‘সহিহ মুসলিম’ এ আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রাচ্যবিদরা তাদের দাবি প্রমাণের পক্ষে সে হাদীস দ্বারা জোরেশোরে দলিল পেশ করে থাকে। মানুষকে বলে যে , দেখুন! যে হাদীস নিয়ে আপনারা এত লাফালাফি করেন, সে হাদীসের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেন? প্রথমে হাদীসটি দেখুন,
“لاَتَكْتُبُواعَنِّى وَمَنْ كَتَبَ عَنِّى غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ وَحَدِّثُوا عَنِّى وَلاَ حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَىَّ – قَالَ هَمَّامٌ أَحْسِبُهُ قَالَ – مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ”
অর্থাৎ তোমরা আমার থেকে কিছু লিখবে না। যদি কোনো ব্যক্তি কুরআন ব্যতিত অন্য কিছু লিখে ফেলো, তাহলে সে যেন সেগুলো মুছে ফেলে। আমার থেকে হাদীস বর্ণনা করতে কোন অসুবিধা নেই। তবে যে আমার নামে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিলো। মুসলিম, হাদিস নং ৭৭০২.সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৬২.সুনানে দারেমী, হাদিস নং ৪৫৮
প্রাচ্যবিদদের আর ঠেকায় কে? এত সুন্দর সহিহ হাদীস থাকার পরও কেন তোমরা সুন্নাহ নিয়ে লাফালাফি করছো? অথচ খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাহকে মুছে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন! এ সংক্রান্ত সাহাবিদের কিছু কথাও তারা দলিল হিসাবে পেশ করে!
প্রাচ্যবিদদের অভিযোগের জবাব দেওয়ার পূর্বে ভ‚মিকা স্বরুপ কয়েকটি কথা পেশ করছি। আরবের অধিকাংশ মানুষ সাধারণত উম্মি তথা পড়ালেখা জানত না। খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম কে কুরআনে উম্মি নবী বলা হয়েছে। সাথে সাথে ইতিহাস এ কথার সাক্ষী দেয় যে, তাদের মেধা শক্তি খুব প্রখর ছিল। তারা তাদের বংশীয় নসবনামা,গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলি, যুদ্বের ইতিহাস এবং বড় বড় কবিতাবলি মুখস্ত করে রাখত। ইতিহাসে এ কথাও পাওয়া যায় যে,আরবরা তাদের উটের নসবনামাও মুখস্ত করে রাখত। কুরআনে কারিম যখন অবতীর্ণ হচ্ছিল,তখন আরবদের অভ্যাস অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবারা কুরআনকে মুখস্থ করে রাখতেন। আর কুরআন যেহেতু পুরোটাই মুজেযা, সাথে সাথে প্রতিটি শব্দও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত এবং সংরক্ষিত’ কুরআনের একটি শব্দের জায়গায় সমার্থবোধক অন্য শব্দ ব্যাবহারের অনুমতি নেই, এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, যখন যে আয়াত অবতীর্ণ হত, সাহাবাদেরকে মুখস্থ করিয়ে দিতেন। এবং সাথে সাথে কোন লেখককে ডেকে আয়াতটি লিখিয়ে নিতেন। এখানে লক্ষণীয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের মূল লক্ষ ছিল মুখস্থ এবং তেলায়াত। এর সাথে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে লিখে রাখতেন। আরবদের জন্য মুখস্থ করে রাখা ছিলো খুব সহজ এবং সাধারণ বিষয়। এজন্য তিনি প্রথমে মুখস্থ করাতেন। তারপর ওহি লেখকদের ডেকে লিখিয়ে নিতেন।
এর বিপরিতে হাদীস এমন মুজিযা ছিল না যে,তার শব্দও হুবহু সংরক্ষণ করতে হবে। বরং হাদীসের ভাবার্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে ঢেলে দেওয়া হত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম নিজের শব্দ দ্বারা সেটাকে ব্যক্ত করতেন। আর এ শব্দাবলি প্রয়োজন অনুপাতে ভিন্ন ভিন্ন হত। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম কে বিভিন্ন রুচির মানুষকে বুঝাতে হত। এজন্য হুবহু হাদীস তেলায়াতের হুকুম দেওয়া হয়নি।
এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের মেধা শক্তির ব্যাপারে পুরোপুরি নির্ভার ছিলেন। কেননা তারা যা শুনতেন, অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ করে রাখতেন। এজন্য ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাদীস লেখার প্রয়োজন পড়েনি। বরং শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সাথে সাথে এ কথাও বলে দেওয়া হল যে. কেউ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা বলে, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল।
এছাড়া বইয়ের কুরআনের ব্যাপারে যে আলোচনা করেছিলাম, হাদীসের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। সাহাবারা শুধুমাত্র হাদীস শুনেই হাত পা গুঠিয়ে বসে থাকতেন, বিষয়টি কিন্তু এমন না! বরং সাহাবারা সাথে সাথে আমল শুরু করতেন। কোনো কাজ করতে নিষেধ করলে সাথে সাথে সে বিষয় ছেড়ে দিতেন। কোনো বিষয় নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে আমল করা শুরু করে দিলে সেটা হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে যায়। না লিখে রাখলেও সেটা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ কীভাবে পালন করতেন? সেটা একেবারেই সুস্প’। আলাদা করে আলোচনার দরকার নেই। এজন্য না লিখলেই হাদীস সাহাবায়ে কেরাম সংরক্ষিত করেননি, এমন অভিযোগ ঠিক নয়।
এবার পূর্বোল্লিখিত হাদীস নিয়ে একটু কথা বলি। এ হাদীস অনেক বরেণ্য বিশারদদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। বরং এটি হল হযরত আবু সাইদ খুদরি রা. এর উক্তি। বর্ণনাকারী ভুল করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয় সাল্লামের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। এমনটি বলেছেন ইমাম বুখারি সহ আরো কয়েকজন মুহাদ্দিস। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. লিখেন,
ومنهم من اعل حديث أبي سعيد وقال الصواب وقفه على أبي سعيد قاله البخاري وغيره
অর্থাৎ কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ত্রæটিযুক্ত বলেন। তাদের মতে বিশুদ্ধ কথা হলো এটি আবু সাইদ খুদরি রা. এর উক্তি। ইমাম বুখারি সহ অন্য কেউ কেউ এমনটি বলেছেন। ফাতহুল বারী ১/২০৮,
যদি ধরে নেই যে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, তাহলেও এ নিষেধাজ্ঞা সাময়িক। যার কারণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ তায়ালা কোরআন ছাড়াও ‘জাওয়ামিউল কালিম’ অর্থাৎ কম শব্দে অধিক অর্থ প্রকাশের যোগ্যতা দান করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উপমা তিনি নিজেই। এজন্য সম্ভাবনা ছিল,যদি পড়াশুনা জানা নেই এমন লোকদের যারা সবেমাত্র কোরআন শেখা শুরু করেছে,তাদেরকে যদি হাদীস লেখার নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। এজন্য অধিক সতর্কতাবশত তাদেরকে প্রত্যেক জিনিস লিখতে নিষেধ করা হয়। কুরআন ব্যতিত অন্য কিছু লিখে থাকলে মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু আমল তথা কর্মের মাধ্যমে সমস্ত আহকাম এবং ইবাদাতবলির পরিস্কার নকশা সাহাবাদের সামনে ছিলো। শুধুমাত্র লিখে রাখলেই কোনো বিষয় সংরক্ষিত থাকে, বাস্তবতা কিন্তু এমন না কোনো জিনিস কর্মের মাধ্যমে দেখিয়ে দেওয়া এবং সে অনুযায়ী আমল করা মনে রাখার জন্য অধিক উপকারী হয় লিখে রাখার চেয়ে। এজন্য দেখা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বপুর্ণ ইবাদতগুলো দেখে দেখে শিখার কথা বলেছেন। কেননা এর দ্বারা কাজটি স্মৃতিতে গেঁথে যায়। ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
নামাজের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের দীপ্ত ঘোষণা:
“صلوا كما رأيتموني أصلي”
অর্থাৎ তোমরা নামাজ পড়ো যেমনভাবে নামাজ পড়তে আমাকে দেখো। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ২১৩১.আস সুনানুল কুবরা,বায়হাকি; হাদিস নং ৪০২২.
বিদায় হজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম যখন শয়তানকে কংকর মেরেছিলেন,তখন সাহাবাদেরকে লক্ষ করে বলেন,
” خذوا عني مناسككم فإني لا أدري لعلي لا أحج بعد حجتي”
অর্থাৎ তোমরা আমার থেকে হজের পদ্ধতি জেনে নাও।অ ামার জানা নেই যে, হয়ত আগামী বছর তোমাদের সাথে হজ করতে পারব কি না? সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩১৯৭.সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং২৮৭৭.
এখনে লক্ষনীয় বিষয় হলো, নামাজ এবং হজের মতো গুরুত্বপুর্ণ ইবাদত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম দেখে দেখে শিখার কথা বলেছেন। লিখে রাখার কথা বলেননি। কারণ কর্মের দ্বারা যদি হাদীস সংরক্ষণ হয়, তাহলে ভুলে যাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না। এবার যদি আপনি বলেন সংরক্ষণের একমাত্র হলো লিখে রাখা? তাহলে আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করা দরকার যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও বেশি বুঝেন?
এছাড়া বহু কাজ এমন ছিল,যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে করা হত, কিন্তু তিনি নিষেধ করতেন না। পরিভাষায় সেটাকে বলে তাকরির তথা মৌন সমর্থন। সেগুলোও হাদীসের অন্তর্ভূক্ত।
একথা সুস্প’ যে, প্রতিদিনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে এমন বহু ঘটনা সংঘটিত হত,ি কন্তু তিনি নিষেধ করতেন না। এগুলোকেও যদি তিনি লিখে রাখার নির্দেশ দিতেন,তাহলে হাদীসের কিতাব এত বিশাল হত যে, যা বহন করতে বড় বড় উটের প্রয়োজন হত। ।
এছাড়া তখনকার অবস্থা এমন ছিল যে, পুরো আরবের মাঝে লেখা জানত হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন মানুষ। সাথে সাথে কাগজের অপ্রতুলতা ছিল মারাত্মক। এখনকার মতো কাগজের সয়লাব ছিলো না। সাহাবায়ে কেরাম কুরআনের আয়াত পশুর হাড্ডিতে, গাছের পাতায়, পশুর চামড়ায় এবং পাথরে লিখে রাখতেন। কুরআনের সাথে সাথে তখন যদি তাদেরকে হাদীসও লিখে রাখার কথা বলা হত,তাহলে সাহাবারা এমন অভাবনীয় কস্টের সম্মুখিন হতেন, যেটাকে কাটিয়ে উঠতে তারা একেবারেই অক্ষম।
সবদিক বিবেচনা করে তখন দ্বীন সংরক্ষনের সবচেয়ে সহজ যে পদ্ধতি ছিলো এবং আরবদের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম সেটার উপর আমল করার নির্দেশ দিলেন। আর কোরআন হলো দ্বীনের সমস্ত আহকামাদি এবং আকাইদের মূল স্তম্ভ। এর প্রতিটি শব্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম যখন যে আয়াত অবতীর্ণ হত, সাহাবাদেরকে হুবহু শব্দে শব্দে মুখস্থ করিয়ে দিতেন। আর অধিক সতর্কতাবশত তিনি নিজে ওহি লেখকদের ডেকে আয়াতগুলো লিখিয়ে নিতেন।
আর হাদীস হলো কুরআনের পূণাঙ্গ ব্যাখ্যা, মৌখিক হাদীসসগুলো সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের অভ্যাস অনুযায়ী খুব ভালো করে মুখস্থ করে রাখতেন। যেমনভাবে পূর্বে তারা বিভিন্ন খুতবা, কবিতা এবং নসবনামা মুখস্থ করে রাখতেন। পরিস্কার কথা হল, সে সময় এর চেয়ে বেশি আর কি করার ছিল!
এরপর যখন কুরআনের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অবতীর্ণ হয়ে গেল, সাধারণভাবে কুরআনের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়ে গেল, কুরআনের সাথে অন্য কোন কিছু মিলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল, এদিকে বদরের যুদ্ধে পর মদিনার অনেক সাহাবি লেখা শিখে ফেললেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম ও হাদীস লেখার অনুমতি দিয়ে দিলেন।
১. রাসুলের যুগে হাদীস লেখার দলিল
পূর্বের আলোচনা থেকে আশা করি পাঠকের কাছে একটি বিষয স্প’ হয়েছে যে, আনুষ্ঠানিকভাবে কুরআনের মতো লেখা না হওয়ার কারণে হাদীস সংরক্ষণ হয়নি, এ অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ নেই। কারণ সে সময়কার আরবরা ছিলো প্রখর মেধার অধিকারী। এছাড়া কর্মের মাধ্যমেও হাদীস সাহাবায়ে কেরাম সংরক্ষণ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে হাদীস একেবারেই লেখা হয়নি, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা না হলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই হাদীস লিখেছেন। এমনকি কোনো কোনো সাহাবিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে হাদীস লিখে রাখার নির্দেশপ্রদান করেছেন। এ ধরণের কয়েকটি হাদীস দেখুন,
১. রাসুলের নির্দেশপ্রদান
كان رجل من الأنصار يجلس إلى النبي صلى الله عليه وسلم فيسمع من النبي صلى الله عليه وسلم الحديث فيعجبه ولا يحفظه فشكا ذلك إلى النبي صلى الله عليه وسلم فقال يا رسول الله إني أسمع منك الحديث فيعجبني ولا أحفظه فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم استعن بيمينك وأومأ بيده للخط
অর্থাৎ জনৈক আনসারি সাহাবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে বসা ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শুনে তিনি আশ্চর্যান্বিত হলেন, কিন্তু মুখস্থ রাখতে পারলেন না। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের নিকট অভিযোগ করলেন হে আল্লাহর রাসূল!আমি আপনার হাদীস শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি,কিন্তু মুখস্থ রাখতে পারছি না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তোমার হাত দ্বারা সাহায্য নাও। তিনি হাত দ্বারা লিখার নির্দেশ দিলেন। তিরমিজি, হাদিস নং ২৬৬৬. মুসনাদুল বাযযার, হাদিস নং ৮৯৮৯.মাজমাউয জাওয়ায়িদ, হাদিস নং৬৮২.
এ হাদিসে আমরা দেখলাম স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস লিখার নির্দেশ দিয়েছেন। সনদের দিক থেকেও বর্ণনাটি বিশুদ্ধ। কথা হলো, এখন কি একথা বলার নৈতিক সুযোগ আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে হাদীস লেখা হয়নি? প্রাচ্যবিদরা কি এমন অভিযোগ তুলে হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকার করবেন?
ক্স হযরত রাফে’ বিন খাদিজ রাঃ থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম কে বললাম:
“يا رسول الله إنا نسمع منك أشياء فنكتبها.فقال: اكتبوا لا حرج”
অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম! আমরা আপনার থেকে হাদীস শুনে লিখে রাখি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বললেন, লিখে রাখো, কোনো সমস্যা নেই। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৬৪৮. মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং ২৬৯৫৭-২৬৪২৮,
ক্স হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আ’স রা. বর্ণনা করেন,
كُنْتُ أَكْتُبُ كُلَّ شَىْءٍ أَسْمَعُهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أُرِيدُ حِفْظَهُ فَنَهَتْنِى قُرَيْشٌ وَقَالُوا أَتَكْتُبُ كُلَّ شَىْءٍ تَسْمَعُهُ وَرَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- بَشَرٌ يَتَكَلَّمُ فِى الْغَضَبِ وَالرِّضَا فَأَمْسَكْتُ عَنِ الْكِتَابِ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِرَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَأَوْمَأَ بِأُصْبُعِهِ إِلَى فِيهِ فَقَالَ ্র اكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ إِلاَّ حَقٌّ
অর্থাৎ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শুনতাম, মুখস্থ করার নিমিত্তে লিখে রাখতাম। তখন কুরাইশরা বাধা দিয়ে বলল, তুমি সব কিছু লিখে রাখ? অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ। তিনিও কখনো রাগে কখনো সন্তু’চিত্তে কথা বলেন।
একথা শুনে আমি লেখা বন্ধ করে দিলাম এবং এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করলাম। তিনি বললেন,
‘তুমি লিখতে থাকো। যার হাতে আমার প্রাণ তার শপৎ করে বলছি, আমার মুখ দিয়ে সত্য ব্যতিত অন্য কিছু বের হয় না।’ সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৬৪৮. মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং ২৬৯৫৭-২৬৪২৮,
এ হাদীসকে সামনে রেখে আপনি একটু চিন্তা করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কসম খেয়ে আবদুল্লাহ বিন আমর আস রা.কে লিখে রাখার নির্দেশপ্রদান করেছেন। তার লিখিত হাদীস নিয়ে সামনে বিস্তারিত আলোচনা আসছে।
ক্স হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আ’স থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
قيدوا العلم بالكتابة
অর্থাৎ তোমরা ইলমকে লিখে আটকে রাখো। সুনানে দারেমি, হাদিস নং ৫০৬. আল মু’জামুল কাবির, তাবারানি, হাদিস নং ৭০০.
সুস্প’ভাবে আমরা এখানে দেখতে পেলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস লিখে রাখার নির্দেশপ্রদান করেছেন।
ক্স হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)থেকে বর্ণিত:
أَنَّهُ عَامَ فَتْحِ مَكَّةَ قَتَلَتْ خُزَاعَةُ رَجُلًا مِنْ بَنِي لَيْثٍ بِقَتِيلٍ لَهُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ فَقَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنَّ اللَّهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الْفِيلَ وَسَلَّطَ عَلَيْهِمْ رَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِينَ أَلَا وَإِنَّهَا لَمْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ قَبْلِي وَلَا تَحِلُّ لِأَحَدٍ بَعْدِي أَلَا وَإِنَّمَا أُحِلَّتْ لِي سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ أَلَا وَإِنَّهَا سَاعَتِي هَذِهِ حَرَامٌ لَا يُخْتَلَى شَوْكُهَا وَلَا يُعْضَدُ شَجَرُهَا وَلَا يَلْتَقِطُ سَاقِطَتَهَا إِلَّا مُنْشِدٌ وَمَنْ قُتِلَ لَهُ قَتِيلٌ فَهُوَ بِخَيْرِ النَّظَرَيْنِ إِمَّا يُودَى وَإِمَّا يُقَادُ فَقَامَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْيَمَنِ يُقَالُ لَهُ أَبُو شَاهٍ فَقَالَ اكْتُبْ لِي يَا رَسُولَ اللَّهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اكْتُبُوا لِأَبِي شَاهٍ
অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের বছর খুজাআ গোত্রের লোকেরা বনি লাইছ গোত্রের একজন লোককে হত্য করে ফেলল। যখন এ ঘটনা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামকে অবহিত করা হল, তখন তিনি স্বীয় বাহনে আরোহন করে খুতবা দিলেন। খুতবাতে তিনি হারাম শরিফের রাসূল মর্যাদা এবং আদাবের বিশদ বর্ণণা দিলেন।সাথে সাথে দিয়ত এবং কেসাসের কথা উল্লেখ করলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম যখন খুতবা শেষ করলেন,তখন ইয়ামানের সাহাবি হযরত আবু শাহ রা. দাড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম! এ খুতবাটি আমাকে লিখে দিন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের বললেন, ‘তোমরা আবু শাহকে লিখে দাও।’সহীহ বুখারি, হাদিস নং ৬৮৮০. মুসলিম, হাদিস নং ৩৩৭১. মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৭২৪১.
এ হাদিসে আমরা দেখতে পেলাম, খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদেরকে হাদীস লেখার নির্র্দেশ দিচ্ছেন। সুতরাং পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল, হাদীস লিখতে বারণ করার হুকুমটি ছিল সাময়িক। এজন্য এটাকে পুঁজি করে হাদীসের প্রামাণিকতা অস্বীকার করার কোন যুক্তিকথা নেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন।
২. রাসূল কর্তৃক হাদীস লিখে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ
১. খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম আহকাম সম্পর্কিত হাদীস সাহাবাদের দ্বারা লিখে বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়েছেন। ইমাম ইবনে আব্দিল বার আল মালেকি রহ. বর্ণনা করেন,
“وكتب رسول الله صلى الله عليه و سلم كتاب الصدقات والديات والفرائض والسنن لعمربن حزم”
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম জাকাত, দিয়ত, মিরাছ এবং সুন্নত সম্পর্কিত একটি চিঠি লিখিয়েছিলেন হযরত আমর বিন হাজম এর নিকট প্রেরণের জন্য।
উক্ত চিঠি সম্পর্কে হাফিজ জামালুদ্দীন যায়লায়ি রহ. বলেন,
“فنسخة كتاب عمروبن حزم تلقاها اللأئمة الأربعة بالقبول وهي متوارثة كنسخة عمروبن شعيب عن أبيه عن جده”
অর্থাৎ আমর বিন হাযমের চিঠিকে মাজহাবের চার ইমাম গ্রহণ করেছেন। এ নুসখাটিও আমর বিন শুআইবের মতো ধারাবাহিক। নাসবুর রায়াহ ৩/৩২, মিশর।
মুয়ত্তা মালেকের মধ্যে উক্ত নুসখার রেওয়ায়াত আছে। হাকিম নিশাপুরী ‘আল মুসতাদরাক’ এর জাকাত অধ্যায়ে উক্ত নুসখার ৬৩টি হাদীস উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে ‘সুনানে দারা কুতনি’ এবং ‘সুনানে বায়হাকি’ এর বিভিন্ন অধ্যায়ে উক্ত নুসখার হাদীস বর্ণিত হয়ে। হয়েছে।
২. এমনিভাবে জাকতের আহকাম সম্পর্কিত একটি চিটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামানবাসীর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। উক্ত চিটির কথা ইমাম শাবি রহ. উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবু বকর ইবনে আবি শায়বা রহঃ স্বীয় ‘আল মুসান্নাফ’ এর জাকাত অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত অনেকগুলো হাদীস উল্লেখ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম তার জীবদ্দশায় আহকামাদী সম্পর্কিত চিঠি বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো সম্পর্কে জানতে হলে দেখুন উপমহাদেশের প্রথিতযশা হাদীস বিশারদ আল্লামা আব্দুর রশীদ নুমানী রহঃ লিখিত‘বমিাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস’নামক গ্রন্থের ১৩৮Ñ১৩৯ নং পৃষ্ঠা।
উদাহরণস্বরুপ কয়েকটি উপমা পেশ করলাম। আশা করি এরদ্বারা প্রাচ্যবিদদের অভিযোগের বাস্তবতা আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। হাদিস ইসলামের অকাট্য এবং প্রমাণিত দলিল। এটি নিয়ে সন্দেহ করার সামান্য কোন সুযোগ নেই।