সালাফি আলেমদের দৃষ্টিতে তামিমা এর অর্থ

সালাফি আলেমদের দৃষ্টিতে তামিমা এর অর্থ

রেজাউল কারীম আবরার

মান আল্লাকা তামিমা ফাক্বাদ আশরাকা’ যে তাবিজ লটকালো, সে শিরক করল। আমাদের সমাজে যারা ব্যাপকভাবে তাবিজকে শিরক বললেন, তারা এ হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করেন। মূলত এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ‘তামিমা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তারা ‘তামিমা’ দ্বারা উদ্দেশ্য নেন সব ধরণের তাবিজ। এজন্য কুরআনের আয়াত লিখে, হাদীস লিখে, অর্থবোধক কোন কথা কিংবা দোয়া লিখে লটকালে সেটাকে তারা শিরক বলে ফতোয়া দিয়ে দেন!

অথচ কুরআনের আয়াত কিংবা হাদীস কিংবা কোন দোয়া বা অর্থবোধক কোন কিছু লিখে লটকালে সেটাকে কখনও ‘তামিমা’ বলা হয় না। এটা শিরক কিংবা হারামও নয়। ‘তামিমা’ বলা হয় ছোট ছোট পাথর কিংবা হিং¯্র প্রাণীর হাড্ডি কিংবা নখ ইত্যাদি লটকানোকে। সেটাকে কেউই জায়েজ বলে না।
আসুন, প্রথমে আমরা লা মাজহাবিদের নিকট গ্রহণযোগ্য কয়েকজন আলেমের বক্তব্য থেকে ‘তামিমা’ এর অর্থ জেনে আসি। তারা ‘তামিমা’ দ্বারা কী উদ্দেশ্য নিয়েছেন?

১.নাসির উদ্দিন আলবানি বলেন:
(التمائم) جمع تميمة، وأصلها خرزات تعلقها العرب على رأس الولد لدفع العين، ثم توسعوا فيها فسموا بها كل عوذة.
অর্থাৎ তামায়িম শব্দটি ‘তামিমা’ এর বহুবচন। মূল অর্থ হলো, ছোট ছোট পাথর। আরবের লোকজন বাচ্চাদের মানুষদের চোখ লাগা থেকে দূর করার জন্য বাচ্চাদের গলায় ঝুলিয়ে দিত। এরপর অর্থে প্রশস্ততা এসেছে। এখন সব ধরণের বস্তুকে ‘তামিমা’ বলা হয়। সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা: ১/৬৫০

আলবানি রাহি. এর বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে ছোট ছোট পাথর লটকানোকে ‘তামিমা’ বলা হতো। সেটাকে আমরাও জায়েজ মনে করি না।
আরেক জায়গায় তিনি বলেন:
التميمة: خرزات كانت العرب تعلقها على أولادهم يتقون بها العين في زعمهم
فأبطلها الإسلام كما في ” النهاية ” لابن الأثير.
অর্থাৎ তামিমা বলা হয় ছোট ছোট পাথরকে। আরবের লোকজন তাদের ধারণা মতে মানুষের বদ নজর থেকে বাঁচানোর জন্য বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে দিত। ইসলাম এটাকে বাতিল করে দিয়েছে। যেমনটি ইমাম ইবনুল আছির রাহি. “আন নিহায়া” তে বলেছেন।
আলবানি রাহি. এর বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কুরআনের আয়াত লিখে লটকালে আরবের লোকজন সেটাকে ‘তামিমা’ বলত না। বরং ছোট ছোট পাথর লটকানোকে আরবের লোকজন ‘তামিমা’ মনে করত।

২. শায়খ মুনাবি বলেন:
والتمائم واحدتها تميمة خرزات تعلقها العرب على أولادها لاتقاء العين فأبطلها الشارع ونهى عنها
‘তামায়িম’ শব্দটি ‘তামিমা’ এর বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ছোট ছোট পাথর। আরবের লোকজন তাদের ধারণা মতে মানুষের বদ নজর থেকে বাঁচানোর জন্য বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে দিত। ইসলাম এটাকে বাতিল করে দিয়েছে এবং ছোট ছোট পাথর লটকাতে নিষেধ করেছে। ফায়যুল কাদির: ৬/১৮১

আরেক জায়গায় তিনি বলেন:
والتميمة خرزات تعلق على الأولاد للعين فأبطل النبي صلى الله عليه وسلم ذلك
‘তামিমা বলা হয় ছোট ছোট পাথরকে, আরবের লোকজন বদনজর থেকে বাঁচার জন্য তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে দিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। ফায়জুল কাদির: ৩/৩২১

৩. আবদুর রহমান মুবারকপুরির দৃষ্টিতেও তাবিজ এবং তামিমা এক নয়। তিনি বলেন:
(مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا) أَيْ مَنْ عَلَّقَ عَلَى نَفْسِهِ شَيْئًا مِنَ التَّعَاوِيذِ وَالتَّمَائِمِ وَأَشْبَاهِهَا مُعْتَقِدًا أَنَّهَا تَجْلُبُ إِلَيْهِ نَفْعًا أَوْ تَدْفَعُ عَنْهُ ضَرًّا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন কিছু লটকালো, অর্থাৎ যে ব্যক্তি তামিমা, তাবিজ কিংবা এ জাতীয় কোন কিছু লটকালো এ আকিদা রেখে যে, লটকানো বস্তুই তার উপকার কিংবা ক্ষতি করবে, তাহলে সেটা শিরক হবে। তুহফাতুল আহওয়াজি: ৬/১৯৯
৪. সালেহ আল মুনাজ্জিদ বলেন:
التمائم : جمع تميمة وهي ما يعلق بأعناق الصبيان أو الكبار أو يوضع على البيوت أو السيارات من خرزات وعظام لدفع الشر – وخاصة العين – ، أو لجلب النفع .
অর্থাৎ তামিমা বলা হয় ছোট ছোট পাথর এবং হাড্ডিকে, যা বাচ্চাদের গলায় কিংবা বড়দের গলায় লটকানো হয়, অথবা ঘর কিংবা গাড়িতে এ উদ্দেশ্যে রাখা হয় যে এ হাড্ডি কিংবা ছোট পাথর অনিষ্টতা দূর করবে বা উপকার করবে। ইসলাম ওয়েব: ১০৫৪৩।
৫. শাওকানি বলেন:
والتمائم جمع تميمة، وهي خرزات كان العرب تعلقها على أولادهم يمنعون بها العين في زعمهم فأبطله الإسلام.
অর্থাৎ তামিমা বলা হয় ছোট ছোট পাথরকে। আরবের লোকজন তাদের ধারণা মতে মানুষের বদ নজর থেকে বাঁচানোর জন্য বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে দিত। ইসলাম এটাকে বাতিল করে দিয়েছে। নাইলুল আওতার: ৮/২২১
৬. আবুল হাসান সিন্ধি রাহি. বলেন:
“التمائم” جمع تميمة أريد بها الخرزات التي يعلقها النساء في أعناق الأولاد على ظن أنها تؤثر وتدفع العين.
অর্থাৎ ‘তামিমা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ছোট ছোট পাথর, আরবের মহিলারা যে পাথরগুলো তাদের বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে দিত। এ ধারণায় যে এ পাথর নিজস্ব ক্ষমতায় বাচ্চাদের বদনজর থেকে হেফাজত করবে। ফাতহুল ওয়াদুদ: ৪/১৩।
আরেক জায়গায় তিনি বলেন:
المراد تمائم الجاهلية مثل الخرزات وأظفار السباع وعظامها، أما ما يكون بالقرآن والأسماء الإلهية فهو خارج عن هذا الحكم بل جائز لحديث عبد الله بن عمرو أنه كان يعلق على الصغار بعض ذلك، وقيل القبح إذا علق شيئًا معتقدًا جلب نفع أو دفع ضرر أما للتبرك فيجوز.
অর্থাৎ যে হাদীসে ‘তামিমা’ লটকাতে নিষেধ করা হয়েছে, সে হাদীসে ‘তামিমা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জাহেলি যুগের তামিমা। সেটা হলো, ছোট ছোট পাথর, হিংস্্র প্রাণীর নখ এবং হাড্ডি লটকানো। এখন যদি কেউ কুরআনের আয়াত কিংবা আল্লাহর নাম লিখে লটকায়, তাহলে সেটা এ বিধানের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাযি. এর হাদীস দ্বারা জায়েজ প্রমাণিত। কারণ, তিনি ছোট বাচ্চাদের গলায় কুরআনের আয়াত লিখে লটকিয়ে ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, যদি কেউ এ বিশ্বাস রেখে লটকায় যে এ লটকানো বস্তুই তার উপকার কিংবা ক্ষতি করার সামর্থ রাখে, তখন সেটা শিরক হবে। তবে বরকত মনে করে লটকালে জায়েজ হবে। আস সিরাজুল মুনির শারহিল জামিয়িস সাগির: ৩/৬৩
৭. শায়খ নুরুদ্দীন আযিযি বলেন:
(والتمائم) جمع تميمه خرزات تعلقها العرب على أولادها لدفع العين
অর্থাৎ তামিমা বলা হয়, ছোট ছোট পাথরকে, আরবের লোকজন মানুষের বদনজর থেকে বাঁচার জন্য ছোট ছোট বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে রাখত।
৮. সায়্যিদ মুহাম্মাদ সাবিক্ব বলেন:
هي الخرزة التي كان العرب يعلقونها على أولادهم يمنعون بها العين في زعمهم، فأبطله الاسلام ونهى عنه.
‘তামায়িম’ শব্দটি ‘তামিমা’ এর বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ছোট ছোট পাথর। আরবের লোকজন তাদের ধারণা মতে মানুষের বদ নজর থেকে বাঁচানোর জন্য বাচ্চাদের গলায় লটকিয়ে দিত। ইসলাম এটাকে বাতিল করে দিয়েছে এবং ছোট ছোট পাথর লটকাতে নিষেধ করেছে। ফিকহুস সুন্নাহ: ১/৪৯৫।

এখানে আমি লা মাজহাবিদের গ্রহণযোগ্য আটজন ইমামের বক্তব্য তুলে ধরলাম। তারা সকলেই ‘তামিমা’ অর্থ করেছেন ছোট ছোট পথর লটকানো কে। আরবের মহিলারা এ নিয়তে বাচ্চাদের গলায় ছোট ছোট পাথর লটকিয়ে রাখত যে, এ পাথর বাচ্চাদের বদনজর থেকে রক্ষা করবে। এটাতো সবার সর্বসম্মত মতানুসারে শিরক।
মূলত আলোচনার টপিক হলো, কুরআনের আয়াত , হাদীস, দোয়া বা অর্থবোধক কোন কিছু লিখে লটকানো শিরক কিনা? আমরা বলি শিরক না। জায়েজ। তারা বলেন, শিরক। দলিল হলো তামিমা এর হাদীস। অথচ তামিমা এবং তাবিজ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস!

Check Also

সদকায়ে ফিতর টাকা দ্বারা আদায় করার দলিল নেই?

শায়খ কাজি ইবরাহিম সাহেবের ফতোয়া দেখলাম। তার বক্তব্য অনুসারে টাকা দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায়ের কথা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *