প্রথমে আমরা সাইদ ইবনে ইয়াযিদ রহঃ থেকে বর্ণিত হাদীসটি দেখুন। ইমাম বায়হাকী রহঃ ‘আস সুনানুল কুবরাতে’ উল্লেখ করেছেন।
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ : كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ فِى شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً – قَالَ – وَكَانُوا يَقْرَءُونَ بِالْمِئِينِ ، وَكَانُوا يَتَوَكَّئُونَ عَلَى عُصِيِّهِمْ فِى عَهْدِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ مِنْ شِدَّةِ الْقِيَامِ.
সাইব ইবনে ইয়াজিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ওমর (রাঃ)-এর যামানায় রামাযানে মাসে লোকেরা ২০ রাকাআত নামায আদায় করত।
এ হাদীস উল্লেখ করার পর মুযাফফার বিন মুহসিন বলেন: “ বর্ণনাটি জাল। এটি তিনটি দোষে দুষ্ট”।( তারাবীহর রাকাআত সংখ্যা: একটি তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ, পৃষ্টা নং, ২৮)
প্রথম কথা হল, এ হাদীসকে মুযাফফার বিন মুহসিনের পূর্বে পৃথিবীর কোন মুহাদ্দিস জাল বলেননি। এমনকি খোদ আহলে হাদীসদের মাথঅর তাজ আবদুর রহমান মুবারকপুরী এবং আলবানী মরহুমও জাল বলেননি।
দেখুন, হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসরা কি বলেন?
ইমাম নববী রহঃ বলেন-
وَعَن السَّائِب بن يزِيد الصَّحَابِيّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْه ، قَالَ : ” كَانُوا يقومُونَ عَلَى عهد عمر بن الْخطاب رَضِيَ اللَّهُ عَنْه فِي شهر رَمَضَان بِعشْرين رَكْعَة ، وَكَانُوا يقراؤون بالمئين ، وَكَانُوا يتوكؤون عَلَى عصيهم فِي عهد عُثْمَان من شدَّة الْقيام ” رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ بِإِسْنَاد صَحِيح
ইমাম নববী (৬৬৪হিঃ) হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন: ইমাম বায়হাকী হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। (. খুলাসাতুল আহকাম, ১/৫৭৬. মুআসসিসাতুর রিসালাহ)
ইমাম ইরাকী রহ. (৮০৬ হিঃ) বলেন-
وفي سنن البيهقي بإسناد صحيح عن السائب بن يزيد رضي الله عنه قال كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب رضي الله عنه في شهر رمضان بعشرين ركعة
অর্থাৎ, ইমাম বায়হাকী রহঃ সহীহ সনদে সাইব ইবনে ইয়াযিদের হাদীস বর্ণনা করেছেন। (ত্বারাহুত তাছরীব, ৩/৮৮. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
হাফেজ বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন-
رواه البيهقي بإسناد صحيح عن السائب بن يزيد الصحابي قال كانوا يقومون على عهد عمر رضي الله تعالى عنه بعشرين ركعة
অর্থাৎ, ইমাম বায়হাকী রহ. সহীহ সনদে সাইব ইবনে ইয়াযিদের হাদীস বর্ণনা করেছেন। (উমদাতুল কারী, ৮/৪৮৫. মাকতাবাতুশ শামেলা)
হাফেজ ইবনুল মুলাক্কিন রহ. বলেন-
وَرَوَى الْبَيْهَقِيّ بِإِسْنَاد صَحِيح عَن عمر ্রأَن النَّاس كَانُوا يقومُونَ عَلَى (عَهده) بِعشْرين رَكْعَة
অর্থাৎ, ইমাম বায়হাকী সহীহ সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (আল বাদরুল মুনীর, ৪/৩৫০. দারুল হিজরাহ)
ইমাম যায়লায়ী রহ. বলেন-
عَنْ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ، قَالَ: كُنَّا نَقُومُ فِي زَمَنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرِ، انْتَهَى. قَالَ النَّوَوِيُّ فِي “الْخُلَاصَةِ১”: إسْنَادُهُ صَحِيحٌ،
অর্থাৎ, তিনি ইমাম নববীর কথাকে নকল করেছেন। তিনি বলেন: হাদীসের সনদ সহীহ। (নাসবুর রায়াহ, ২/১৫৪. আল্লামা ইউসুফ বানুরী তাহকীককৃত)
এ তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে। দেখুন, কতজন মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। কোন মুহাদ্দিস এটাকে জাল বলেননি। এমন হাদীসকে মুযাফফার সাহেব একেবারে জাল বানিয়ে ফেললেন!
এরপর মুযাফফার বিন মুহসিন লিখেন: প্রথমত এর সনদে আব্দুল্লাহ ইবনে ফানজুবী আদ- দাইনুরী নামক রাবী আছে। সে মুহাদ্দিসদের নিকট অপরিচিত। রিজাল শাস্ত্রে এর কোন অস্তিত্ব নেই।
এ কয়েক লাইনে মুযাফফার বিন মুহসিন কয়েকটি অমার্জনীয় ভুল করেছেন। তিনি বলেছেন: এ হাদীসে একজন বর্ণনাকারী হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে ফানযুবী, তিনি মাজহুল। কিন্তু আমরা দেখি যে, এ হাদীসের আরো সনদ রয়েছে, যেখানে উক্ত রাবী নেই। তখনতো আর হাদীসকে জাল বলা যাবে না। কারণ উক্ত মাজহুল রাবী নেই। ইমাম ইবনুল জা’দ রহ. স্বীয় “মুসনাদ” এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। সে বর্ণনায় উক্ত রাবী নেই।
حدثنا علي أنا بن أبي ذئب عن يزيد بن خصيفة عن السائب بن يزيد قال كانوا يقومون على عهد عمر في شهر رمضان بعشرين ركعة وإن كانوا ليقرءون بالمئين من القرآن
অর্থাৎ, ইবনুল জা’দ বর্ণনা করেন আলী থেকে, তিনি ইবনু আবি যি’ব থেকে, তিনি ইয়াযিদ বিন খুসাইফা থেকে, তিনি সাইব ইবনে ইয়াযিদ থেকে বর্ণনা করেন। (মুসনাদু ইবনুল জা’দ, হাদীস নং, ২৮২৫. মুআসসিসা নাদের, বায়রুত)
এমনিভাবে ইমাম বায়হাকী রহ. “মা’রিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার” এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। সে সনদেও আব্দুল্লাহ ইবনে ফানজুবি নেই।
أخبرنا أبو طاهر الفقيه قال : أخبرنا أبو عثمان البصري قال : حدثنا أبو أحمد محمد بن عبد الوهاب قال : أخبرنا خالد بن مخلد قال : حدثنا محمد بن جعفر قال : حدثني يزيد بن خصيفة ، عن السائب بن يزيد قال : ্র كنا نقوم في زمان عمر بن الخطاب بعشرين ركعة والوتر وأخبرنا أبو زكريا قال : أخبرنا أبو الحسن الطرائفي قال : حدثنا عثمان بن سعيد قال : حدثنا يحيى بن بكير قال : حدثنا مالك قال : وحدثنا القعنبي فيما قرأ على مالك ، عن يزيد بن رومان ، أنه قال : ্র كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان بثلاث وعشرين ركعة
অর্থাৎ, খালেদ বর্ণনা করেন মুহাম্মাদ জাফর থেকে, তিনি ইয়াযিদ বিন খুসাইফা থেকে, তিনি সাইব ইবনে ইয়াযিদ থেকে বর্ণনা করেন। (মা’রেফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, ১১৪৩. মাকতাবাতুশ শামেলা)
মুযাফফার বিন মুহসিন কি নির্লজ্জভাবে এ সমস্ত সনদ একেবারে চেপে গেলেন! এ হাদীসের যে আরো অনেকগুলো সনদ রয়েছে, সেগুলোর কথা তিনি একটিবারও উল্লেখ করেননি! একটি সনদে একজন রাবীর কারণে পুরো হাদীসকে একেবারে জাল বানিয়ে ফেললেন!
দ্বিতীয়ত: তিনি বলেছেন: আব্দুল্লাহ ইবনে ফানযুবী অপরিচিত, রিজাল শাস্ত্রে এর কেন অস্তিত্ব নেই। এটি মুযাফফার বিন মুহসিনের চরম মূর্খতার প্রমাণ। কারণ আব্দুল্লাহ হলেন হাফিজুল হাদীস। প্রসিদ্ধ ইমাম। দেখুন ইমাম রিজাল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম শামছুদ্দীন যাহাবী রহঃ তার সম্পর্কে কি বলেন:
والمحدث أبو عبد الله الحسين بن محمد الحسين بن عبد الله فنجوية الثقفي الدينوري الحافظ بنيسابور.
অর্থাৎ, আবু আব্দুল্লাহ ইবনে ফানজুয়াহ, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, তিনি ছিলেন হাফিজুল হাদীস।( তারিখুল ইসলাম, ৩/২৪৪)
ইবনুল আছির যাজারী তার সম্পর্কে লিখেন-
عرف بها أبو عبد الله الحسين محمد بن الحسين بن فنجوية الفنجوبي الدينوري الحافظ. روى عن أبي الفتح محمد بن الحسين الأزدي الموصلي أبي بكر بن مالك القطعي وغيرهما . روى عنه أبو إسحاق الثعلبي فأكثر في تفسيره. ويذكره كثيرا فيقول أخبرنا الفنجوبي.
অর্থাৎ, ফানজুবী নিসবতে প্রসিদ্ধ হলেন, আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হুসাইন ফানজুয়াহ আল ফানজুবী। যিনি হাফেযুল হাদীস ছিলেন। আবুল ফাত্হ আল আযদী আল মাওসীলি এবং আবু বকর ইবনে মালিক আল ক্বাতিয়ীসহ অন্যান্যদের থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তার থেকে আবু ইসহাক আস ছা’লাবী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে অনেক রেওয়ায়াত এনেছেন।( তারবীর নামায, হাবীবুর রহমান আযমী, পৃষ্টা নং, ৫৬. দারুল উলুম লাইব্রেরী, ঢাকা)
এ রকম একজন হাফিজুল হাদীস সম্পর্কে মুযাফফার বিন মুহসিন বললেন: আব্দুল্লাহ ইবনে ফানযুবী অপরিচিত, রিজাল শাস্ত্রে এর কেন অস্তিত্ব নেই। তার জ্ঞানের দৈন্যতা এ সকল ক্ষেত্রে এসে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কি পরিমাণ স্পর্ধা তার! একজন হাফিজুল হাদীসের ব্যাপারে বলছেন: রিজাল শাস্ত্রে তার কোন অস্তিত্ব নেই! হয়ত তিনি মূর্খ, অথবা জ্ঞান পাপী। আল্লাহ তাদের থেকে আমাদের হেফাজত করুন।
এ ইবারতে মুযাফফার বিন মুহসিন সাহেব লিখেছেন আদ- দায়নুরী। সেটা মারাত্বক ভুল। কেননা শুদ্ধ হল আদ দিইনাওয়ারী। দিইনাওয়ার নামক প্রসিদ্ধ শহরের দিকে নিসবত করে। ইয়াকুত আল হামাবী তদ্বীয় “ মু’যামুল বুলদান”এ দিইনাওয়ারেরর অনেক মুহাদ্দিসের কথা উল্লেখ করেছেন। দিনাওয়ারকে দাইনুর বলার দ্বারা আরবী ভাষায় তার কি বেহাল দশা, তা উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছে! পাঠক, আপনি বলুন, যে শায়খ মাত্র দেড় লাইনে এতগুলো ভুল, যেগুলো তার মূর্খতার উপর দলীল, তারাই আজকে সমাজে সহীহ হাদীসের ধোয়া তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে! আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ পথে পরিচালিত করুন। আমীন।
মুযাফফার বিন মুহসিন সাহেব বলেছিলেন, হাদীসটি তিনটি দোষে দুষ্ট। প্রথম দোষ এবং সেখানে তার নির্লজ্জ জালিয়াতি এবং মিথ্যাচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
২য় দোষ সম্পর্কে মুযাফফার বিন মুহসিন বলেন-
উক্ত বর্ণনায় ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফা নামে একজন মুনকার রাবী আছে। সে সহীহ হাদীসের বিরোধি হাদীস বর্ণনাকারী। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এজন্য তাকে মুনকার বলেছেন এবং আল্লামা যাহাবী ও ইবনু হাজার আসকালানী তা সমর্থন করেছেন।
এ কয়েক লাইনে মুযাফফার সাহেরব মূর্খতা এবং জালিয়াতির চূড়ান্ত পরাকাষ্টা প্রদর্শন করেছেন! যা একেবারে শিউরিয়ে উঠার মত।
প্রথম কথা হল, ইয়াযীদ বিন খুসাইফা বুখারী, মুসলিমের বর্ণনাকারী। ইমাম বুখারী এবং মুসলিম রহ. তাদের ‘সহীহ বুখারী’ এবং ‘সহীহ মুসলিমে’ তার সূত্রে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন। উদাহরণ স্বরুপ শায়খ যুহায়র নাসির তাহকীককৃত বুখারীর ৪৭০, ১০৭২, ২৩২৩, ২৩২৫ নং হাদীস দেখা যেতে পারে। ইমাম বুখারী রহ. ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফার সূত্রে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন। এমনিভাবে শায়খ ফুয়াদ আব্দুল বাকী তাহকীককৃত ‘মুসলিম শরীফ’ এর ৫৭৭, ১৫৭৬, ২১৫৩, ২৫৭২ নং হাদীস দেখা যেতে পারে। ইমাম মুসলিম রহঃ ও ইয়াযিদ বিন খুসাইফার সূত্রে হাদীস উল্লেখ করেছেন। মুযাফফার বিন মুহসিনের কথা অনুযায়ী তিনি সহীহ হাদীসের বিরোধি হাদীস বর্ণনাকারী হয়ে থাকেন, তাহলে ইমাম বুখারী এবং মুসলিম কেন তার সূত্রে হাদীস আনলেন? তাহলে কি বুখারী এবং মুসলিমে ইয়াযিদ ইবনে খুসাইফার সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো জাল!
এবার দেখুন ইয়াযিদ ইবনে খুসাইফা সম্পর্কে জরাহ, তাদীলের ইমামগণ কি বলেন?
يزيد بن عبد الله بن خصيفة بن عبد الله بن يزيد الكندي المدني روى عن أبيه والسائب بن يزيد ويزيد بن عبد الله بن قسيط ومحمد بن عبد الرحمن بن ثوبان وعمرو بن عبد الله بن كعب وبسر بن سعيد وعبد الله بن عبد القاري وغيرهم وعنه الجعيد بن عبد الرحمن ومالك وأبو علقمة الفروي وسليمان بن بلال وإسماعيل بن جعفر والسفيانان والداروردي وآخرون قال الأثرم عن أحمد وابو حاتم والنسائي ثقة وقال الآجري عن أبي داود قال أحمد منكر الحديث وقال بن أبي مريم عن بن معين ثقة حجة وقال بن سعد كان عابدا ناسكا كثير الحديث ثبتا وذكره بن حبان في الثقات
অর্থাৎ, আছরাম রহঃ ইমাম আহমদ, আবু হাতিম এবং নাসায়ী থেকে বর্ণনা করেন, তারা সকলে তাকে ছিকাহ বলেছেন।
আজুরী আবু দাউদ থেকে, তিনি বলেন: ইমাম আহমদ তাকে মুনকারুল হাদীস বলেছেন।
ইবনে মায়ীন তাকে ছিকাহ, হুজ্জত তথা হাদীসের ক্ষেত্রে দলীল বলেছেন। ইবনে সা’দ বলেন: তিনি ইবাদগুজার, বেশি হজ পালনকারী, বেশি হাদীস বর্ণনাকারী, বিশস্ত এবং গ্রহণযোগ্য।
ইবনে হিব্বান ছিক্বাহ বর্ণনাকারীদের জীবনী গ্রন্থ “কিতাবুছ ছিক্বাত” এ তার জীবনী উল্লেখ করেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব, ৯/ ৩৫৫-৩৫৬. দারুল ফিকর, বায়রুত)
আমরা দেখতে পেলাম, ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফাকে ইবনে মায়ীন, আবু হাতিম, নাসায়ী এবং ইবনে হিব্বান রহঃ ‘ছিকাহ’ বলেছেন। ইমাম আহমদ থেকে রেওয়ায়াত মুখতালিফ। আছরাম বলেন: ইমাম আহমদ তাকে ছিকাহ বলেছেন। আবু দাউদ বলেন: আহমদ তাকে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন।মুযাফফার বিন মুহসিন সবগুলোকে বাদ দিয়ে শুধু একটি রেওয়ায়াত গ্রহণ করে হাদীসকে জাল বানিয়ে ফেললেন! এ কেমন জালিয়াতি! এছাড়া ইমাম আহমদের কথা নকল করতে গিয়ে তিনি চরম অপরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ ইমাম আহমদ ‘মুনকার’ বলেননি। ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন। কারণ মুনকার হাদীসের বিশেষণ হয়ে থাকে। বর্ণনাকারীকে কখনো মুনকার বলা হয় না!
হাফেজ ইবনে হাজার “তাকরীবুত তাহযীবে” বলেন:
يزيد بن عبد الله بن خصيفة بمعجمة ثم الركعة بن عبد الله بن يزيد الكندي المدني وقد ينسب لجده ثقة من الخامسة
অর্থাৎ, ইয়াযিদ বিন খুসাইফা হলেন ছিকাহ বর্ণনাকারী। (তাহযীবুত তাহযীব, তরজমা নং, ৭৭৩৮. শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দাঃবাঃ তাহকীককৃত)
এমন বর্ণনাকারীর রেওয়ায়াতকে মুযাফফার বিন মুহসিন কিভাবে জাল বললেন?
এরপর মুযাফফার লিখেন: আল্লামা যাহাবী এবং ইবনে হাজার আসকালানী তা সমর্থন করেছেন।
এখানেও মুযাফফার বিন মুহসিন নির্লজ্জ উলঙ্গ জালিয়াতি এবং দাগাবাজি করেছেন। প্রথমে আমরা ইমাম যাহাবীর পুরো বক্তব্য দেখি। তিনি বলেন:
يزيد بن عبدالله بن خصيفة . وقد ينسب إلى جده فيقال : يزيد بن خصيفة . عن السائب بن يزيد ، وعروة ، ويزيد بن عبدالله بن قسيط . وعنه مالك ، وطائفة . وثقه أحمد من رواية الاثرم عنه ، وأبو حاتم ، وابن معين ، والنسائي . وروى أبو داود أن أحمد قال : منكر الحديث
অর্থাৎ, ইমাম যাহাবী বলেন: আছরামের বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমদ তাকে ‘ছিকাহ’ বলেছেন।এমনিভাবে আবু হাতিম, ইবনে মায়ীন এবং নাসায়ী তাকে ছিকাহ বলেছেন। আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন: ইমাম আহমদ তাকে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন। (মিযানুল ই’তেদাল, তরজমা নং, ৯৭১৫)
আপনি বলুন, ইমাম যাহাবী কোথায় সমর্থন করলেন? যদি নকল করার দ্বারা সমর্থন হয়ে যায়, তাহলে ইমাম যাহাবী আবু হাতিম, ইবনে মায়ীন এবং নাসায়ীর বক্তব্যকেও সমর্থন করেছেন! মুযাফফার বিন মুহসিন কেন পুরো বক্তব্য বাদ দিয়ে শুধু শেষেরটা গ্রহণ করলেন! এমন খেয়ানত করতে তার কলম কি আল্লাহর ভয়ে কেঁপে উঠেনি?
এবার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানীর পুরো বক্তব্য পূর্বে গত হয়েছে। এখানে তার আরেকটি কিতাব “লিসানুল মিজান” এর বক্তব্য তুলে ধরছি।
يزيد بن عبد الله بن خصيفة بن عبد الله بن يزيد الكندي المدني عن السائب بن يزيد وعروة بن الزبير وعنه بن جريج وسليمان بن بلال وإسماعيل بن جعفر وطائفة وثقه أبو حاتم والنسائي وابن معين وأحمد
অর্থাৎ, আবু হাতিম, নাসায়ী, ইবনে মায়ীন এবং ইমাম আহমদ তাকে ‘ছিক্বাহ’ বলেছেন। (মিযানুল ই’তেদাল, তরজমা নং, ৯৭১৫)
এখানে ইবনে হাজার আবু দাউদের বর্ণনা করেননি। এছাড়া “তাকরীবে” তিনি একবাক্যে তাকে ‘ছিকাহ’ বলেছেন। কিন্তু মুযাফফার বিন মুহসিন বললেন: হাফেজ ইবনে হাজার ইমাম আহমদের বক্তব্য ‘মুনকারুল হাদীস’কে সমর্থন করেছেন! এমন নির্লজ্জ মিথ্যুকের কলমের বদ আছার থেকে আল্লাহ সাধারণ মুসলমানকে রক্ষা করুন।
এখন প্রশ্ন হল: আবু দাউদের বর্ণনা অনুযায়ী হাফেজ ইবনে হাজার তাকে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলার কি কারণ? সে প্রশ্নের উত্তর হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ “ফাতহুল বারী”র ভূমিকা “হাদয়ূছ ছারী”তে দিয়েছেন। তিনি বলেন:
يزيد بن عبد الله بن خصيفة الكندي وقد ينسب إلى جده قال بن معين ثقة حجة ووثقه أحمد في رواية الأثرم وكذا أبو حاتم والنسائي وبن سعد وروى أبو عبيد الآجري عن أبي داود عن أحمد أنه قال منكر الحديث قلت هذه اللفظة يطلقها أحمد على من يغرب على أقرانه بالحديث عرف ذلك بالاستقراء من حاله وقد احتج بابن خصيفة مالك والأئمة كلهم
অর্থাৎ, ইবনে মায়ীন তাকে ‘ছিকাহ এবং হুজ্জাত’ বলেছেন। আছরামের রেওয়ায়াত অনুযায়ী ইমাম আহমদ তাকে ‘ছিকাহ’ বলেছেন। এমনিভাবে আবু হাতিম নাসায়ী ইবনে সাদ তাকে ‘ছিকাহ’ বলেছেন। আবু দাউদের বর্ণনায় ইমাম আহমদ তাকে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন।
হাফেজ ইবনে হাজার বলেন: ‘মুনকারুল হাদীস’ শব্দটি ইমাম আহমদ সে সমস্ত বর্ণনাকারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, যারা তাদের সাথীদের তুলনায় একটু আশ্চর্যজনক হাদীস বর্ণনা করেন। এটা তার অবস্থা পর্যালোচনা দ্বারা বুঝা গেছে। ইবনে খুসাইফার বর্ণনা ইমাম মালেক সহ সকল ইমাম রেওয়ায়াত করেছেন। (ফাতহুল বারী, মুকাদ্দিমা, পৃষ্ঠা নং, ৪৫৩. দারূল মা’রেফা, বায়রুত)
দেখুন, এমন একজন ছিকাহ এবং সবার নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মুযাফফার বিন মুহসিন হাদীস জালকারী বানিয়ে ফেললেন? তাও আবার বিভিন্ন ইমামদের নামে দিন দুপুরে প্রকাশ্যে রাখ ডাক ছাড়া মিথ্যাচার করে! মনে হচ্ছে যে, দুনিয়াতে ওনি একাই গবেষক হয়েছেন! তার এগুলো কেউ বুঝতে এবং ধরতে পারবেনা! আসল চোর দুনিয়ার সবাইকে চুর মনে করে! এজন্য চুরি করে! আবার সিনাজুরি করে! আল্লাহ এমন জালিয়াতিকারীকে তুমি উত্তম বদলা দান কর।
মুযাফফার বিন মুহসিন ৩য় কারণ লিখেন: এটি কখনো ‘মুযতারাব’ পর্যায়ের। এই বর্ণনায় বিশ রাকাতের বর্ণনা এসেছে। কিন্তু অন্য বর্ণনায় আবার ২১ রাকাআতের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাই শায়খ আলবানী বলেন, এটি মুযতারাব পর্যায়ের হাদীস হওয়ায় পরিত্যাজ্য।
এখানে তিনি কয়েকটি ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন: এটি ‘মুযতারাব পর্যায়ের। অথচ হাদীস কখনো ‘মুযতারাব’ হয়না। ‘মুযতারিব’ হয়। এটা তার শাস্ত্র সম্পর্কে অপরিপক্কতার প্রমাণ। তার পরের ইবারত দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি ইযতেরাব কাকে বলে? সেটাও জানেননা। আসুন আমরা দেখে নেই যে, উসূলে হাদীসের ইমামগণ ইযতেরাবের সংজ্ঞায় কি বলেন? ইমাম ইবনুস সালাহ রহঃ বলেন:
المضطرب من الحديث : هو الذي تختلف الرواية فيه فيرويه بعضهم على وجه وبعضهم على وجه آخر مخالف له
অর্থাৎ, মুযতারিব বলা হয়, যে হাদীসের রেওয়য়াতে মতপার্থক্য হয়। কেউ কেউ একভাবে রেওয়ায়াত করেছেন। অন্য কেউ আরেকভাবে তাদের বিপরিত রেওয়ায়াত করেছেন। (মুকাদ্দিমাতু ইবনুস সালাহ, পৃষ্ঠা নং, ৫৫. মাকতাবাতুল ফারাবী)
হাফেজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর রহ. বলেন:
وهو أن يختلف الرواة فيه على شيخ بعينه، أو من وجوه أُخر متعادلة لا يترحح بعضها على بعض. وقد يكون تارة في الإسناد، وقد يكون في المتن
অর্থাৎ, কোন শাযখ থেকে কোন হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে রাবীদের মধ্যে ইখতেলাফ হওয়া। অথবা হাদীসটি অপর কোন সনদে বর্ণিত হওয়া যে, একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়া যায়না। (ইখতেসারু উলূমিল হাদীস, ৯. মাকাতাবাতুশ শামেলা)
আমরা জানলাম যে, একই হাদীস যদি ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয় এবং বিষয় বস্তু পরস্পর বিরোধি হয় যে, একটিকে আরেকটির উপর প্রাধান্য দেওয়া যায় না। সেটাকে মুহাদ্দিসগণের নিকট ‘ইযতেরাব’ বলা হয়। কিন্তু ভিন্ন আরেকটিকে হাদীসে যদি এ হাদীসের বিরোধি বক্তব্য পাওয়া যায়, সেটাকে ‘ইযতেরাব’ বলা হয় না। কিন্তু মুযাফফার সাহেব এমন কাচা কাজ করেছেন এখানে। ভিন্ন আরেকটি হাদীস দেখিয়ে তিনি সাইব ইবনে ইয়াজিদের হাদীসে ইযতেরাব প্রমাণ করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছেন!
তিনটি কারণ দেখিয়ে মুযাফফার বিন মুহসিন হাদীসটিকে জাল বলেছেন। সে তিনটি কারণের উপর মোটামোটিভাবে পর্যালোচনা করা হল!
মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠায় তিনি কি পরিমাণ জালিয়াতি এবং দাগাবাজি করেছেন, আশা করি পাঠকরা সেটি দেখতে পেরেছেন! কিভাবে তিনি একটি সহীহ হাদীসকে মিথ্যার চূড়ান্ত পরাকাষ্টা প্রদর্শন করে জাল প্রমাণিত করেছেন। আমরা আসা করি, শায়খের কাছে এ পর্যালোচনা গুলো পৌছেছে। তিনি তার এমন মারাত্বক এবং হাস্যকর ভুল থেকে প্রত্যাবর্তন করবেন। এমন গবেষক এবং শায়খদের থেকে আল্লাহ আমাদের নিরাপদ দুরত্বে রাখেন, যারা সহীহ হাদীসকে নিজেদের মতের বিপক্ষে হওয়ায় একেবারে জাল বানিয়ে ফেলে!