সফর মাসের শেষ বুধবার আখেরী চাহার শোম্বা, মনগড়া একটি আমল

সফর মাসের শেষ বুধবার আখেরী চাহার শোম্বা, মনগড়া একটি আমল
.
প্রথমে আখেরী চাহার শোম্বা এর ফজিলত সম্পর্কে আলোকপাত করছি। বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত ‘বার চান্দের ফযীলত’ নামক কিতাব থেকে এ সংক্রান্ত আলোচনাটি প্রথমে নকল করছি। সেখানে বলা হয়েছে-
“আখেরী চাহার শোম্বা অর্থ হইতেছে বুধবার; অর্থাৎ সফর মাসের শেষ বুধবারকে বুঝানো হইয়াছে। এই দিনটি মুসলিম জাহানে খুশির দিন হিসাবে পালিত হইয়া আসিতেছে। ইহার কারণ এই যে, হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া হইতে বিদায় নিবার পূর্ববর্তী সফর মাসের শেষ সপ্তাহে ভীষণভাবে রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিলেন, এতপর তিনি এই মাসের শেষ বুধবার দিন সুস্থ হইয়া গোছল করতঃ কিছু খানা খাইয়া মসজিদে নববীতে হাযির হইয়া নামাযের ইমামতি করিয়া ছিলেন। ইহাতে উপস্থিত সাহাবীগণ অত্যাধিক আনন্দিত হইয়া ছিলেন। আর খুশির কারণে অনেকে অনেক দান খয়রাত করিয়াছিলেন। বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর রা. খুশিতে ৭ সহস্র দিনার এবং উমর রা. ৫ সহস্র দিনার, হযরত উসমান রা. ১০ সহস্র দিনার, হযরত আলী রা. ৩সহস্র দিনার এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. ১০০ উট এবং ১০০ ঘোড়া আল্লাহর ওয়াস্তে দান করিয়াছেন। তৎপর হইতে মুসলমানগণ সাহাবীগণের নীতি অনুকরণ ও অনুসরণের জন্য পৃথিবীময় এই আখেরী চাহের শোম্বা দিবসটি প্রতি বৎসর উদযাপন করিয়া আসিতেছে। হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই দিনের গোছলই জীবনের শেষ গোছল ছিল। ইহার পর আর তিনি জীবিতকালে গোছল করেন নাই। তাই সকল মুসলমানদের জন্য এই দিবসে অজু-গোছল করতঃ ইবাদত বন্দেগী করা উচিৎ এবং হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ শরীফ পাঠ করতঃ সওয়াব রেসানী করা কর্তব্য।” (বার চান্দের ফযীলত, পৃষ্ঠা নং ১৪-১৫ মীনা বুক হাউস)
‘মাকসুদুল মুমিনীন’-এ বলা হয়েছে-
“এই মাসের শেষ বুধবারকে আখেরী চাহার শোম্বা বলা হয়। (আখরী শব্দের অর্থ শেষ এবং চাহার শোম্বাহ শব্দের অর্থ বুধবার) হিজরী একাদশ সনের সফর মাসের শেষভাগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত অসুস্থ এবং পীড়িত হইয়া পড়েন। তারপর এই মাসের শেষ বুধবার দিন তিনি শরীরে একটু সুস্থ বোধ করায় গোসলাদি করত কিছুটা শান্তি লাভ করেন। এই গোছলই হুজুরের জীবনের শেষ গোছল ছিল। ইহার পর তাহার জীবনে আর গোছল করার ভাগ্য হয় নাই। এতএব এইদিন মুসলমানদের বিশেষভাবে গোছলাদি করত নফল নামায ও রোযা ইত্যাদি করত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রুহের উপর সাওয়াব বখশেশ করা উচিৎ।” (মাকসুদুল মুমিনীন, পৃষ্ঠা নং ৪৮, মীনা বুক হাউস)
পর্যালোচনা
সফর মাসের শেষ বুধবার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সেগুলো একেবারে ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। আপনি যাকে ভালোবাসেন, সে যদি অসুস্থ হয়, যখন আপনি তাঁর সুস্থতার সংবাদ পাবেন। তখন স্বভাবগত ভাবেই আনন্দিত হবেন। সাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে । এ ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা হলো ঈমানের অঙ্গ। হাদীসে বলা হয়েছে-
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من ولده ، ووالده ، والناس أجمعين
অর্থাৎ তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবেনা, যতক্ষণ আমাকে তোমাদের সন্তানাদি, মাতা-পিতা এবং সকল মানুষ থেকে বেশি ভালো না বাসবে। (বুখারী, হাদীস নং ১৫, শায়খ যুহাইর বিন নাসের তাহকীককৃত)
যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, তাই তার অসুস্থ থেকে সুস্থ হওয়ার সংবাদে আনন্দিত হতেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম এ সংবাদ যেদিন শুনেছেন, সেদিন বিশেষ করে কোনো কিছু করেছেন বা বিশেষ পদ্ধতিতে ইবাদত করেছেন, এমন দাবির পক্ষে শক্তিশালী দলীল পাওয়া দূরের কথা, দুর্বলতম কোনো দলীল পাওয়া যায় না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে মু*সিবতের পাহাড় এসেছে। মক্কার জীবনে আ*ঘা*তে আ*ঘা*তে জ**র্জরিত হয়েছেন তিনি। তায়েফের ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রক্*তাক্ত হওয়ার ঘটনা এখানো অশ্রু ঝরায় প্রতিটি মুসলমানকে। উহুদের হৃদয় বিদারক ঘটনা কি ভুলার মত! এছাড়া রয়েছে বদর যু*দ্ধে মুসলমানদের অসাধারণ বিজয়কে তো সাহাবায়ে কেরাম উৎসব করে বিশেষ পদ্ধতিতে উৎযাপন করেননি।
আখেরী চাহের শোম্বা নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন হযরাতুল উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক বারাকাল্লাহু ফি হায়াতিহি। এখানে হযরতের পুরো আলোচনাটি তুলে ধরছি। যাতে করে বিষয়টি পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়।
“আখেরী চাহার শোম্বা সম্পর্কে বর্ণনাগুলো একেবারেই ভিত্তি*হী*ন। যেমনটি ভি*ত্তিহীন উপরোক্ত উভয় বিবরণ।
১. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এক ই*য়াহু*দী জাদু করেছিল। এটা ছিল হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে মহররম মাসের প্রথম দিনের ঘটনা। এ যাদুর প্রভাব কতদিন ছিল, সে সম্পর্কে দুটো বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে চল্লিশ দিনের কথা। কিন্ত এ দুই বর্ণনায় কোনো সং*ঘর্*ষ নেই। এক বর্ণনায় পুরো সময়ের কথা এসেছে, আর অপর বর্ণনায় এসেছে শুধু সে সময়ের কথা, যাতে জাদুর প্রতিক্রিয়া বেশি ছিল। তবে যাই হোক, সুস্থতার তারিখ কোনো হিসাব অনুযায়ীই সফরের আখেরী চাহার শোম্বা হত পারেনা। (ফাতহুল বারী, ১০/২৩৭, আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ২/১৫৪, শরহুয যুরকানী ৯/৪৪৬-৪৪৭)
২. জাদুর ঘটনা হাদীস ও সিরাত গ্রন্থ সমূহে বিস্তারিতভাবে এসেছে। কিন্তু সেখানে না এ কথা আছে যে, সে সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে জামাতে শরীক হতে পারেননি, আর না আছে মুআওয়াযাতাইন (সূরা ফালাক এবং নাস) দ্বারা জাদুর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাঁর গোছলের বয়ান।
৩. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তাঁর সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট, কিন্তু এ দাবি করা যে, সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের মনীষীগণ সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন, জাহালাত ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, এ দাবির স্বপক্ষে দুর্বলতম কোনো দলীলও বিদ্যমান নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অনেক মসিবত এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও ওহুদে আ*হত হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এসব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে দিবস উৎযাপনের কোনো নিয়ত আছে? তাহলে আখের চাহার শোম্বা, যার কোনো ভিত্তি নেই, তা কীভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে?
৪. কোনো দিনকে বিশেষ ফযীলতের দিবস মনে করা কিংবা বিশেষ কোনো দিন হিসাবে উৎযাপন করা-এই সবগুলো হচ্ছে মুসলামানদের জন্য শরীয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এতএব এগুলো শরয়ী দলীল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে সাব্যস্ত করা যায় না। এটি শরীয়তের একটি অবিসংবাদিত মূলনীতি। এজন্য উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওই সব রসম-রেওয়াজ জারি করার কোনো বৈধতা নেই।
৫. মকসুদুল মুমিনীন পুস্তিকায় যা বলা হয়েছে তা-ও সঠিক নয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত হয়েছে সোমবারে। এর চার পাঁচদিন আগে তাঁর সুস্থতার জন্য যে সাত কুয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তাঁর দেহ মুবারককে গোসল দেওয়া হয়েছিল, তা কি বুধবারের ঘটনা, না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার এবং ইবনে কাসীর রহ. একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। (ফাতহুল বারী ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাযী ৪৪৪২, আলবিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৪/১৯৩, সীরাতুন নবী, শিবলী নুমানী ২/১১৩)
যদি বুধবারের ঘটনা হয়ে থাকে, তবে সফর মাসের শেষ বুধবার কীভাবে হচ্ছে? রসমের পৃষ্টপোষকতাকারীগণ সবাই ইন্তেকালের তারিখ বারো রবিউল আউয়াল বলে থাকেন। সোমবার যদি বারো রবিউল আউয়াল হয়ে থাকে, তাহলে এর আগের বুধবারতো সফর নয়, রবিউল আউয়ালই হচ্ছে।
তাছাড়া এ তথ্য সঠিক নয় যে, বুধবারের পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম আর গোছল করেননি। কেননা এরপর এক রাতে ইশার নামাযের আগে গোসল করার কথা সহীহ হাদীস স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। (সহীহ মুসলিম হাদীস ৪১৮ সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১ এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়–ন, আর রাহীকুল মাখতুম, সফী উদ্দীন মুবারকপুরী পৃষ্ঠা. ৫২৫)
আর একথাও ঠিক নয় যে, বুধবারের পর অসুস্থতায় কোনরূপ উন্নতি হয়নি,বরং এরপর আরেকদিন সুস্থবোধ করেছিলেন এবং যোহরের নামাযে শরিক হয়েছিলেন-একথা সহীহ হাদীসে রয়েছে।( সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৪-৬৮০-৬৮১, সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪১৮, আররাহীকিল মাখতুম ৫২৬)
সোমবার সকালেও সুস্থবোধ করেছিলেন, যার কারণে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। (সীরাতে ইবনে ইসহাক ৭১১-৭১২, আরাওযুল উনুফ ৭/৫৪৭-৫৪৮)
৬. সারকথা এই যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহব্বত, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এবং তাঁর পবিত্র সীরাত ও সুন্নতের অনুসরণ, তাঁর জীবনাদর্শে আপন জীবন গঠন, তাঁর শরীয়তের প্রচার-প্রসার ইত্যাদি হকসমূহ, যা উম্মতের জন্য অবশ্যপালনীয়-এগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং গাফলতির এই প্রকৃত ব্যাধি সম্পর্কে অসচেতন রাখার জন্য এসব ভি*ত্তিহীন রসম-রেওয়াজের উৎপত্তি।
আল্লাহ তায়ালা উম্মতকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং রসম ও মুনকারাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করুন, আমীন। (প্রচলিত ভুল, নতুন সংস্করণ ১১৮-১২২, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া থেকে প্রকাশিত
)
আখেরী চাহার শোম্বা সম্পর্কে আমি দীর্ঘ আলোচনাটি মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেব দা. বা. এর লিখিত অনবদ্য কিতাব ‘প্রচলিত ভুল’ থেকে উল্লেখ করেছি। এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে আশা করি পাঠকের দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েছে যে, আখেরী চাহার শোম্বা নামে কোনো কিছু শরীয়তে নেই। সাহাবায়ে কেরাম থেকে এ দিনের বিশেষ কোন আমল প্রমাণিত নয়। দিনটি উপলক্ষে আমাদের সমাজে যে কাজগুলো প্রচলিত, এর একটিও সহীহভাবে প্রমাণিত নয়। সবগুলো ম*নগ*ড়া এবং মানুষের বানানো। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *