আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র আকিদা হলো, কবরে প্রত্যেক নবীকে বিশেষ জীবন দান করা হয়েছে। সে হিসেবে তারা সকলেই কবরে জীবিত। এ ব্যাপারে ইমাম বায়হাকি রাহি. বলেন-
والأنبياء عليهم الصلاة والسلام بعدما قبضوا ردت إليهم أرواحهم، فهم أحياء عند ربهم كالشهداء
“মৃত্যুবরণের পর নবীদের রুহ পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে সিহেবে তারা তাদের প্রভ‚র কাছে জীবিত”। আল ইতিকাদ : পৃষ্ঠা নং ৪৬১।
এ ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র আকিদা বর্ণনা করতে গিয়ে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহি. বলেন-
وقد تمسك به من أنكر الحياة في القبر، وأجيب عن أهل السنة المثبتين لذلك بأن المراد نفي الموت اللازم من الذي أثبته عمر بقوله: “وليبعثه الله في الدنيا ليقطع أيدي القائلين بموته” وليس فيه تعرض لما يقع في البرزخ، وأحسن من هذا الجواب أن يقال: إن حياته صلى الله عليه وسلم في القبر لا يعقبها موت بل يستمر حيا، والأنبياء أحياء في قبورهم، ولعل هذا هو الحكمة في تعريف الموتتين حيث قال :لا يذيقك الله الموتتين أي المعروفتين المشهورتين الواقعتين لكل أحد غير الأنبياء. (فتح الباري، باب لو كنت متخذا خليلا لتخذت أبا بكر خليلا
‘যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরে জীবিত থাকাকে অস্বীকার করে, তারা আবু বকর রাযি.-এর উক্ত বক্তব্য দিয়ে দলিল পেশ করতে চায়-‘আল্লাহ আপনাকে দুইবার মৃত্যু দান করবেন না’। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র যারা বিশ্বাস করেন যে, নবী কবরে জীবিত, তারা জবাব দেন যে আবু বকর রাযি.-এর বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল উমর রাযি.-এর ভুল ধারণার খÐন করা। উমর রাযি. বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তাআলা নবীজীকে আবার দুনিয়াতে জীবিত করবেন’। এ কথার মাঝে কবরে কী হবে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অবশ্য আবু বকর রাযি.-এর কথার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হল, কবরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জীবন পেয়েছেন তারপর আর কোন মৃত্যু আসবে না। বরং তিনি বরাবরই কবরে জীবিত থাকবেন, আর নবীগণ কবরে জীবিত। ফাতহুল বারী : ৭/২৯।
নবীগণ কবরে জীবিত, এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে আমি কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।
আনাস বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
্রالْأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِي قُبُورِهِمْ يُصَلُّونَ
“নবীগণ কবরে জীবিত, তারা নামাজ আদায় করেন”। মুসনাদে আবি ইয়ালা আল মাওসিলি : হাদীস নং ৩৪২৫, মুসনাদে বাযযার : হাদীস নং ৬৮৮৮।
এ হাদীসের ব্যাপারে ইমাম হাইছামী রাহি. বলেন-
رَوَاهُ أَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ، وَرِجَالُ أَبِي يَعْلَى ثِقَاتٌ.
‘হাদীসটি ইমাম আবু ইয়ালা এবং বাযযার রাহি. বর্ণনা করেছেন। আবু ইয়ালার সনদের বর্ণনাকারী সকলেই ছিকাহ তথা বিশ্বস্ত’। মাযমাউয যাওয়ায়িদ : ১৩৮১২।
সালাফীদের বরণীয় আলেম নাসিরুদ্দিন আলবানী রাহি. বলেন-
وهذا إسناد جيد، رجاله كلهم ثقات، غير الأزرق هذا قال الحافظ في” التقريب “: ” صدوق يغرب ”
হাদীসটির সনদ উত্তম। আযরাক ছাড়া বর্ণনাকারী সকলেই ছিকাহ তথা বিশ্বস্ত। আযরাকের ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার বলেন, তিনি সত্যবাদী, তবে মাঝে মধ্যে একাকী হাদীস বর্ণনা করেন। সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহীহা : হাদীস নং ৬২১।
এছাড়া ‘সহিহুল জামিয়িস সাগীর’ গ্রন্থে তিনি স্পষ্টভাবে হাদীসকে সহীহ বলেছেন। সহিহুল জামিয়িস সাগীর : হাদীস নং ২৭৯০।
এ হাদীস থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, নবীগণ কবরে জীবিত এবং নামাজ পড়েন। এরপরও কেউ যদি বলে নবীগণ কবরে মৃত, তাহলে তার জন্য আমরা হেদায়াতের দুআ করি।
আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَرَرْتُ عَلَى مُوسَى لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي عِنْدَ الْكَثِيبِ الْأَحْمَرِ، وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي فِي قَبْرِهِ ”
‘আমি মিরাজের রাতে (বাইতুল মাকদিসের পাশে) লাল বালুর ঢিবির কাছে মূসা আ.-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছি। তখন তিনি তাঁর কবরে দাড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন’। সহীহ মুসলিম : হাদীস নং ২৩৭৫।
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসা আ.-কে স্বশরীরে নামাজ পড়তে দেখেছেন। যদি নবীরা মৃত হোন, তাহলে মুসা আ. নামাজ পড়েছেন কীভাবে?
আউস বিন আউস রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
্রإِنَّ مِنْ أَفْضَلِ أَيَّامِكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، فِيهِ خُلِقَ آدَمُ، وَفِيهِ قُبِضَ، وَفِيهِ النَّفْخَةُ، وَفِيهِ الصَّعْقَةُ، فَأَكْثِرُوا عَلَيَّ مِنَ الصَّلَاةِ فِيهِ، فَإِنَّ صَلَاتَكُمْ مَعْرُوضَةٌ عَلَيَّ قَالَ: قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَكَيْفَ تُعْرَضُ صَلَاتُنَا عَلَيْكَ وَقَدْ أَرِمْتَ – يَقُولُونَ: بَلِيتَ -؟ فَقَالَ: ্রإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ حَرَّمَ عَلَى الْأَرْضِ أَجْسَادَ الْأَنْبِيَاءِ
‘তোমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি হলো জুমআর দিন। জুমআর দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ দিনেই শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, আর এ দিনেই সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং এ দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে দুরুদ ও সালাম পেশ করো। কারণ, তোমাদের দুরুদ আমার কাছে পেশ করা হবে।
সাহাবাগণ বললেন, আমাদের দুরুদ আপনার কাছে কীভাবে পেশ করা হবে, তখন যে আপনি (মাটির সাথে মিশে) ক্ষয়প্রাপ্ত (নিঃশেষিত) হয়ে যাবেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য নবীগণের দেহ খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন’। আবু দাউদ : হাদীস নং ১০৪৭।
হাদীসটির ব্যাপারে হাকিম নিশাপুরী রাহি. বলেন-
هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ الْبُخَارِيِّ، وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ
‘হাদীসটি ইমাম বুখারি রাহি.-এর শর্তে উত্তীর্ণ, যদিও তিনি তাঁর কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেননি’।[ আল মুসতাদরাক : হাদীস নং ১০২৯।
ইমাম যাহাবী রাহি.ও হাকিম নিশাপুরীর বক্তব্য সমর্থন করেছেন।
নবী এবং রাসূলগণ যে কবরে জীবিত, কুরআন থেকেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন
وَلَا تَقُوْلُوْا لِمَنْ يُقْتَلُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلٰكِنْ لَا تَشْعُرُوْنَ
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তোমরা তাদেরকে বলো না তারা মৃত, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না”। সূরা বাকারা : আয়াত নং ১৫৪।
আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন-
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُوْنَ
“যারা আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত। তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিকপ্রাপ্ত”। সূরা আল ইমরান : আয়াত নং ১৬৯।
নবী এবং রাসূলগণ যে কবরে জীবিত, এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র সর্বকালের স্বীকৃত আকিদা। ইমাম বায়হাকির মতো বরেণ্য মুহাদ্দীস এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থও লিখেছেন। সুতরাং যারা প্রচার করে বেড়ায় যে নবীগণ কবরে মৃত, তারা বিপদগামী। তাদের ভ্রষ্টতাপূর্ণ আকিদা থেকে আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে বাঁচিয়ে রাখুন।