ঈদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে কিছু জাল হাদীস

                                        ঈদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে কিছু জাল হাদীস
ঈদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে  আমাদের পক্ষে বেশ কিছু জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। আজকে  এ ধরণের কয়েকটি জাল হাদিস নিয়ে আলেচনা করছি।
 ঈদে মিলাদুন্নবীর পক্ষে বেশ কিছু রেওয়ায়াত পেশ করা হয়। প্রথমে রেওয়ায়াতগুলো দেখেন-
আবু বকর রা. বলেন, যে ব্যক্তি মওলুদখানি তথা ঈদে মিলাদুন্নবীর জন্য একটি দেরহাম খরচ করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।
উসমান রা. বলেন, যে ব্যক্তি মওলুদখানির জন্য একটি দেরহাম খরচ করবে, সে যেন বদর ও হুনাইন যুদ্ধে অংশ নিল!
হাসান বসরী বলেন, হায়! আমার যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো, তাহলে আমি তা মওলুদখানির জন্য খরচ করতাম।
ইমাম শাফেয়ী বলেন, যে ব্যক্তি মওলুদখানির জন্য তার বন্ধুবর্গকে একত্র করে, খাবারের আয়োজন করে, একটি স্থান শুন্য রাখে, ইহসানের সাথে আমল করে এবং মওলুদখানির ব্যবস্থা করে, তাকে আল্লাহ কিয়ামতের দিন সিদ্দীকীন, শুহাদা ও ছালেহীনের সঙ্গে হাশর করাবেন এবং তাকে জান্নাতুন নায়ীমে অবস্থান করাবেন।
জালালুদ্দীন সুয়ূতি রহ. তাঁর রচিত ‘আলওয়াসাইল ফী শরহিশ শামায়িল’ গ্রন্থে লিখেন: যে গৃহ, মসজিদ বা মহল্লায় মওলুদখানি হয়, সেই গৃহ,মসজিদ ও মহল্লাকে ফিরিশতারা ঘিরে ফেলে এবং তাদের জন্য দোয়া করে, আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মাফ করে দেন। আর যারা নূর দ্বারা পরিবেষ্টিত অর্থাৎ জিবরাইল, মীকাইল, ইসরাফীল ও আজরাইল, তাঁরা ওইসব মওলুদখানির ব্যবস্থাকারীদের জন্য দোয়া করতে থাকেন।
সবগুলো কথার রেফারেন্স হিসাবে  আল্লামা ইবনে হাজার হাইতামী রহ. ‘আন নি’মাতুল কুবরা’ এর হাওয়ালা উল্লেখ করা হয়।
সবগুলো বর্ণনা জাল। আল্লামা ইবনে হাজার হাইতামির লিখিত ‘আন নি’মাতুল কুবরা’তে এ ধরণের কোনো রেওয়ায়াত নেই। কারণ মিলাদ আবিষ্কার হয়েছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের ছয়শত বছর পরে। যারা মিলাদকে মুস্তাহসান বলেছেন, জালালুদ্দিন সুয়ুতি এবং সালেহ আশ শামি সেটা স্বীকার করেছেন। দেখুন তাদের বক্তব্য। হাফেজ জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ. বলেন-
أول من أحدث فعل ذلك – أي فعل المولد- صاحب إربل الملك المظفر
অর্থাৎ মিলাদ সর্বপ্রথম শুরু করেন ইরবিল এর বাদশাহ মুযাফফার। ( আল হাওয়ী লিল ফাতাওয়া ১/১৮৯)
সালেহ আশ শামী রহ. বলেন-
وأول من أحدث ذلك من الملوك صاحب إربل الملك المظفر أبو سعيد كو كوبري
অর্থাৎ মিলাদ সর্বপ্রথম শুরু করেছেন ইরবিলের বাদশাহ মুযাফফার আবু সাইদ কুকবারী। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ১/৩৬২)
কথা হলো যে জিনিস শুরু হয়েছে রাসুলের ইন্তেকালের ছয়শো বছর পরে, সেটা ফজিলত কীভাবে আবু বকর, উসমান রা., হাসান বসরি, শাফেফি রহ. থেকে বর্ণিত হবে? রেওয়ায়াতগুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত দেখুন প্রখ্যাত মুহাক্কিক মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব হাফিজাহুল্লাহ এর পর্যালোচনা। তিনি লিখেন-
“ “উপরোক্ত বর্ণনাগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। যাদের নামে এই সব কথা চালানো হয়েছে তাদের সাথে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলোর ভিত্তিহীনতা একেবারে স্পষ্ট। কারণ, যদি এগুলোর কোনো ভিত্তি থাকত, তাহলে তো মীলাদকে পরবর্তীকালের উদ্ভাবিত বেদয়াত বলে স্বীকার করার প্রয়োজন হতনা; বরং সহেজেই মীলাদকে সাহাবীদের আমল বলে প্রমাণ করা যেত। প্রকৃত বিষয় এই যে, মওলুদখানির প্রচলনের পরে কোনো মূর্খ এগুলোকে তৈরী করেছে।
রাজারবাগীরা এ সব জাল বর্ণনার সমর্থনে ‘আননি‘মাতুল কুবরা আলাল আলম’-এর উদ্ধৃতি পেশ করেছে। অথচ তাতে এগুলোর চিহৃমাত্র নেই। এই কিতাবটির মাখতুতাহ (পান্ডুলিপি) দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যাহ কায়রোতে (ইতিহাস ২৫০৮/১৯২১) সংরক্ষিত রয়েছে এবং আমাদের কাছে তার ফটোকপি রয়েছে। আমরা তা আদ্যোপান্ত পড়েছি।
এর বিপরীতে আন নি‘মাতুল কুবরা কিতাবে ইবনে হাজার মাক্কী মীলাদকে ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর অনেক পরের উদ্ভাবিত বিষয় বলেছেন এবং মীলাদের তথাকথিত বর্ণনাগুলো খন্ডন করে বলেছেন যে, মানুষকে এগুলো থেকে দুরে রাখা ওয়াজিব। -আন নি‘মাতুল কুবরা, ২-৩ পান্ডুলিপি।
রাজারবাগীরা মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্য একটি নকল আননি‘মাতুল কুবরা এর হাওয়ালা দিয়েছে। যা ইস্তাম্বুলের মাকতাবাতুল হাকীকাহ (দারুশ শাফকাহ, ফাতিহ, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক) এর ছাাঁপা। তুরস্কের এ প্রকাশনাটি কট্টর বেদয়াতপন্থীদের। এরা বিভিন্ন শিরিক ও বেদয়াতের সমর্থনে কিতাবপত্র প্রকাশ করে থাকে। এমনকি কখনো কখনো কোনো বেদয়াতপন্থী লেখকের বাজে কিতাব হাজির করে বা লেখকের নাম পরিবর্তন করে পূর্ববর্তী কোনো স্বীকৃত আলেমের নামে তা চালিয়ে দেয়। এরপর কিতাবটির এমন একটি নাম নির্বাচন করে যে নামে উক্ত মনীষীর কোনো একটি কিতাব ছিল কিন্তু বর্তমানে তা মুদ্রিত নেই। এখানেও মাকতাবাতুল হাকীকাহ ওয়ালারা এ কারসাজি করেছে। ইবনে হাজার মক্কী রহ. এর নাম এবং তার কিতাব আননি‘মাতুল কুবরা এর নাম এমন একটি কিতাবের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যা কোনো বেদ্বীন ও নির্বোধ বেদয়াতীর রচনা। যে জাল বর্ণনা তৈরীর ক্ষেত্রে সামান্য বুদ্ধির ও পরিচয় দিতে সক্ষম নয়। যাতে কিছু সময়ের জন্য হলেও কিংবা কিছু মানুষের কাছে হলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে! বেচারা তো এতো কাচা মিথ্যা বলে যে, শুনা মাত্র ধরা পড়ে যায়। সে এতটুকু চিন্তা করেনি যে আট নয়শো বছর পরের উদ্ভাবিত মওলুদখানির ফযীলত যদি আবু বকর রা. ও উসমান রা. এর নামে চালানো হয়, তবে কে তা বিশ্বাস করবে? তেমনি হাসান বসরী (২১-১১১হি.) ও ইমাম শাফেয়ী রহ. (১৫০-২০৪ হি.) এর নামে এমন প্রলাপ চালু করা হলে তা কী বাজারে চলবে? সে এটাও চিন্তা করেনি যে, জালালুদ্দীন সুয়ূতিতো আমাদের নিকটবর্তী সময়ের ব্যক্তি। তার নামে কোনো কিছু বানানো হলে তা কী গোপন থাকবে? অথচ সে তাই করেছে এবং সুয়ূতি রহ. এর নামে এমন কিতাব জুড়ে দিয়েছে যে নামে তার কোনো রচনাই নেই? সুয়ূতি রহ. নিজে তার রচনাবলি তালিকা লিখে গেছেন এবং তার পরের আলেমগণও তার রচনাগুলো গণনা করেছেন, যা মূদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ‘আলওয়াসাইল ফী শরহিশ শামায়িল’ নামে তাতে কিছুই নেই। কিন্তু দেখুন ড. আবদুল হালিম চিশতী কৃত ‘তাজকেরায়ে জালালুদ্দীন সুয়ূতি’ ১১৭-৩৮০
তদুপরি সুয়ূতি রহ. নিজে তার কিতাব ‘আল হাভী’ (১/২৫১-২৫২)তে মীলাদ অনুষ্ঠানকে নব উদ্ভাবিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাহলে তিনি কীভাবে উক্ত ফযীলত বয়ান করতে পারেন?
ওই মিথ্যুক যেমন মিথ্যা বলতে বুদ্ধি খরচ করেনি তেমনি ইস্তাম্বুলের ‘মাকতাবাতুল হাকীকাহ’ এর লোকেরাও তার কিতাবে ইবনে হাজার মক্কী রচিত ‘আননি‘মাতুল কুবরা’ এর নাম ব্যবহারের প্রতারণা কুশীলভাবে করতে পারেনি। তাদের ভাবা উচিৎ ছিল যে, ইবনে হাজার মক্কী (৯৭৩হি.) একজন প্রসিদ্ধ আলেম এবং তার কিতাব ‘আন নি‘মাতুল কুবরা’ ও একটি প্রসিদ্ধ কিতাব। যার পান্ডুলিপি বিভিন্ন গ্রন্থাঘারে বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং সে সব পান্ডুলিপির সাথে এই প্রকাশিত কিতাবটি মিলিয়ে দেখলেই তাদের প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাবে; বরং বিজ্ঞ আলেমগণ এই কিতাব পড়ামাত্র বলে দিবেন যে, তা ইবনে হাজার মক্কী রহ. এর রচনা হতেই পারেনা। একে তাঁর নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। রাজারবাগীরা যদি এই সব ইতিহাস জানা সত্ত্বেও সাধারণ জনগণকে ধোকা দেওয়ার জন্য এসব জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনার উপর ‘আননি‘মাতুল কুবরা’-র উদ্ধিৃত ব্যবহার করে থাকে, তাহলে এটি হবে তাদের পক্ষ থেকে অন্যকে বিপদগামী করার একটি নতুন দৃষ্টান্ত। অবশ্য এমন নজীর তাদের আরো আছে। আর যদি অজ্ঞতাবশত যদি তারা এরুপ করে থাকে-এ সম্ভাবনা অবশ্য খুবই ক্ষীণ, তাহলে বাস্তব বিষয়টি জানার পর এখন তাদের তওবা করা এবং সাধারণ মানুষকে প্রকৃত বিষয় অবগত করার জন্য সংশোধনী প্রকাশ করা জরুরী”।( নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা নং ১৬৭-১৬৯)
ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে পর্যালোচনা করুন। কিন্তু দয়া করে জাল হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকুন।

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *