মুআবিয়া রাযি. কী হাসান রাযি. কে বিষপান করিয়ে ছিলেন?

মুআবিয়া রাযি. কী হাসান রাযি. কে বিষপান করিয়ে ছিলেন?

কিছু কিছু বর্ণনায় রয়েছে, হাসান রা.-কে পান করানো বিষের ক্রিয়ায় তিনি ইনতেকাল করেছেন। এ ব্যাপারে হাসান রা.-এর স্ত্রী জা’দা বিনতে কায়স আশআসের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলা হয়। উম্মে মুসা হাসান রা.-কে বিষ পানের বিষয়ে জা’দাকে অভিযুক্ত করেছেন। সে বিষ পানের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে ছিলেন। ৪০ দিন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত থেকে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। আত তাবকাতুল কুবরা: ১/৩৩৮।

 

এ বর্ণনার সনদ সহিহ নয়; বরং জয়িফ তথা দুর্বল। কিছূ ইতিহাসবিদ ইয়াজিদের বায়আত গ্রহণ এবং মুআবিয়ার বিষ পানের মাঝে সম্পর্ক খুঁজে বের করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা ধারণা করেন ইয়াজিদ জাদা এর নিকট সংবাদ প্রেরণ করেছিল এবং বলেছিল, তুমি তাঁকে বিষ পান করাও। আমি তোমাকে বিবাহ করব। সে তাঁকে বিষ পান করাল। কার্যসিদ্ধির পর সে ইয়াজিদের নিকট তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণের কথা বললেন। সে বলল, আমি তোমাকে হাসানের জন্য পছন্দ করিনি। আমার জন্য কীভাবে পছন্দ করব? আত তাবকাতুল কুবরা: ১/৩৩৮।

 

এ বর্ণনার সনদে ইয়াজিদ বিন জিয়াদ নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। ইমাম মালেক-সহ অন্যান্যরা তাঁকে মিথ্যুক বলেছেন। তাহজিবুল কামাল: ৬/৪৫৩।

 

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআতের কিছু বইয়ে কোনো ধরনের তাহকিক ছাড়া বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও তাঁরা জানেন যে, এর সনদে দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছে। তাকরিবুত তাহজিব: ৬০৪।

* ইবনুল আরাবি রাহ. বলেন,

‘যদি বলা হয় ইয়াজিদ হুসাইন রা.-কে বিষ পান করিয়েছে, আমরা বলব, দুটি কারণে এটা অসম্ভব। প্রথমত হাসান রা. থেকে তাঁর কোনো অনিষ্টতার সম্ভাবনা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এটা একটি গোপন বিষয়। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বাস্তবতা জানে না। সুতরাং কোনো ধরনের দলিল ছাড়া আপনি দূরবর্তী যুগের হয়ে আরেকজনকে অভিযুক্ত করতে পারেন? অথচ আমরা কোনো গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী পাই না। এ ছাড়া যুগ ছিল ফিতনা এবং গোত্রপ্রীতির, এ জন্য নিজেদের স্বার্থের জন্য অনেকে অনেক কিছু ভুল সম্বন্ধ করে দিত। সুতরাং গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তির সংবাদ ছাড়া অন্য কারও বর্ণনা গ্রহণ করা যাবে না।’ আল আওয়াসিম ওয়া কাওয়াসিম: ২২৩।

 

* শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন,

‘কেউ কেউ উল্লেখ করেন, মুআবিয়া রা. হাসান রা.-কে বিষ পান করিয়েছেন। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত নয়। দৃঢ়তার সঙ্গে কেউ বর্ণনা করেননি। এ ছাড়া বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। এটা কোনো ধরনের ইলম ছাড়া একটি কথা।’ মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ: ৪/৪৬৯।

 

হাসান রা.-কে মদপানের বিষয়ে মুআবিয়া রা.-কে যারা অভিযুক্ত করেন। তাঁদের দাবি মতে মুআবিয়া রা. কেউ কেউ আশআছ বিন কায়সের মাধ্যমে হাসান রা.-কে বিষপান করিয়েছেন।। কারণ, তাঁর মেয়ে ছিলেন হাসান রা. স্ত্রী। এ ধারণার খণ্ডন করে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহি. বলেন,

‘যদি বলা হয় যে, মুআবিয়া রা. তাঁকে বিষ পানের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাহলে এটা শুধুমাত্র ধারণা। আর ধারণা কখনো সত্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয় না। রাসুল সা. বলেন, ‘তোমরা ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কারণ, ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা।’ দ্বিতীয়ত, আশআস বিন কায়স ৪০ হিজরিতে ইনতেকাল করেছেন। কেউ বলেছেন ৪১ হিজরিতে। এ জন্য হাসান এবং আলি রা.-এর মধ্যকার সন্ধির মাঝে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়নি। যদি তিনি উপস্থিত থাকতেন, তাহলে তাঁর কথা উল্লেখ করা হতো। হাসান রা.-এর দশ বছর পূর্বে তিনি ইনতেকাল করেছেন। তাহলে তিনি কীভাবে তাঁর কন্যাকে নির্দেশ দিলেন?’ আল মুনতাকা মিন মিনহাজিল এতেদাল: ২৬৬।

* ইমাম জাহাবি রাহ. বলেন,

‘যারা এ শাস্ত সম্পর্কে অবগত, তাঁদের মতে এ বর্ণনা সঠিক নয়। যারা মুআবিয়া রা.-কে অভিযুক্ত করে, তাহলে বিষপানের বিষয়টি জানল কীভাবে?’ তারিখুল ইসলাম: ৫০।

 

* ইবনে কাসির রাহ. বলেন,

‘কেউ কেউ বর্ণনা করেন, ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়া হাসান রা.-কে বিষ পান করানোর জন্য জা’দার নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন। পরে আমি তোমাকে বিবাহ করব। আমার মতে এ ঘটনা সঠিক নয়। আর তাঁর পিতা মুআবিয়া রা. থেকে এমনটা করা কষ্মিনকালেও সম্ভব নয়।’ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/৪৩।

* ইবনে খালদুন রাহ. বলেন,

‘জাদা কে দিয়ে মুআবিয়া রা. হাসান রা.-কে বিষ পান করানোর কথা কেউ কেউ বর্ণনা করেন। এ গল্প বানিয়েছে শিয়ারা বানিয়েছে। মুআবিয়া রা.-এর সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।’ তারিখে ইবনে খালদুন: ২/৫২৭।

ড. জামিল মিশরি বলেন,

‘মুআবিয়া রা. বা ইয়াজিদ কর্তৃক হাসান রা.-কে বিষপান করানোর বিষয়টি বাহ্যিকভাবে এমন মনে হয় যে, মুআবিয়া রা. তখনো প্রসিদ্ধিলাভ করেননি। হাসান রা.-এর সাথে মুআবিয়া রা.-এর কোনো শত্রুতা ছিল না। এমনভাবে হাসান রা.-এর মৃত্যুর পরও হুসাইন রা. মুআবিয়া রা.-কে অভিযুক্ত করেননি।’ আছারু আহলিল কিতাবি ফিল ফিতানি ওয়াল হুরুবিল আহলিয়্যাহ: ৪৮২।

 

হাসান রা. বিষ পানে ইনতেকাল করেছেন এটা আমরা অস্বীকার করব না। এটা যখন প্রমাণিত, তখন আমরা বলব এটা শহিদি মৃত্যু। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে পুরস্কার।

মুআবিয়া রা. এবং তাঁর ছেলেকে অভিযুক্ত করার বিষয়টি সনদ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বাকি থাকল জা’দা বিনতে আশআস এর কথা। তাঁর কী মালের প্রয়োজন ছিল যে, তিনি ইয়াজিদের আগ্রহ বাস্তবায়ন করবেন? তিনি কিনদা গোত্রের সর্দারের মেয়ে হওয়া কী সম্মানের জন্য যথেষ্ট নয়? এ ছাড়া তাঁর স্বামী হাসান রা. কি অন্যান্য মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়? হাসান রা.-এর মা হলেন রাসুল সা. এর কন্যা ফাতেমা রা.। নানা হলেন স্বয়ং রাসুল সা.। গর্বের জন্য এটাই যথেষ্ট। তাঁর পিতা হলেন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের একজন আলি রা.। খুলাফায়ে রাশেদিনের একজন। তাহলে কী কারণে তিনি হাসান রা.-কে বিষ পান করাতে যাবেন?

আমি বলব, সে সময় মুসলমানদের একতার বিরুদ্ধাচারণকারী অনেক শত্রু ছিল। হাসান বিন আলি রা.-এর কারণে তাঁদের ক্রোধ আরও বেড়েছিল। কারণ, তাঁর অস্তিত্ব মুলসমানদের অনেক বড় শক্তি ছিল। সুতরাং ফিতনা সৃষ্টি করতে হলে তাঁকে সরাতে হবে আগে। সুতরাং প্রথম অভিযুক্ত হলো, আবদুল্লাহ বিন সাবার অনুসারি সাবাঈ রা। মুআবিয়া রা.-এর সঙ্গে সন্ধি করার পর হাসান রা. তাঁদের শাস্তি প্রদান করেছিলেন। এরপর অভিযুক্ত হলো খারেজিরা, যারা আলি রা.-কে হত্যা করেছিল। তাঁর তার উরুতে আঘাত করেছিল।

 

Check Also

জানাজার নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত, কিছু কথা

একজন মুসলমান মারা যাওয়ার পর তাঁর সাথে সর্বোচ্চ ভালো আচরণ হলো তার জন্য দোয়া করা। …

One comment

  1. জাযাকাল্লাহ খায়ের

Leave a Reply to MD.NURUL ISLAM Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *