রাফয়ে ঈদাইন, ইবনে মাসউদ রাযি. এর হাদীস পর্যালোচনা (১)

তাকবিরে তাহরিমা ছাড়া অন্য সময় রাফয়ে ঈদাইন না করা সংক্রান্ত ইবনে মাসউদ রাযি. এর হাদীস পর্যালোচনা (পর্ব ১)
রেজাউল কারীম আবরার

আমরা নামাজে শুধু তাকবিরে তাহরিমার সময় তুলি। অন্য কোন সময় তুলি না। এ সংক্রান্ত বিখ্যাত বর্ণনা হলো আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. এর বর্ণনা। আজ আমরা সে হাদীস নিয়ে পর্যালোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. বর্ণনা করেন:
أَلَا أُصَلِّي بِكُمْ صَلَاةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلَّا فِي أَوَّلِ مَرَّةٍ
অর্থাৎ আমি কী তোমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামাজ পড়ে দেখাব? এরপর তিনি নামাজ পড়লেন এবং শুধুমাত্র তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত তুললেন। আর তুলেন নি। তিরমিযি: ২৫৭

এ হাদীস নিয়ে শাস্ত্রীয় আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা সনদ দিয়ে পর্যালোচনা করব। এ হাদীসের সনদ হলো:
حدثنا هناد حدثنا وكيع عن سفيان عن عاصم بن كليب عن عبد الرحمن بن الأسود عن علقمة قال قال عبد الله [ بن مسعود ] অর্থাৎ এ হাদীস ইমাম তিরমিযি রাহি. বর্ণনা করেছেন হান্নাদ থেকে, তিনি ওয়াকী’ বিন জাররাহ থেকে, তিনি সুফিয়ান সাওরি থেকে, তিনি আসিম বিন কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান বিন আসওয়াদ থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন।

এ হাদীস বর্ণনা করার ইমাম তিরমিযি রাহি. বলেন:
وفي الباب عن البراء بن عازب
قال أبو عيسى حديث ابن مسعود حديث حسن وبه يقول غير واحد من أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم والتابعين وهو قول سفيان الثوري وأهل الكوقة
অর্থাৎ এ সংক্রান্ত বারা বিন আযিব রাযি. থেকেও হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
তিরমিযি রাহি. বলেন, ইবনে মাসউদ রাযি. এর বর্ণিত হাদীস হলো হাসান। সাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে একদল বিদ্বান সাহাবায়ে কেরাম এবং একদল বিদ্বান তাবেয়ী এমনটি মত পোষণ করেছেন। আর এটিই হলো সুফিয়ান ছাওরী রাহি. এর কুফাবাসীর মত।

শায়খ আহমদ শাকির রাহি. তিরমিযি শরীফের টীকায় এ হাদীস সম্পর্কে বলেন:
وهذا الحديث صححه ابن حزم وغيره من الحفاظ وهو حديث صحيح وما قالوه في تعليله ليس بعلة
অর্থাৎ এ হাদীসকে ইবনে হাযম সহ অন্যান্য হাফিজুল হাদীস সহিহ বলেছেন। এটি সহীহ হাদীস। এ হাদীসের ব্যাপারে যে আপত্তি করা হয়, একটিও সঠিক আপত্তি নয়। তিরমিযি: ২৫৭, শায়খ আহমদ শাকের রাহি. টীকায় এ কথা লিখেছেন।

ইমাম ইবনে হাযম রাহি. এর হাদীসের ব্যাপারে বলেন:
إنَّ هَذَا الْخَبَرَ صَحِيحٌ، وَلَيْسَ فِيهِ إلا أَنَّ رَفْعَ الْيَدَيْنِ فِيمَا عَدَا تَكْبِيرَةِ الإِحْرَامِ لَيْسَ فَرْضًا فَقَطْ، وَلَوْلا هَذَا الْخَبَرُ لَكَانَ رَفْعُ الْيَدَيْنِ – عِنْدَ كُلِّ رَفْعٍ وَخَفْضٍ وَتَكْبِيرٍ وَتَحْمِيدٍ فِي الصَّلاةِ -: فَرْضًا؛
অর্থাৎ এ হাদীসটি সহীহ। এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যায় তাকবিরে তাহরিমা ছাড়া আর কোন জায়গায় রফয়ে ঈদাইন ফরজ নয়। যদি ইবনে মাসউদ রাযি. এর এ হাদীস না থাকতো, তাহলে নামাজের প্রত্যেক উঠাবসা, তাকবির এবং তাহমিদের সময় রফয়ে ঈদাইন ফরয হয়ে যেতো। . আল মুহাল্লা: ৪/৮৮, ইবনে হাযম আয যাহিরি।

হাফিজ ইবনুত তুরকুমানি রাহি. এ হাদীসের ব্যাপারে বলেন:
إن رجال هذا الحديث على شرط مسلم
অর্থাৎ এ হাদীসের বর্ণনাকারী ইমাম মুসলিম রাহি. এর শর্তে উত্তীর্ণ। আল জাওহারুন নাকী ফির রাদ্দি আলাল বায়হাকী: ২/৭৮।

এ হাদীসের বর্ণনাকারী সকলেই ছিক্বাহ এবং বিশ্বস্ত। আসেম বিন কুলাইব ছাড়া সকলেই বুখারী এবং মুসলিমের বর্ণনাকারী। আসেম বিন কুলাইব শুধুমাত্র মুসলিম শরীফের বর্ণনাকারী। তার ব্যাপারে ইমাম মিযযি রাহি. এর পর্যালোচনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
قال أبو بكر الأثرم ، عن أحمد بن حنبل : لا بأس بحديثه.
وَقَال أحمد بن سعد بن أَبي مريم ، عن يحيى بن مَعِين : ثقة.
وكذلك قال النَّسَائي.
وَقَال أبو حاتم : صالح.
وَقَال أبو عُبَيد الآجري : قلتُ لأبي داود : عاصم بن كليب ، ابن من ؟ قال : ابن شهاب الجرمي ، كان من العباد ، وذكر من فضله ، قلت : كان مرجئا ؟ قال : لا أدري.
وَقَال في موضع آخر : كان أفضل أهل الكوفة
وذكره ابنُ حِبَّان في كتاب “الثقات”
তার ব্যাপারে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেন: ‘তার হাদীস বর্ণনায় কোন সমস্যা নাই।
ইমাম ইবনে মায়ীন বলেন, তিনি ছিক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী।
ইমাম নাসাঈও তাকে ছিক্বাহ বলেছেন।
ইমাম আবু হাতিম বলেন, তিনি যোগ্য বর্ণনাকারী।
ইমাম আজুরী রাহি. বলেন, আমি ইমাম আবু দাউদ রাহি. কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আসিম বিন কুলাইক কে? তিনি বললেন, তিনি হলেন ইবনে শিহাব আল জারমি। তিনি অধিক ইবাদাতকারী ছিলেন। এরপর তার আরও অনেক ফজিলত বর্ণনা করেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে, তিনি কী আকিদাগত দিক থেকে মুরজিয়া? তিনি বললেন, আমি জানি না।
অপর জায়গায় তিনি বলেন, কুফাবাসীদের মাঝে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ।
ইমাম ইবনে হিব্বান তাকে “কিতাবুছ ছিক্বাত” এ উল্লেখ করেছেন।. তাহযিবুল কামাল: ৯/৩২৬, জীবনী নং ৩০০৮।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহি. আরও কিছু বক্তব্য যোগ করেছেন।
وقال بن شاهين في الثقات قال أحمد بن صالح المصري يعد من وجوه الكوفيين الثقات وفي موضع آخر هو ثقة مأمون وقال بن المديني لا يحتج به إذا انفرد وقال بن سعد كان ثقة يحتج به وليس بكثير الحديث
অর্থাৎ ইবনে শাহীন তার “কিতাবুছ ছিক্বাত” এ বলেন, আহমদ বিন সালিহ আল মিসরি তাকের কুফা শহরের বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য করেছেন।
অন্য জায়গায় বলেন, তিনি বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী।
ইমাম ইবনুল মাদীনী বলেন, তিনি একাকী বর্ণনা করলে তার বর্ণনা দ্বারা দলিল দেওয়া যাবে না।
ইমাম ইবনে সাদ বলেন, তিনি তিনি বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী। তার বর্ণনা দ্বারা দলিল পেশ করা যাবে। তবে তিনি অধিক হাদীস বর্ণনাকারী নয়। তাহযিবুত তাহযিব: ৫/৪৯।

আসিম বিন কুলাইব ছাড়া বাকি সকলেই বুখারী এবং মুসলিম এর বর্ণনাকারী। আসিম বিন কুলাইব নিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করলাম। এর দ্বারা আশা করি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এ হাদীসের বর্ণনাকারী সকলেই ছিক্বাহ। সুতরাং শাস্ত্রীয় মানদÐে এ হাদীসও সহিহ।

এ হাদীসের উপর আপত্তি এবং নিরসন

কেউ কেউ ইবনে মাসউদ রাযি. এর হাদীসের উপর ইমাম তিরমিযি রাহি. বর্ণিত ইবনে মুবারক রাহি. এর বক্তব্য দ্বারা দলিল পেশ করেন। তিনি বলেন:
وقال عبد الله بن المبارك قد ثبت حديث من يرفع يديه وذكر حديث الزهري عن سالم عن أبيه ولم يثبت حديث ابن مسعود أن النبي صلى الله عليه و سلم لم يرفع [ يديه ] إلا في أول مرة
অর্থাৎ রফয়ে ঈদাইন এর হাদীস প্রমাণিত। এরপর জুহরি এর সূত্রে বর্ণিত ইবনে উমর রাযি. এর বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনে মাসউদ রাযি. এর হাদীস প্রমাণি নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধুমাত্র তাকবিরে তাহরিমার সময় রফয়ে ঈদাইন করেন। তিরমিযি: ২৫৬ নং হাদীস সংশ্লিষ্ট আলোচনা।

অনেকে ইবনে মুবারক রাহি. এর এ বক্তব্যকে আমাদের পূর্বোক্ত হাদীসের ব্যাপারে চালিয়ে দেন। আর এটা সুস্পষ্ট কথা যে, এ বক্তব্য যদি আমাদের এ হাদীস সংশ্লিষ্ট হতো, তাহলে ইমাম তিরমিযি রাহি. এ হাদীসের শেষে উল্লেখ করতেন। তিনি অন্য হাদীসের সাথে আলোচনা করার কারণ কী? কারণ হলো, ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে দুটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। একটি হলো, মারফু’ এবং অপরটি হলো মাওকুফ। মাওকুফ হাদীসটি হাসান। যেটা আমরা পূর্বে দেখিয়েছি। আর মারফু’ হাদীস হলো, যা তাহাবী রাহি. বর্ণনা করেছেন। সেটার ব্যাপারে ইবনে মুবারক রাহি. আপত্তি করেছেন। আসুন, সে বর্ণনা দেখে আসি।
حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي دَاوُد ، قَالَ : ثنا نُعَيْمُ بْنُ حَمَّادٍ ، قَالَ : ثنا وَكِيعٌ ، عَنْ سُفْيَانَ ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْأَسْوَدِ ، عَنْ عَلْقَمَةَ ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ، عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ { أَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِي أَوَّلِ تَكْبِيرَةٍ ، ثُمَّ لَا يَعُودُ
ইমাম তাহাবি বর্ণনা করেছেন ইবনে আবি দাউদ থেকে, তিনি নুয়াইম বিন হাম্মাদ থেকে, তিনি ওয়াকী থেকে, তিনি সুফিয়ান থেকে, তিনি আসিম বিন কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান বিন আসওয়াদ থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি শুধু তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত তুলতেন। আর তুলতেন না। শারহু মাআনিল আছার: ১/৩৮৪।
ইমাম তিরমিযি রাহি. মূলত ইবনে উমর রাযি. এর মারফু’ হাদীস উল্লেখ করে সা হাদীসের বিপরিত ইবনে মাসউদ রাযি. এর মারফু’ হাদীসের ব্যাপারে ইবনে মুবারক রাহি. এর মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এক হাদীসের বক্তব্য নিয়ে আরেক হাদীসে লাগানো যাবে না।

তিনি এবনে মাসউদ রাযি. এর এ হাদীস নিয়ে আপত্তি করতে যাবেন কেন? কারণ, তিনি নিজেই এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম নাসাঈ রাহি. এর বর্ণিত এ হাদীসের সনদ হলো:
أخبرنا سويد بن نصر قال أنا عبد الله عن سفيان عن عاصم بن كليب عن عبد الرحمن بن الأسود عن علقمة عن عبد الله قال ألا أخبركم بصلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم قال فقام فرفع يديه أول مرة ثم لم يرفع
অর্থাৎ ইমাম নাসাঈ রাহি. এ হাদীস বর্ণনা করেছেন সুওয়াইদ বিন নাসর থেকে, তিনি আবুদল্লাহ বিন মুবারক থেকে, তিনি সুফিয়ান থেকে, তিনি আসিম বিন কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান বিন আসওয়াদ থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন।. আস সুনানুল কুবরা: ১০৯৯, নাসাঈ।

আমরা দেখতে পেলাম ইবনে মুবারক রাহি. নিজেই এ হাদীসকে বর্ণনা করেছেন। এজন্যই তার বক্তব্য ইমাম তিরমিযি রাহি. এ হাদীসের সাথে উল্লেখ করেন নি। তার এ বক্তব্য মূলত তাহাবী এবং দারা কুতনীতে বর্ণিত মারফু’ হাদীসের ব্যাপারে।
যদি আমরা ধরেও নিই যে, তিনি এ হাদীসের ব্যাপারে বলেছেন, তারপরও দেখুন ইবনে মুবারক রাহি. এর এ বক্তব্যের ব্যাপারে ইমাম ইবনে দাকিক আল ঈদ রাহি. কী বলেন? তিনি বলেন:
“وعدم ثبوت الخبر عند المبارك لا يمنع من النظر فيه. وهو يدور على عاصم بن كليب. وقد وثقه ابن معين”
অর্থাৎ ইবনে মুবারক রাহি. এর নিকট হাদীস প্রমাণিত না হওয়া এ হাদীস নিয়ে গবেষণা করতে বাধা দেয় না। আমরা দেখি এ হাদীসের ভিত্তি হলেন আসিম বিন কুলাইব। তাকে ইবনে মায়ীন তাকে ছিক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। আল ইমাম: ৩১৮।
এ কথায় এ হাদীসটি সহিহ। এ হাদীসের সনদ নিয়ে আপত্তি করার কোন সুযোগ নেই

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *