জানাজার নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত, কিছু কথা

একজন মুসলমান মারা যাওয়ার পর তাঁর সাথে সর্বোচ্চ ভালো আচরণ হলো তার জন্য দোয়া করা। যখন ইচ্ছা, একা একা তার জন্য দোয়া করা। বিষয়টি নস দ্বারা প্রমাণিত। দাফনের পূর্বে মায়্যিতের অভিভাবকরা তাকে গোসল দিবেন। তারপর কাফন পরিধান করাবেন। এরপর তাকে সামনে নিয়ে সম্মিলিতভাবে দাড়িয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তাঁর মাগফিরাতের দোয়া করা এবং তাকে আল্লাহর হাওয়ালা করার নাম হলো জানাজা। সে সময়ে দোয়ার যে সর্বোচ্চ পন্থা আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, সেটার পর আর বিশেষ কোন দোয়ার প্রয়োজন নেই। এছাড়া হাদিসেও এমন কোনো দোয়ার কথা পাওয়া যায় না। কিয়াসও সমর্থন করে না। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন এবং মুজতাহিদ ইমামদের যুগে জানাযার পর সাথে সাথে আবার সম্মিলিত দোয়া করার এমন পদ্ধতি পাওয়া যায় না। এজন্য ফুকাহায়ে কেরাম স্পষ্টভাবে এমন দোয়া করা থেকে নিষেধ করেছেন।
হানাফি মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল কুনয়াহ’-তে বলা হয়েছে-
“لا يقوم الرجل بالدعاء بعد صلوة الجنازة”
অর্থাৎ জানাজার পর দোয়ার জন্য দাড়াবে না।
‘ফতোয়া সিরাজিয়া’তে বলা হয়েছে-
“إذا فرغ من الصلوة لايقوم بالدعاء”
অর্থাৎ যখন জানাযার নামায শেষ করবে, তখন দোয়ার জন্য আবার দাড়াবেনা। (ফতোয়া সিরাজিয়্যাহ, পৃষ্টা নং ১৩৩, মাকতাবা থানভী, দেওবন্দ।)
‘ফতোয়া বাযযাযিয়্যাহ’-তে আছে-
” لا يقوم بالدعاء بعد صلوة الجنازة. لأنه دعاء مرة”
অর্থাৎ জানাজার পর দোয়া করবে না। কেননা মৃতের জন্য সম্মিলিত মোনাজাত হলো একবার।( ফতোয়া বাযযাযিয়্যাহ, ১/৫৪ মাকতাবাতুল ইত্তেহাদ।)
মোল্লা আলী রহ. বলেন-
ولا يدعو للميت بعد صلاة الجنازة لأنه يشبه الزيادة في صلاة الجنازة
অর্থাৎ জানাযার পর দোয়া করবেনা। কেননা এর দ্বারা জানাযার নামায বৃদ্ধি করার মতো হয়ে যায়।
হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল বাহরুর রায়েক’-এ আছে-
لا يدعو بعد التسليم
অর্থাৎ সালামের পর আর দোয়া করবে না।( মিরকাত, ৫/৪৩১)
এমনিভাবে ‘জামিউর রুমুয’ নামক কিতাবে বলা হয়েছে-
“জানাযার পর আর কোন সম্মিলিত মোনাজাত নেই। এমনটা রয়েছে অধিকাংশ কিতাবে”।
কিন্তু কিছু লোক এ দোয়াকে জায়েজ বলেন এবং নিম্নের হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
” إذا صليتم على الميت فأخلصوا له الدعاء ” .
অর্থাৎ তোমরা যখন মায়্যিতের জানাজার নামায পড়বে, তখন তাঁর জন্য ইখলাসের সাথে দোয়া করো।( আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১৯৯, শায়খ মুহি উদ্দীন আবদুল হামিদ তাহকিককৃত। সহীহ ইবনে হিব্বান, ৩০৭৬, শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকিককৃত)
কিন্তু এ হাদিস দ্বারা জানাজার পরের দোয়া উদ্দেশ্য নেওয়া ভুল। কেননা এ হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন যে, যখন তোমরা মায়্যিতের জন্য জানাজার নামায পড়বে, তখন ইখলাসের সাথে তার জন্য দোয়া করো। এছাড়া রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। তিনি মৃত ব্যক্তির জন্য এতটা বিনয়াবনত হয়ে ইখলাসের সাথে জানাজা পড়তেন যে, সাহাবারা আফসোস করতেন যদি এ জানাযা আমার হত! এ উদ্দেশ্য নয় যে, নামাজ যেভাবে ইচ্ছা পড়ে নাও, তারপর ইখলাসের সাথে দোয়া করো। সাহাবায়ে কেরাম, মুজতাহিদ ইমামগণ এবং ফুকাহায়ে কেরাম এ অর্থই বুঝেছেন। এজন্য তারা জানাযার পর দোয়া করেননি এবং স্পষ্ট নিষেধ করেছেন।
এছাড়া তারা আবদুল্লাহ বিন আবি আউফা রা. এর একটি হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করেন। দীর্ঘ হাদিসের শেষাংশ হলো,
ثُمَّ صَلَّى عَلَيْهَا وَكَبَّرَ أَرْبَعًا فَقَامَ بَعْدَ التَّكْبِيرَةِ الرَّابِعَةِ كقَدْرِ مَا بَيْنَ التَّكْبِيرَتَيْنِ يَسْتَغْفِرُ لَهَا وَيَدْعُو ، ثُمَّ قَالَ : كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَصْنَعُ هَكَذَا.
অর্থাৎ আবদুল্লাহ বিন আউফ রা. তার মেয়ের জানাযার নামায পড়লেন চার তাকবিরে। চার তাকবিরের পর দাড়ালেন। মেয়ের জন্য ইসতেগফার এবং দোয়া করলেন।
এরপর বললেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমনটা করতে দেখেছি।( আস সুনানুল কুবরা, বায়হাকী, হাদিস নং ৭২৩২, মাজলিসু দায়িরাতিল মাআরিফ, হায়দারাবাদ।)
এ হাদিস দ্বারা কয়েকটি কারণে দলীল পেশ করা ঠিক নয়। কারণ এ হাদিসের সনদের ব্যাপারে কথা রয়েছে। এছাড়া এ হাদিস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চতুর্থ তাকবির এবং সালামের মধ্যখানে দোয়া। যেমনটা কিছু রেওয়ায়াতে রয়েছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটা করেছেন। শাফেয়ি মাযহাবের অনুসারিরা এটার উপর আমল করেন। হানাফিরা এমনটা করেন না এবং এর প্রবক্তাও নয়। খোদ ইমাম বায়হাকি রহ. এ হাদিসের উপর অধ্যায় প্রতিষ্টা করেছেন এভাবে-
باب مَا رُوِىَ فِى الاِسْتِغْفَارِ لِلْمَيِّتِ وَالدُّعَاءِ لَهُ مَا بَيْنَ التَّكْبِيرَةِ الرَّابِعَةِ وَالسَّلاَمِ
অর্থাৎ এ অধ্যায় হলো চতুর্থ তাকবির এবং সালামের মধ্যখানে মায়্যিতের জন্য দোয়া এবং ইসতিগফার প্রসঙ্গে। এজন্য এ হাদিস দ্বারা জানাজার পরের দোয়া উদ্দেশ্য নেওয়া ভুল।
তারা আরেকটি ব্যাখ্যা করে যে, ফুকাহায়ে কেরাম কাতারে দাড়িয়ে দোয়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু কাতার ভেঙ্গে অথবা বসে দোয়া করতে সমস্যা নাই। কিন্তু আমরা পূর্বে ‘আল বাহরুর রায়েক’ এর স্পষ্ট ইবারত দেখেছি যে, ফুকাহাগণ সালামের পর দোয়া করতে নিষেধ করেছেন। চাই সেটা যেভাবেই হোক।
আল্লাহ তায়ালা এমন বেদায়াত আমল থেকে আমাদের সকলকে রক্ষা করুন।

Check Also

হিজবুত তাওহীদ, ঈমান বিধ্বংসী একটি দলের নাম (১)

বায়েযীদ খান পন্নী। হিজবুত তাওহীদের প্রতিষ্ঠাতা। তার দাবি অনুযায়ী তিনি এ যুগের মুজাদ্দিদ। সাহাবাদের পরে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *