আজানে বা দোয়ায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে আঙুলে চুমো খাওয়ার বিধান
রেজাউল কারীম আবরার
বর্তমানে বিষয়টি খুবই আলোচিত। সুন্নী নামধারী ভাইরা এটাকেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালবাসার চূড়ান্ত মাপকাঠি বানিয়ে নিয়েছেন! যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগায় না, তাদেরকে তারা গোস্তাখে রাসূল মনে করেন! বিষয়টি এখন রীতিমত বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবশ্যই ভালবাসতে হবে। কারণ তাকে ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু ভালবাসা প্রকাশ করতে হবে রাসুলের শেখানো পন্থায়। নিজেদের মনগড়া কোন আমল দ্বারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা যাবে না।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন মুসলমানদের নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয়। এজন্য মুসলমানদের জন্য জরুরি হল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনলে দুরুদ শরীফ পড়া। একাধিক সহিহ হাদিসে এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিসের ভান্ডার তালাশ করে এ ব্যাপারে কোন হাদিস পাওয়া যাবে না যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগানোর কথা বলা হয়েছে । রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে দুরুদ শরীফ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস নিম্নে তুলে ধরছি।
হযরত হুসাইন বিন আলি রা. থেকে বর্ণিত,
عن حسين بن علي بن أبي طالب قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم البخيل الذي من ذكرت عنده فلم يصل علي
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কৃপণ হল সে ব্যক্তি, যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হল, কিন্তু সে আমার উপর দুরুদ পড়ল না। (. মুসনাদে আহমদ, ১৭৩৬. শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকিকককৃত। তিরমিজি, ৩৫৪৬. শায়খ আহমদ শাকের রহ. তাহকিককৃত। সহিহ ইবনে হিব্বান, ৯০৯.)
এ হাদিসে আমরা দেখলাম যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম শুনে যে ব্যক্তি দুরুদ পড়ল না, তাকে কৃপণ বলেছেন। বুঝা গেল, রাসুলের নাম শুনে আমাদের দুরুদ পড়তে হবে। যদি আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগানোর কথা হত, তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই হাদিসে সে বিষয় স্পষ্ট করে দিতেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
رغم أنف رجل ذكرت عنده
ওই ব্যক্তির নাক ধুলোয় ধুসরিত হোক, যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হল, কিন্তু সে আমার উপর দুরুদ পড়ল না। (মুসনাদে আহমদ, ৭৪৫১. তিরমিজি, ৩৪৪৫. সহিহ ইবনে হিব্বান, ৯০৮)
এ দুই হাদিসে আমরা দেখতে পেলাম যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম শুনে যারা দুরুদ পড়ে না, তাদের জন্য বদ দোয়া করছেন। যদি রাসুলের নাম শুনে আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগানো মুস্তাহাব এবং সওয়াবের কাজ হত, তাহলে অবশ্যই হাদিেেস দুরুদ শরীফের সাথে উক্ত আমলের কথা উল্লেখ থাকত। এজন্য ফিকহ ও ফতোয়ার গ্রন্থাবলিতে যেখানেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের নাম শুনে দুরুদ শরীফের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও উক্ত আমলের কথা উল্লেখ নেই।
.
“ফতোয়া কাযীখান”এ আছে-
ولو سمع اسم النبي صلى الله عليه و سلم فإنه يصلي عليه .فإن سمع مرارا في مجلس واحد اختلفوا فيه. قال بعضهم لا يجب الا مرة وقال بعضهم يصلي في كل مرة
অর্থাৎ, কেউ যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে,তাহলে তার জন্য জরুরী হল রাসুলের উপর দুরুদ পড়া। যদি এক মজলিসে বারবার শুনে, তাহলে কেউ বলেন, একবার দুরুদ পড়া দুরুদ পড়া ওয়াজিব। কেউ কেউ বলেন, প্রতিবারই দুরুদ পড়া ওয়াজিব। (ফতোয়া কাজিখান, ৩/৩০৬. মাকতাবাতুল ইত্তেহাদ।)
“ফতোয়া আলমগীরী”তে আছে-
وَلَوْ سَمِعَ اسْمَ النَّبِيِّ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَإِنَّهُ يُصَلِّي عَلَيْهِ ، فَإِنْ سَمِعَ مِرَارًا فِي مَجْلِسٍ وَاحِدٍ اخْتَلَفُوا فِيهِ قَالَ بَعْضُهُمْ : لَا يَجِبُ عَلَيْهِ أَنْ يُصَلِّيَ إلَّا مَرَّةً ، كَذَا فِي فَتَاوَى قَاضِي خَانْ .
وَبِهِ يُفْتَى ، كَذَا فِي الْقُنْيَةِ .
وَقَالَ الطَّحَاوِيُّ يَجِبُ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ عِنْدَ كُلِّ سَمَاعٍ ، وَالْمُخْتَارُ قَوْلُ الطَّحَاوِيِّ ، كَذَا فِي الْوَلْوَالِجِيَّةِ .
এখানে প্রথমে ‘ফতোয়া কাজিখান’ এর ইবারত নকল করা বলা হয়েছে, এক মজলিসে একাধিকবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উচ্চারণ হলে একবার দুরুদ পড়া ওয়াজিব। এমননি আছে “আল কুনয়াহ”তে। ইমাম তাহাবি বলেন, প্রত্যেকবারই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পড়া ওয়াজিব। ‘ফতোয়া ওয়ালওয়ালিজিয়্যহ’ এর ভাষ্যমতে ইমাম তাহাবিরর বক্ত্য গ্রহণযোগ্য। (ফতোয়া আলমগীরী, ৫/৩৬৮)
‘ফতোয়া শামী’ তে আছে-
( واختلف ) الطحاوي والكرخي ( في وجوبها ) على السامع والذاكر ( كلما ذكر ) صلى الله عليه وسلم ( والمختار ) عند الطحاوي ( تكراره ) أي الوجوب ( كلما ذكر ) ولو اتحد المجلس في الأصح لا لأن الأمر يقتضي التكرار ، بل لأنه تعلق وجوبها بسبب متكرر وهو الذكر ، فيتكرر بتكرره وتصير دينا بالترك ، فتقضى لأنها حق عبد كالتشميت بخلاف ذكره تعالى ( والمذهب استحبابه ) أي التكرار وعليه الفتوى
অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে প্রত্যেকবার দুরুদ শরীফ পড়া ওয়াজিব হওয়া প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবি এবং কারখির মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম তাহাবিরর মতে প্রত্যেকবারই দুরুদ শরীফ পড়া ওয়াজিব। যদিও মজলিস এক হয়। তাবে গ্রহণযোগ্য কথা হল, প্রত্যেকবার দুরুদ শরীফ পড়া মুস্তাহাব।( ফতোয়া শামী, ১/৫১৭. এইচ, এম সাইদ কোম্পানী।)
.
মোটকথা হল, ফিক্বহ, ফতোয়ার গ্রন্থাবলিতে ও দুরুদ শরীফ পড়া ওয়াজিব কি না? এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কোথাও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম শুনে আঙ্গুলে চুমো খাওয়ার কথা নেই। যদি এ আমল সহিহ দ্বারা প্রমাণিত হত, তাহলে অবশ্যই ফুকাহায়ে কেরাম সে বিষয়ে আলোকপাত করতেন।
আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগানোর দলিল
যারা আজানে, ইকামতে বা অন্য কোন জায়গায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগানোর কথা বলেন, তারা দলিল স্বরুপ একটি জাল হাদিস পেশ করেন। বর্ণণনাটি হল-
أنه لما سمع قول المؤذن أشهد أن محمد رسول الله قال هذا وقبل باطن الأنملتين السبابتين ومسح عينيه، فقال صلى الله عليه وسلم: من فعل مثل ما فعل خليلي فقد حلت عليه شفاعتي،
অর্থাৎ হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. যখন মুয়াজ্জিনকে “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ” বলতে শুনলেন, তখন তিনিও তা বললেন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয় চুমে খেয়ে তা চোখে লাগালেন। তা দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আমার দোস্তের ন্যায় আমল করবে, তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব।
বর্ণনাটি দাইলামি “মুসনাদুল ফিরদাউস”এ উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটি সম্পর্কে ইমাম সাখাবি রহঃ বলেন: ولا يصح অর্থাৎ, বর্ণনটি সহিহ নয়। (আল মাকাসিদুল হাসানাহ, ৪৫১)
এমনিভাবে আল্লামা তাহের পাটনিও হাদিসকে ভিত্তিহীন বলেছেন। (তাযকিরাতুল মাওযুয়াত. ১/১৫. মাকতাবাতুশ শামেলা।)
হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়ুতি রহঃ বলেন-
والأحاديث التي رويت في تقبيل الأنامل و جعلها على العينين عند سماع اسمه صلى الله عليه و سلم عن المؤذن في كلمة الشهادة كلها موضوعات”
অর্থাৎ, মুয়াজ্জিনের শাহাদাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের নাম শুনে আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে মোছার ব্যাপারে যতগুলো রেওয়ায়াত রয়েছে, সবগুলো জাল এবং বানোয়াট। (. রাহে সুন্নাত, ২৪৩.)
মোল্লা আলী কারী রহ.ও ইমাম সাখাবীর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ, বর্ণনটিকে তিনি জাল এবং বানোয়াট বলেছেন। (. আল মাসনু, ১৬৮,১৭০. শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ রহঃ তাহকীককৃত।)
এ ধরণের জাল এবং বানোয়াট রেওয়ায়াতের উপর ভিত্তি করে কোন আমল মুস্তাহাব প্রমাণিত হয় না। এজন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শুনে আঙুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগানো মুস্তাহাব এবং সওয়াবের কাজ নয়। বরং কুরআন হাদীস বিবর্জিত পরিস্কার বেদয়াত। এমন মনগড়া আমল অবশ্যই পরিত্যাগ করা চাই।
এছাড়া যদি আমল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হত, তাহলে বিষয়টি ব্যাপক হওয়ার কারণে অনেক সাহাবি থেকে বর্ণিত হত। কিন্তু আমরা দেখি যে, এ বিষয়ে সহিহ হাদিস তো দূরের কথা, জয়িফ পর্যায়েরও কোন হাদিস নেই। এমন মনগড়া আমল থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।