নামাজে হাত বাধব কোথায়? নাভীর নিচে হাত বাধার কী দলিল নেই?

নামাজে হাত বাধব কোথায়?

রেজাউল কারীম আবরার
এ মাসআলা নিয়ে বর্তমানে আমাদের সমাজে তুমুল আলোচনা- সমালোচনা তৈরী হয়েছে। নতুন কিছু ভাই বলাবলি শুরু করেছেন যে, হাজার বছর থেকে চলে আসা আমাদের দেশের মানুষের নামাজে নাভীর নিচে হাত বাধা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়! অনেক আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে এটাকে জাল বলে দিচ্ছেন! প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে এ ধরণের বক্তব্যে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে। আমরা এ মাসআলা নিয়ে মৌলিক কিছু আলোচনা করব।

সাহাবায়ে কেরাম হাত বাধতেন কোথায়?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সরাসরি নামাজ পড়তে দেখেছেন সাহাবায়ে কেরাম। তারা ভালভাবে অবলোকন করেছেন যে, নামাজে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় হাত বাধতেন? এবার আসুন, আমরা দেখি নামাজে সাহাবায়ে কেরাম হাত বাধতেন কোথায়?

এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম তিরমিজি রাহি. বলেন:
وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالتَّابِعِينَ، وَمَنْ بَعْدَهُمْ، يَرَوْنَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلَاةِ، وَرَأَى بَعْضُهُمْ أَنْ يَضَعَهُمَا فَوْقَ السُّرَّةِ، وَرَأَى بَعْضُهُمْ: أَنْ يَضَعَهُمَا تَحْتَ السُّرَّةِ، وَكُلُّ ذَلِكَ وَاسِعٌ عِنْدَهُمْ
অর্থাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আলেম সাহাবি, তাবেয়ি এবং পরবর্তীদের বক্তব্য হলো, নামাজে মানুষ ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখবে৷ কেউ বলেন, নাভির নিচে রাখবে, কেউ বলেন, নাভির উপরে রাখবে৷ উভয়টিই তাদের নিকট আমলযোগ্য৷ তিরমিজি: হাদীস নং ২৫২, আহমদ শাকের তাহকিককৃত।

ইমাম তিরমিজি রাহি. এর বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িদের মাঝে নামাজে হাত বাধব কোথায়? সেটা নিয়ে মতভিন্নতা ছিল। এ ক্ষেত্রে তাদের মাঝে দুটি দল ছিল। একদল সাহাবা এবং তাবেয়িনদের মতে নামাজে হাত বাধবে নাভীর নিচে। আরেকদল সাহাবা এবং তাবেয়িদের মতে নামাজে হাত বাধবে নাভীর উপরে।
ইমাম তিরমিজি রাহি. পরে উভয় মতের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করছেন। তিনি বলছেন, উভয় মতই বিশুদ্ধ। নামাজে নাভীর উপরেও হাত বাধা যাবে, আবার নাভীর নিচেও হাত বাধা যাবে।

ইমাম তিরমিজি রাহি. এর বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় আমাদের খেয়াল করতে হবে। প্রথমত, ইমাম তিরমিজি রাহি. এর বক্তব্য অনুসারে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িনদের একটি দলের আমল ছিল নাভীর নিচে হাত বাধা। আজকে যারা অপপ্রচার করেন যে, নাভীর নিচে হাত বাধা জাল, তারা কী একদল সাহাবায়ে কেরামের আমলকে জাল বলবেন? সাহাবায়ে কেরাম কী তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহিহ হাদিসের উপর আমল করতে পারেন নি? আপনারা ১৪ বছর পরে এসে সাহাবায়ে কেরাম থেকে বেশি সহিহ হাদিস শিখে ফেলেছেন? নাউযুবিল্লাহ! কোন আমলকে জাল বলার আগে অন্তত একবার চিন্তা করা উচিত যে, কাদের আমলকে আমরা জাল বলছি?

দ্বিতীয় বিষয় হলো, হাত কোথায় বাধব? এ সংক্রান্ত সাহাবা এবং তাবেয়িনদের মতামত উল্লেখ করতে গিয়ে ইমাম তিরমিজি রাহি. বুকের উপর হাত বাধার কোন মতামত উল্লেখ করেন নি। বুঝা গেলো, সাহাবা এবং তাবেয়িনদের মাঝে কেউই নামাজে বুকের উপর হাত বাধেন নি। যদি তারা বাধতেন বা কারও মত হতো, তাহলে অবশ্যই সেটা ইমাম তিরমিজি রাহি. উল্লেখ করতেন।
আপনি আপনার বিবেককে এবার জিজ্ঞাসা করুন! যে আমল কোন সাহাবা করেন নি, সে আমল হয়ে যায় সবচেয়ে বিশুদ্ধ! আর যে আমল সাহাবায়ে কেরামের একটি দল করেছেন, সেটা হয়ে যায় জাল!

এবার আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, ইমাম তিরমিজি রাহি. এর বক্তব্য অনুযায়ী সাহাবা এবং তাবেয়িনদের যুগে বুকের উপর হাত বাধার কোন মাজহাব ছিল না। প্রশ্ন হলো, তাহলে বুকের উপর হাত বাধা শুরু হলো কখন?

এ প্রশ্নের জবাব যারা বুকের উপর হাত বাধেন, তাদের ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানি রাহি. থেকে নেবো। তিনি এ সংক্রান্ত আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
وأسعد الناس بهذه السنة الصحيحة الإمام إسحاق بن راهويه , فقد ذكر المروزى فى ” المسائل ” (ص ২২২) : ” كان إسحاق يوترُ بنا … ويرفع يديه فى القنوت ويقنت قبل الركوع , ويضع يديه على ثدييه , أو تحت الثديين ”
বুকের উপর হাত বাধার সহিহ সুন্নতের উপর আমল করে সর্বাধিক সৌভাগ্যবান লোক হলেন ইসহাক বিন রাহুয়াহ রাহি.৷ মারওয়াজি রাহি. “আল মাসায়েল” এ উল্লেখ করেছেন, তিনি আমাদের নিয়ে বিতির পড়তেন৷ কুনুত পড়ার সময় তিনি হাত তুলতেন এবং রুকুর পূর্বে দোয়া কুনুত পড়তেন৷ কুনুত পড়াবস্থায় তিনি বুকের উপর হাত রাখতেন অথবা নিচে৷ ইরওয়াউল গালিল: ২/৭১।

আলবানি রাহি. এর বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, বুকের উপর হাত বাধার সুন্নাতের উপর আমলকারী সর্বাধিক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হলেন ইসহাক বিন রাহুয়াহ। আমাদের মনে রাখতে হবে ইসহাক বিন রাহুয়াহ রাহি. ইন্তেকাল করেছেন ২৩৮ হিজরিতে। তিনি বুকের উপর হাত বাধার পক্ষে কোন সাহাবা কিংবা কোন তাবেয়ীর নাম উল্লেখ করতে পারেন নি।
আলবানি রাহি. এর বক্তব্য সামনে রাখলেই আমরা বুঝতে পারি যে, ইসহাক বিন রাহুয়াহ মূলত নামাজে বুকের উপর হাত বাধতেন না। বরং বিতরের নামাজে যখন দোয়ায়ে কুনুত পড়তেন, তখন হাত তুলে দোয়া করার সময় বুকের উপর হাত উঠত!
ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহি. নিজে নামাজে নাভীর নিচে হাত বাধতেন। তিনি বলতেন: “নাভীর নিচে হাত বাধার হাদীস অধিক শক্তিশালী এবং বিনয়ের অধিক নিকটবর্তী।” আল মাসায়েল:৩৫৪৭।

নাভীর নিচে হাত বাধার দলিল
১.ওয়াইল বিন হুজর রাযি. বর্ণনা করেন:
رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَضَعَ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
অর্থাৎ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি যে, তিনি নামাজে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নিচে বাধতেন। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৯৫৯।

এ হাদিস সম্পর্কে হাফিজ কাসিম বিন কুতলুবুগা রাহি. বলেন:
هذا سند جيد
অর্থাৎ এটি উত্তম সনদ। আল ইখতিয়ার লি তা’লিল মুখতার, মুসন্নাফের টীকা: ৩৯৫৯।
আবু তায়্যিব সিন্ধি রাহি. বলেন:
هذا حديث قوي من حيث السند
অর্থাৎ সনদের দিক থেকে এটি শক্তিশালী বর্ণনা।
আবিদ সিন্ধি রাহি. বলেন:
رجاله كلهم ثقات أثبات
অর্থাৎ বর্ণনাকারী প্রত্যেকেই বিশ্বস্ত এবং গ্রহণযোগ্য। শারহুত তিরমিজি: ২/৪৩২।

২. আমিরুল মুমিনিন আলী রাযি. বর্ণনা করেন:
السُّنَّةُ وَضْعُ الْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
অর্থাৎ সুন্নাত হলো: নামাজে এক হাতের তালুর উপর অপর হাতের তালু রেখে নাভীর নিচে বাধবে। আবু দাউদ: ৭৫৬, মুসনাদে আহমদ: ৮৭৫, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৯৬৬।

এ হাদীস সম্পর্কে হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহি. বলেন:
حَدِيث إِن من السّنة وضع الْيَمين عَلَى الشمَال تَحت السُّرَّة أَبُو دَاوُد من طَرِيق أبي جُحَيْفَة عَن عَلّي قَالَ السّنة وضع الْكَفّ عَلَى الْكَفّ تَحت السُّرَّة وَإِسْنَاده ضَعِيف
অর্থাৎ আলী রাযি. থেকে নামাজে নাভীর নিচে হাত বাধা সংক্রান্ত বর্ণনাটি হলো জয়িফ তথা দুর্বল। আদ দিরায়া ফি তাখরিজি আহাদিসিল হিদায়া: ১/১২৮।

সনদের দিক থেকে যদিও এ হাদীসটি দুর্বল, কিন্তু এ হাদীসের বক্তব্য পূর্বের সহিহ হাদীস দ্বারা শক্তিশালী হয়ে যায়।

৩. আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন:
أَخْذُ الأَكُفِّ عَلَى الأَكُفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ
অর্থাৎ নামাজে এক হাতের তালু উপর হাতের হাতের তালুর উপর রেখে নাভীর নিচে হাত বাধবে। আবু দাউদ: ৭৫৮।

এ হাদীস বর্ণনা করার পর ইমাম আবু দাউদ রাহি. বলেন:
سَمِعْتُ أَحْمَدَ بْنَ حَنْبَلٍ يُضَعِّفُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ إِسْحَاقَ الْكُوفِىَّ
অর্থাৎ এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আবদুর রহমান বিন ইসহাককে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল জয়িফ তথা দুর্বল বলেছেন।

৪. হাজ্জাজ বিন আবু হাসসান বর্ণনা করেন:
سَمِعْتُ أَبَا مِجْلَزٍ ، أَوْ سَأَلْتُهُ ، قَالَ : قُلْتُ : كَيْفَ أَصْنَعُ ؟ قَالَ : يَضَعُ بَاطِنَ كَفِّ يَمِينِهِ عَلَى ظَاهِرِ كَفِّ شِمَالِهِ ، وَيَجْعَلُهَا أَسْفَلَ مِنَ السُّرَّةِ.

অর্থাৎ আমি আবু মিজলাযকে বলতে শুনেছি, অথবা আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নামাজে কীভাবে হাত বাধব? তিনি বললেন: ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠে রেখে হাত নাভীর নিচে বাঁধবে। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৯৬৩।
এ বর্ণনার সনদ সহিহ।

বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রাহি. বলেন:
يَضَعُ يَمِينَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِي الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
অর্থাৎ নামাজে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নিচে বাধবে। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৯৬০।

নাভীর নিচে হাত বাধার পক্ষে আমরা কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করলাম। এর দ্বারা আশা করি পাঠকের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, নাভীর নিচে হাত বাধা সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সে হাদীসের আলোকেই সাহাবায়ে কেরামের একটি দল নামাজে নাভীর নিচে হাত বাধতেন।

 

Check Also

ইসতিশরাক তথা প্রাচ্যবিদ্যা: প্রাচ্যবিদ কারা?

ড. ফাতহুল্লাহ জিয়াদি এ ব্যাপারে তুলনামূলক তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। তিনি ইসতিশরাক তথা প্রাচ্যবিদ্যার অনেকগুলো সংজ্ঞা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *