আবু লাহাবের দাসি আজাদ বনাম ঈদে মিলাদুন্নবী
রবিউল আউয়াল মাসে মনে হয় আমরা সবচেয়ে বেশি গালি শুনি রাসুলের দুশমন বলে। যারা নবীর মিলাদ মানে না, তারা কাফের! এমন ফতোয়া শুনতে হয় হরদম! আসলে মিলাদের শাব্দিক অর্থ জন্মগ্রহণ করা। রাসুল পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, শৈশব, কৈশোর পার হয়ে যুবক হয়েছেন, বিবাহ করেছেন, নবুওয়াত লাভ করেছেন, এরপর ইসলামের প্রচার করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, এগুলো তো কেউ অস্বীকার করে না। আমাদের কথা হলো রাসুলের জন্ম উপলক্ষে জশনে জুলুস, আনন্দ করা, মিছিল করা, তাবারুক বিতরণ করা সহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। এগুলোকে অস্বীকার করলে কাফের কেন হবে?
যারা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন, তারা আবু লাহাবের দাসি ছুওয়াইবা কে আজাদ করে দেওয়ার ঘটনা দ্বারা দলিল পেশ করে থাকেন। যারা ঈদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে, তাদের মধ্যে একজন গ্রহণযোগ্য আলেম হলেন মাওলানা মুসতাফা হামিদি রাহি.। মাওলানা মুসতাফা হামিদি রাহি. ‘কুরআন হাদীসের অকাট্য দলীল প্রমাণে মিলাদ কিয়াম’ বিষয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন।
তিনি কিতাবের ৭৮ নং পৃষ্ঠার একটি শিরোনামের নাম দিয়েছেন এভাবে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের ফযীলত’ । সেখানে তিনি মিলাদুন্নবীর কিছু ফজিলত উল্লেখ করেছেন। প্রথমে লিখেন-
“হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহোদর চাচা আবু লাহাবকে তার দাসী ছোয়াইবা যখন হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের সুসংবাদ জানালেন, তৎক্ষণাৎ সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে তাকে আযাদ করে দিলেন। কথিত আছে, উক্ত আবু লাহাবকে তার মৃত্যুর পর তার পরিবারবর্গের কোন এক ব্যক্তি স্বপ্নযোগে দেখে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছ? সে উত্তরে বলল, দোযখে পড়ে আছি। তবে সপ্তাহের সোমবার রাতে আমার শাস্তি হালকা করে দেওয়া হয়। তিনি হাওয়ালা দিয়েছেন হাবিবুল ফাতাওয়া ১/২৬২
পর্যালোচনা
আবু লাহাব ছুয়াইবা আজাদ করেছেন, এ কথা সত্য। কিন্তু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের সুসংবাদ শুনে আজাদ করেছেন, একথা দৃঢ়ভাবে বলার সুযোগ নেই। বিষয়টি মতভেদপূর্ণ। ছুয়াইবা এর ঘটনা বুখারিতে রয়েছে। প্রথমে বুখারি থেকে ঘটনাটি দেখুন,
قَالَ عُرْوَةُ وثُوَيْبَةُ مَوْلَاةٌ لِأَبِي لَهَبٍ كَانَ أَبُو لَهَبٍ أَعْتَقَهَا فَأَرْضَعَتْ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا مَاتَ أَبُو لَهَبٍ أُرِيَهُ بَعْضُ أَهْلِهِ بِشَرِّ حِيبَةٍ قَالَ لَهُ مَاذَا لَقِيتَ قَالَ أَبُو لَهَبٍ لَمْ أَلْقَ بَعْدَكُمْ غَيْرَ أَنِّي سُقِيتُ فِي هَذِهِ بِعَتَاقَتِي ثُوَيْبَةَ
অর্থাৎ উরওয়া বলেন, ছুয়াইবিয়া ছিলেন আবু লাহাবের দাসী। আবু লাহাব তাকে আজাদ করেছিলো। ছুয়াইবিয়া রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুধ পান করিয়েছিলো। যখন আবু লাহাব মারা গেলো, তার পরিবারের কোনো একজনকে তাকে খুব খারাপ অবস্থায় দেখানো হলো। তিনি তাকে বললেন, তুমি কি সাক্ষাৎ করেছো? সে বললো, আমি ভালো কিছুর সাক্ষাৎ করিনি। তবে আমি ছুয়াইবিয়াকে আজাদ করার কারণে এ আঙুল দ্বারা পানি পাই। (বুখারি, হাদিস নং, ৫১০১)
উরওয়া রহ. এর এ মুরসাল বর্ণনা দ্বারা আমরা জানতে পারলাম যে, আবুল লাহাব ছুয়াইবাকে আজাদ করেছিলো। মুহাদ্দিসগণের একটি দল একথা স্পষ্ট বলেছেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর আবু লাহাব ছুয়াইবাকে আজাদ করেছিলেন। এখানে আমি কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরছি।
আল্লামা ইবন সাদ রহ. বলেন-
وأخبرنا محمد بن عمر عن غير واحد من أهل العلم قالوا: وكان رسول الله، صلى الله عليه وسلم، يصلها وهو بمكة، وكانت خديجة تكرمها، وهي يومئذ مملوكة، وطلبت إلى أبي لهب أن تبتاعها منه لتعتقها، فأبى أبو لهب، فلما هاجر رسول الله، صلى الله عليه وسلم، إلى المدينة أعتقها أبو لهب،
অর্থাৎ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন উমর, তিনি অনেক আলেম থেকে বর্ণনা করেছেন, তারা বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে সম্পর্ক রাখতেন যখন তিনি মক্কায় ছিলেন। খাদিজা রা. ও তাকে সম্মান করতেন। ছুয়াইবিয়া সে সময়ে দাসী ছিলেন। খাদিজা আবুল লাহাবের নিকট চেয়েছিলেন যাতে সে তাকে বিক্রি করে দেয় এবং খাদিজা তাকে স্বাধীন করে দেন। কিন্তু আবু লাহাব অস্বীকার করলো। এরপর যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করলেন, তখন আবু লাহাব তাকে আজাদ করে দিলো। ( আত তাবকাতুল কুবরা ১/১০৮, ইহসান আব্বাস তাহকিককৃত)
ইমাম ইবনে আবদিল বার মালেকি রহ. সাহাবাদের জীবনী বিষয়ক একটি কিতাব লিখেছেন ‘আল ইসতিআব’ নামে। কিতাবটি সর্বযুগে সমাদৃত এবং পঠিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছুয়াইবা রাযি. দুধ পান করিয়েছেন, এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেন-
فكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يكرم ثويبة وكانت تدخل على رسول الله صلى الله عليه وسلم وبعد أن تزوج خديجة وكانت خديجة تكرمها وأعتقها أبو لهب بعد ما هاجر رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى المدينة
অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খাদীজা রা. ছুওয়াইবাকে সম্মান করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পর আবু লাহাব তাকে আজাদ করে দেন। (আল ইসতিআব ১/২৮ দারুল যিল, বায়রুত, প্রথম সংস্করণ)
ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন-
( وكانت ثويبة تدخل على رسول الله صلى الله عليه وسلم بعدما تزوج خديجة فيكرمها رسول الله صلى الله عليه وسلم وتكرمها خديجة ، وهي يومئذٍ أمة ، ثم أعتقها أبو لهب )
অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজাকে বিবাহ করার পর ছুয়াইবিয়া তাদের নিকট আসলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খাদিজা রা. তাকে সম্মান করলেন। সে সময়ে তিনি দাসী ছিলেন। এরপর আবু লাহাব তাকে আজাদ করে দেন। ( আল জামি লি ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতিল উলামা ফিল মাওলিদ ১২/১৯)
আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে, ছুয়াইবাকে আবু লাহাব আজাদ করেছিলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পর। ইবনুল জাওযী রহ. এর বর্ণনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজাকে বিবাহ করার পরও তিনি বাদী ছিলেন। রা
এছাড়া উরওয়া এর বর্ণনা ছুয়াইবা রাযি. কে আজাদ করার কারণে জাহান্নামে তার শাস্তি ওই দিন কমে, এ বক্তব্যটির উপর মুহাদ্দিসরা আপত্তি করেছেন। অনেকেই বলেছেন যে, একথা সঠিক নয়। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন-
وفي الحديث دلالة على أن الكافر قد ينفعه العمل الصالح في الآخرة لكنه مخالف لظاهر القرآن قال الله تعالى وقدمنا إلى ما عملوا من عمل فجعلناه هباء منثورا وأجيب أولا بان الخبر مرسل أرسله عروة ولم يذكر من حدثه به وعلى تقدير أن يكون موصولا فالذي في الخبر رؤيا منام فلا حجة فيه ولعل الذي رآها لم يكن إذ ذاك أسلم بعد فلا يحتج به وثانيا على تقدير القبول فيحتمل أن يكون ما يتعلق بالنبي صلى الله عليه و سلم مخصوصا من ذلك بدليل قصة أبي طالب كما تقدم أنه خفف عنه فنقل من الغمرات إلى الضحضاح
অর্থাৎ আবুল লাহাবের দাসী আজাদ করার কারণে শাস্তি লাঘব হওয়ার বিষয়টি কুরআনের স্পষ্ট নসের বিপরীত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন কাফেরদের ভালো কাজ আখেরাতে বিক্ষিপ্ত বালুর মতো উড়ে যাবে।
এছাড়া খবরটি মুরসাল। এছাড়া মাওসুল ধরে নিলে বিষয়টি স্বপ্নের। আর স্বপ্ন শরীয়তে দলিল নয়। এজন্য স্বপ্ন দ্বারা দলিল দেয়া যাবে না। (ফাতহুল বারী ৯/১৪৫ দারুল মারেফা, বায়রুত)
সুতরাং এ ঘটনা দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে দলিল দেওয়া অনূচিত। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন।