রাহি. এর বক্তব্য পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। তিনি কুরআন সংক্রামত্ম আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন:
وَإِنَّ الْقُرْآنَ كَلَامُ اللَّهِ، مِنْهُ بَدَا بِلَا كَيْفِيَّةٍ قَوْلًا، وَأَنْزَلَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَحْيًا، وَصَدَّقَهُ الْمُؤْمِنُونَ عَلَى ذَلِكَ حَقًّا، وَأَيْقَنُوا أَنَّهُ كَلَامُ اللَّهِ تَعَالَى بِالْحَقِيقَةِ، لَيْسَ بِمَخْلُوقٍ كَكَلَامِ الْبَرِيَّةِ، فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلَامُ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ، وَقَدْ ذَمَّهُ اللَّهُ وَعَابَهُ، وَأَوْعَدَهُ بِسَقَرَ،
অর্থাৎ কুরআন আল্লাহর কালাম। আল্লাহ থেকে বাণী হিসাবে কোন ধরণের অবস্থা ও আকৃতি ছাড়া এর প্রকাশ ঘটেছে। আল্লাহ তাআলা ওহি হিসাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ করেছেন। মুমিনগণ হিসাবে কুরআনকে সত্যায়ন করে নিয়েছে। তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে, প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহর কালাম। এটি সৃষ্টির কথার মতো সৃষ্ট নয়। সুতরাং কেউ এ কালাম শুনার পর যদি ধারনা করে, এটি মানুষের কথা, সে কাফের। আল্লাহ তাআলা এ ধরণের লোকদের নিন্দা করেছেন, তাদের দোষী সাব্যস্থ করেছেন এবং জাহান্নামের ধমক দিয়েছেন। আকিদাতুত তাহাবি: ৫।
কুরআন আল্লাহর কালাম। কালাম আল্লাহর সিফাত তথা গুণ। আল্লাহর সিফাত তাঁর সৃষ্টি হতে পারে না। সিফাত সৃষ্টি হলে তাঁরও সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ সৃষ্টি নয়, বরং তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। এ কারণে ইমাম তাহাবি রাহি. বলেন, সুতরাং কেউ এ কালাম শুনার পর যদি ধারনা করে, এটি মানুষের কথা, সে কাফের।
ইমাম বুখারি রাহি. এর যুগে ‘খলকে কুরআন’ এর মাসআলা নিয়ে মতানৈক্য ছিল তুঙ্গে। ইমাম বুখারি যখন নিশাপুরে এলেন, তাকে ঘিরে মজলিস জমে গেল। দূর, দূরান্ত থেকে ইমাম বুখারির মজলিসে শরিক হওয়ার জন্য মানুষ পঙ্গপালের মত আসতে থাকল। এতে করে নিশাপুরের কিছু শায়খদের হিংসা জেগে উঠল। তারা প্রচার করতে থাকল যে, ইমাম বুখারি কুরআনের শব্দকে মাখলুক তথা সৃষ্ট বলেন!
পরের দিন ইমাম বুখারির মজলিসে যখন লোকজন একত্রিত হল, একজন দাঁড়িয়ে তার কাছে জানতে চাইল , কুরআনের লফজ তথা শব্দের ব্যাপারে আপক্ষনার মতামত কী? সেটা সৃষ্ট কি সৃষ্ট না? ইমাম বুখারি প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন! জবাব দিলেন না! ওই ব্যক্তি আবার প্রশ্ন করলে ইমাম বুখারি পূণরায় এড়িয়ে গেলেন! তৃতীয়বার প্রশ্ন করলে ইমাম বুখারি রাহি. জবাব দেন, ‘‘কুরআন আল্লাহর কালাম, সৃষ্ট নয়। বান্দার কাজ সৃষ্ট। এটিকে কেন্দ্র করে পরীক্ষা করা বেদআত।’’
ইমাম বুখারি উত্তর শুনে মানুষের মাঝে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। মানুষ নানা দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কেউ বলল, তিনি কুরআনকে মাখলুক বলেছেন। আবার কেউ বলর, বলেন নি! হট্রগোল শুরু হল। ইমাম বুখারি আপন জায়গায় বসে থাকলেন।[1]
ইমাম বুখারি রাহি. এর কথা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। তিনি বলেছেন, মানুষের আওয়াজ, উচ্চারণ, হরকত, লেখা এগুলো সৃষ্ট। কিন্তু মূল আল্লাহর পঠিত কুরআন হল আল্লাহর কালাম। সেটা মাখলুক তথা সৃষ্ট নয়।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি মনে হচ্ছে। কুরআনের শব্দ সৃষ্ট কি না? এ ব্যাপারে ইমাম বুখারি রাহি. যে মতামত দিয়েছেন, সেটা হল ইমাম আযম আবু হানিফা রাহি. এর মাজহাব। তিনি। ইমাম আযম আবু হানিফা রাহি. এ ব্যাপারে সমাধানমূলক যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা হল:
“ما قام بالله غير مخلوق. وما قام بالخلق مخلوق.
অর্থাৎ আল্লাহর তিলাওয়াতকৃত মূল কুরআন মাখলুক নয়। কিন্তু আমাদের তিলাওয়াতকৃত, আওয়াজ, হরকত এগুলো সৃষ্ট। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১০/১১১।
ইমাম বুখারির মতামত দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। এ সংবাদ মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়া জুহলি রাহি. এর কাছে পৌঁছালে তিনি বললেন, যারা বুখারির মজলিসে বসে, তারা যেন তার মজলিসে না বসে। কারণ, লোকজন বাগদাদ থেকে পত্র লিখেছে যে, তিনি কুরআনের লফজ মাখলুক কী মাখলুক না? এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। আমরা তাকে নিষেধ করেছিলাম। তিনি নিষেধ মানেন নি। তোমরা কেউ তার নিকটবর্তী হয়ো না। তার কাছে গেলে আমার কাছে আসবে না। কারণ, ইমাম জুহলির মতামত ছিল, কোন কুরআনই মাখলুক নয়। যারা আমাদের উচ্চারিত কুরআনকে মাখলুক বলবে, তারা বেদআতি। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১০/১১১।
এরপক্ষর ইমাম বুখারি রাহি. কিছুদিন নিশাপুরে অবস্থান করে বুখারায় চলে আসেন।
ইমাম বুখারি রাহি. যখন বুখারায় আসলেন, বুখারার গভর্ণর সহ সকল মানুষ কয়েক ক্রোশ দূর থেকে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে নিয়ে আসে। বলা হয়, সে দিন তাকে দিনার, দিরহামের হাদিয়ায় ভাসিয়ে দেয়। কিছুদিন তিনি বুখারায় অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে ইমাম জুহলি বুখারার গভর্ণর খালিদ বিন আহমদের কাছে পত্র লিখেন যে, এ লোক আহলুস সুন্নাহর বিপরিত আকিদা পোষণ করে। শুরু হল বুখারায় হইচই। বুখারার গভর্ণর তাকে শহর ছেড়ে চলে যেতে বলেন। ইমাম বুখারি জন্মভূমি বুখারা থেকে বের হয়ে আসেন।
বুখারার গভর্ণর আগ থেকেই ইমাম বুখারির উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ হল, তিনি ইমাম বুখারির কাছে বার্তা পাঠিয়ে ছিলেন যে, আমার বাসভবনে এসে আপনি সহিহ বুখারি এবং ‘আত তারিখুল কাবির’ আমার সন্তানদের পড়িয়ে দিবেন। জবাবে ইমাম বুখারি বলেন, ‘আমি ইলমকে তুচ্ছ করতে পারব না। যদি তাদের পড়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে মসজিদে কিংবা আমার বাসভবনে আসতে বলবেন।’ গভর্ণর অনুরোধ করলেন, তাহলে সে মজলিসে যেন অন্য কোন ছাত্র না তাকে। ইমাম বুখারি সেটাও মানেন নি। তার ভাষ্যমতে সেটা হবে ইলম গোপন করার নামান্তর। এতে গভর্ণর তার উপক্ষর ভীষণ ক্ষুব্ধ হোন। সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১০/১১৭।
ইমাম বুখারি রাহি. বুখারা থেকে বের হয়ে সমরকন্দ এর নিকটবর্তী ‘খরতঙ্গ’ নামক এলাকায় চলে আসেন। সেখানে তার কিছু নিকটাত্মীয় ছিলেন। এখানে এসে ইমাম বুখারি রাহি. ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার মাঝে তিনি একদিন শুনতে পারেন যে, তাকে সমরকন্দ থেকে বের করে দেওয়ার ঘোষনা হচ্ছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে ইমাম বুখারি বাহনের দিকে এগিয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে একান্তচিত্তে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘‘প্রভূ! আপনার প্রশস্ত জমিন আমার জন্য সংকূচিত হয়ে গেছে! আমাকে আপক্ষনার প্রিয় করে নিন।’
অত্যাধিক অসুস্থতার কারণে ইমাম বুখারি দুর্বল হয়ে পড়েন। পা আর সামনে চলছিল না। সেখানেই তিনি শুয়ে পড়েন। ইসলামের ইতিহাসের মহান এ পুরুষ আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস ইমাম বুখারি রাহি. সেখানেই দুনিয়ার সফর শেষ করে আখেরাতের সফর শুরু করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আবদুল ওয়াহিদ বিন আদম রাহি. বর্ণনা করেন, আমি স্বপ্নে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একদল সাহাবি নিয়ে এক জায়গায় অপেক্ষা করতে দেখলাম। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কার অপেক্ষা করছেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, ‘মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল বুখারির অপেক্ষা করছি।’ এর কিছুদিন পর আমার কাছে ইমাম বুখারির মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে। আমি হিসাব করে দেখি, যে দিন আমি স্বপ্ন দেখেছি, সে দিন ইমাম বুখারি রাহি. ইন্তেকাল করেছেন। হাদউস সারি: ৪৯০।
২৫৬ হিজরির ঈদুল ফিতরের রাতে ইমাম বুখারি রাহি. ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৬২ বছর। পরের দিন জোহরের নামাজের পর তার জানাযার অনুষ্ঠিত হয়। খরতঙ্গের শুভ্র, সফেদ ভূমিতে ইমাম বুখারি রাহি. কে দাফনের পক্ষরই কবর থেকে সুঘ্রাণ বের হওয়া শুরু হয়।
[1] সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১০/১১১।