শবে বরাতের হাদীসের ব্যাপারে মুবারকপুরি রাহি. এবং আলবানি রাহি. এর তাহকীক নিয়ে কিছু কথা

শবে বরাতের হাদীসের ব্যাপারে মুবারকপুরি রাহি. এবং আলবানি রাহি. এর তাহকীক নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশে যারা শবে বরাত নেই বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন, তাহকিকের ক্ষেত্রে তাদের শীর্ষ দুইজন লা মাজহাবী আলেম হলেন শায়খ আবদুর রহমান মুবারকপুরী রাহি. এবং শায়খ আলবানী রাহি.। আমরা দেখি যে, তারা উভয়ে শবে বরাতের ভিত্তি এবং মর্যাদার কথা স্বীকার করেছেন। প্রথমে আমরা আবদুর রহমান মুবারকপুরী রাহি. এর বক্তব্য নিয়ে পর্যালোচনা করি। তিনি লিখেন-

(وفي الباب عن أبي بكر الصديق) أخرجه البزار والبيهقي بإسناد لا بأس به كذا في الترغيب والترهيب للمنذري في باب الترهيب من التهاجر.
অর্থাৎ লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান সংক্রান্ত আয়েশা রাযি. এর হাদীস ছাড়াও আবু বকর সিদ্দিক রাযি. থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিজি রাহি. এর এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুবারকপুরি রাহি. লিখেন, আবু বকর রাযি. এর হাদিসটি ইমাম বাযযার রাহি. এবং ইমাম বায়হাকি রাহি. তাখরিজ করেছেন। হাদিসের সনদে কোন সমস্যা নেই। এমনটি ইমাম মুনজিরি রাহি. “আত তারগীব ওয়াত তারহীব” এ বলেছেন।

এরপর মুবারকপুরি রাহি. বলেন:
اعلم أنه قد ورد في فضيلة ليلة النصف من شعبان عدة أحاديث مجموعها يدل على أن لها أصلاً، فمنها
অর্থাৎ লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান এর ফজিলত সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সমষ্টিগতভাবে সবগুলো হাদিস এ কথা প্রমাণ করেন যে, এ রাতের ফজিলতের ভিত্তি ইসলামী শরিয়তে রয়েছে। এরপর মুবারকপুরি রাহি. সবগুলো হাদিস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

বিস্তারিত আলোচনা করার পর তিনি বলেন;
فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شيء والله تعالى أعلم.
অর্থাৎ এ সমস্ত হাদীস সমষ্টিগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে দলিল, যারা বলে থাকে যে লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান এর কোন ভিত্তি নেই।- বিস্তারিত দেখুন তুহফাতুল আহওয়াযী: ৫/৪০০-৪০৩।

এখানে প্রথম বিষয় লক্ষণীয় যে, মুবারকপুরি রাহি. প্রথমে আবু বকর রাযি. এর হাদিসের ব্যাপারে ইমাম মুনযিরি রাহি. এর বক্তব্য সমর্থন করেছেন। কোন আপত্তি করেন নি। এরপর হাদীসগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে বলেছেন যে, এ রাতের ভিত্তি আছে।

এবার আমরা আলবানি রাহি. এর বক্তব্য দেখব। আলবানি রাহি. এর বক্তব্য তার লিখিত বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে। আমরা আজ শুধু একটি বক্তব্য নিয়ে পর্যালোচনা করব। তিনি বলেনÑ
” يطلع الله تبارك و تعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان ، فيغفر لجميع خلقهإلا لمشرك أو مشاحن ” .
حديث صحيح ، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة و أبي بكر الصديق و عوف ابن مالك و عائشة .
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা শা’বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে পুরো সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। মুুশরিক এবং বি*দ্বে*ষ লালনকারী ছাড়া সকলকে আল্লাহ এ রাতে মাফ করে দেন।
হাদিসটি সহিহ। এ হাদিসটি সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর এক জামাত থেকে ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। একটির কারণে অপরটি শক্তিশালী হয়ে গেছে। এ রাতের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে মুয়াজ বিন জাবাল রাযি. থেকে, আবু ছা’লাবা খুশানী রাযি. থেকে, আবদুল্লাহ বিন আমর রাযি. থেকে, আবু মুসা আশআরি রাযি. থেকে, আবু হুরায়রা রাযি. থেকে, আবু বকর সিদ্দিক রাযি. থেকে, আউফ বিন মালিক রাযি. থেকে, আয়েশা রাযি. থেকে। সিলসিলা সাহীহা: ১১৪৪

আমরা দেখতে পেলাম যে, যে আলবানি রাহি. এবং মুবারকপুরি রাহি. একই মূলনীতির আলোকে এ রাতের ফজিলত সংক্রান্ত হাদিসকে সহিহ বলেছেন। মূলনীতি হলো, এক দল সাহাবায়ে কেরাম থেকে ভিন্ন ভিন্ন সনদে হাদিসটি বর্ণিত হওয়ার কারণে এটি উম্মাহর ১৪ বছরের স্বীকৃত মূলনীতি অনুযায়ী সহিহ।

এ মূলনীতির আলোকে আলবানি রাহি. এবং মুবাপরকপুরি রাহি. যে লাইলাতুন নিসফি শা’বান এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এ হাদিসকে সহিহ বলেছেন, ব্যপারটি এমন নয়। বরং অস্যং হাদিসকে এ মূলনীতির আলোকে সহহি বলেছেন। উদাহরণস্বরুপ কয়েকটি উপমা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

মুবারাকপুরি রাহি. এর বক্তব্য আগে আমরা দেখব। তিনি এক হাদিস নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেনÑ
أحاديث هذا الباب كثيرة يشد بعضها بعضا فمجموعها يدل أن لها أصلاً، قال الحافظ ابن حجر والظاهر أن مجموع الأحاديث يحدث منها قوة تدل على أن له أصلاً،
অর্থাৎ এ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীস অনেক। একটির কারণে অপরটি শক্তিশালী হয়ে যায়। সমষ্টিগতভাবে হাদীসগুলো এটা প্রমাণ করে যে এর ভিত্তি আছে। তুহফাতুল আহওয়াযী: ১/১০১।

আরেক জায়গায় বলেন-
وقد ورد فيه كثير من الأحاديث المرفوعة حقيقة، وهي إن كانت ضعافاً ولكن يشد بعضها بعضاً.
অর্থাৎ এ সংক্রান্ত আরও মারফু’ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সনদের দিক থেকে যদিও দুর্বল, কিন্তু একটির কারণে অপরটি শক্তিশালী হয়েছে।Ñ তুহফাতুল আহওয়াযী: ৫/৭১।

আরও অসংখ্য উদাহরণ দেখানো যাবে। উদাহারণস্বরুপ আমি দুইটি উল্লেখ করলাম। তালাশ করলে আরও বহু পাওয়া যাবে।

এবার আসি আলবানি রাহি. এর কিতাবে। একটি মজার কথা বলি, যে মূলনীতির আলোকে আলবানি রাহি. লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান এর হাদিসকে সহিহ বলেছেন, একই মূলনীতির আলোকে তিনি বুকের উপর হাত বাধার হাদিসকে সহিহ বলেছেন! আসুন, আমরা আলবানি রাহি. এর বক্তব্য আগে পড়ি। তিনি বলেন-
إسناده ضعيف لأن مؤملا وهو ابن اسماعيل سيئ الحفظ لكن الحديث صحيح جاء من طرق أخرى بمعناه وفي الوضع على الصدر أحاديث تشهد له
অর্থাৎ বুকের উপর হাত বাধার হাদিস সনদের দিক থেকে দুর্বল। কারণ, এ হাদিসের একজন বর্ণনাকারী হলেন মুআম্মাল বিন ইসমাইল। তার স্মৃতি শক্তিতে বিভ্রাট আছে। কিন্তু হাদিসটি সহিহ। কারণ, ভাবার্থ অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া বুকের উপর হাত বাধার কিছু হাদিস এ বর্ণনার পক্ষে রয়েছে।- সহিহ ইবনে খুজাইমার টীকা: ৪৭৯।

বাংলাদেশের লা মাজহাবিরা বুকের উপর হাত বাধা সংক্রান্ত হাদিস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আলবানি রাহি. এর এ বক্তব্য খুব জোরেশোরে প্রচার করে! যদিও বুকের উপর হাত বাধার পক্ষে সর্বসাকূল্যে দু চারটি চরম আপত্তিকর বর্ণনা পেশ করা যাবে। একই মূলনীতির আলোকে আলবানি কিংবা মুবারকপুরি যখন লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান এর হাদিসকে সহিহ বলেন, তখন বাংলাদেশি লা মাজহাবিদের কাছে আলবানি এং মুবাবরকপুরি থেকেও বড় মুহাক্কিক হলেন আবদুর রাযযাক বিন ইউসুফ এবং মুজাফফার বিন মুহসিন!

আজ পবিত্র মুক্তির রাত। আসুন, ইবাদাত বন্দেগীতে আজকের রাত কাটাই।

 

 

 

 

 

Check Also

ইসতিশরাক তথা প্রাচ্যবিদ্যা: প্রাচ্যবিদ কারা?

ড. ফাতহুল্লাহ জিয়াদি এ ব্যাপারে তুলনামূলক তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। তিনি ইসতিশরাক তথা প্রাচ্যবিদ্যার অনেকগুলো সংজ্ঞা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *