সম্প্রতি প্রজেক্টর নিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন প্রজেক্টরের মাধ্যমে বক্তার চেহারা দেখে মহিলারা বয়ান শুনা শতভাগ জায়েজ। আবার কেউ বলছেন, ফিতনার আশংকা থাকার কারণে এ যুগে প্রজেক্টর ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত। যারা প্রজেক্টরের পক্ষে কথা বলছেন, তারা নিজেদের মতের পক্ষে কয়েকটি হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করছেন। এর মাঝে একটি হলো, আয়েশা রা. এর হাদিস। হাদিসটি ইমাম বুখারি রাহি. সহ অধিকাংশ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, «لَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا عَلَى بَابِ حُجْرَتِي وَالحَبَشَةُ يَلْعَبُونَ فِي المَسْجِدِ، وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْتُرُنِي بِرِدَائِهِ، أَنْظُرُ إِلَى لَعِبِهِمْ» একদিন আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার ঘরের দরজায় দেখলাম। তখন হাবশার অধিবাসী সাহাবারা মসজিদে খেলা করছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে চাদর দ্বারা ঢেকে নেন। আমি তাদের খেলা দেখি। (বুখারি, হাদিস নং ৪৫৪)
এ হাদিসে সুস্পষ্টভাবে রয়েছে যে, আয়েশা রা. হাবশার অধিবাসী সাহাবাদের খেলা দেখেছেন। সুতরাং প্রজেক্টরের মাধ্যমে মহিলা পুরুষ বক্তাকে দেখতে সমস্যা কোথায়? নস পেয়েই সেটা দ্বারা দলিল দিয়ে দেওয়া আহলে জাহেরদের কাজ। এরদ্বারা ভ্রষ্টতায় নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রথমত, নসের প্রেক্ষাপট দেখতে হয়। এরপর দেখতে হয় সেটা বিশেষ কোন ঘটনার সাথে খাস কিনা? তৃতীয়ত, এ নসের বিপরিত কোন নস থাকলে দেখতে হয় যে, ফুকাহায়ে কেরাম উভয় নসের মাঝে কীভাবে সামাঞ্জস্য বিধান করেছেন। তারপর আসে চূড়ান্ত ফতোয়া। গায়রে মাহরাম তথা অপরিচিত পুরুষের দিকে না তাকানোর ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বিনা কারণে অন্ধ সাহাবির দিকে তাকাতেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।
এবার আসি আয়েশা রা. এর ঘটনায়। কারও কারও মতে ঘটনাটি পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে। মোল্লা আলি কারী হানাফি রাহি.সহ কেউ কেউ এ মত পোষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসুল আসর আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহি. এর বক্তব্য পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। তিনি বলেন, إنْ كان قبلَ الحِجَابِ فالأمرُ ظاهر، ولا بَأْسَ إِنْ كان بعده أيضًا فإنَّه جائزٌ أيضًا بشرطِ عدم الفتنة. অর্থাৎ যদি এ ঘটনা পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের হয়, তাহলে ব্যাপারটি একেবারে সুস্পষ্ট। যদি পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা হয়, তাহলে পর পুরুষের দিকে তাকানো জায়েজ আছে, তবে শর্ত হলো ফিতনার আশংকা না থাকা। (ফায়জুল বারী, ২/৭৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বায়রুত)
আমরা ধরে নিলাম ঘটনাটি পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিত ছিলেন যে, আয়েশা রা. ফিতনায় পড়বেন না। এজন্য খেলা দেখিয়েছেন। কিন্তু হাজার মহিলা বক্তাকে দেখলে ফিতনায় পতিত হবে না, সে গ্যারান্টি আপনি কীভাবে পেলেন? বক্তাদের পরোকিয়া, পি, এস এর বউ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার খরব তো মাঝে মাঝে পত্রিকায় আসে! প্রশ্ন হলো, আয়েশা রা. কে কেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেলা দেখিয়ে ছিলেন? এখানে মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। কারও মতে আয়েশা রা. হাবশি সাহবাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি। বরং তার দৃষ্টি ছিল তাদের অস্ত্রের দিকে। শাফেয়ি মাজহাবের বিখ্যাত ফকিহ জাকারিয়া বিন মুহাম্মাদ আবু ইয়াহইয়া আল মিসরি রাহি. (মৃত্যু ৯২৬ হি.) বলেন, (أنظُرُ إلى لعبهم) أي: وآلاتهم دون ذواتهم؛ إذ نظر الأجنبية إلى الأجنبيِّ حرام. অর্থাৎ তুমি তাদের অস্ত্রের দিকে তাকাও। তাদের দিকে তাকাবে না। কারণ, অপরিচিত মহিলা অপরিচিত পুরুষের দিকে তাকানো হারাম। (মিনহাতুল বারি, শরহে সাহিহিল বুখারি, ২/১৬৩)
ইমাম কাস্তাল্লানি রাহি. বুখারি শরিফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার। তিনি বলেন, أنظر إلى لعبهم) وآلاتهم لا إلى ذواتهم، إذ نظر الأجنبية إلى الأجنبي غير جائز، وهذا يدلّ على أنه كان بعد نزول الحجاب، ولعله عليه الصلاة والسلام تركها تنظر إلى لعبهم لتضبطه وتنقله لتعلمه بعد অর্থাৎ তুমি তাদের খেলা এবং অস্ত্রের দিকে তাকাও। তাদের দিকে তাকাবে না। কারণ, অপরিচিতা মহিলাদের জন্য অপরিচিত পুরুষের দিকে তাকানো জায়েজ নেই। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, এ ঘটনাটি পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর। সম্ভবত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে দিয়েছিলেন, যাতে তিনি অস্ত্র খেলা রপ্ত করতে পারেন এবং পরে শিক্ষা দিতে পারেন। (ইরশাদুস সারি, ১/৫৫১)
চাইলে আরও অনেক ইমামের বক্তব্য তুলে দেওয়া যাবে। এ ধরণের হাদিস জনসাধারণের সামনে পেশ করার অর্থ হলো, শরিয়তের একটি বিধানের ব্যাপারে মানুষের অন্তরে উদাসীনতা তৈরী করা। অপরিচিতা মহিলা তখন পর পুরুষের দিকে তাকানোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে না। ফিতনার আশংকা না থাকলে বিশেষ প্রয়োজনে শরিয়তে তাকানোর অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু প্রজেক্টরে বয়ান দেখা কোন হিসেবে বিশেষ প্রয়োজনের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়? আবার ফিতনা থেকে বেঁচে যাওয়ার নিশ্চিয়তা পেলেন কোথায়? আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন।