মধ্যযুগীয় ইউরোপের অগ্রযাত্রায় স্পেনই ছিল পথ প্রদর্শকের ভূমিকায়। স্পেন তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বে’িত। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে জিব্রাল্টার (জাবালুত তারিক) প্রণালী ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর স্পেন আফ্রিকার সাথে ইউরোপ মহাদেশের যোগসূত্র রচনা করে। স্পেনের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমের উপকূল পর্বতমালা দ্বারা আবৃত থাকলেও এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তারাগোনা, কাসটেলন ভ্যালেন্সিয়া প্রভৃতি সমদ্ধৃশালী সমুদ্রপথ ছিল।
সিউটার গভর্ণর কাউন্ট জুলিয়ান ও উত্তর আফ্রিকার স্পেনীয় উদ্বাস্তুদের অনুরোধে মুসা বিন নুসাইর স্পেনের প্রাথমিক অবস্থা জরিপের জন্য অধীনস্থ সেনানায়ক তারিক বিন যিয়াদকে ৭১০ খি’াব্দে চারটি যুদ্ধজাহাজে ৪০০ পদাতিক ও ১০০ অশ্বারোহী বার্বার সৈনিকসহ স্পেনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারিক স্পেনে গিয়ে নিজ কাজ সমাধা করে ফিরে আসেন। এসে সংবাদ দেন যে, মুসলমানদের জন্য স্পেন বিজয়ের এখনই উপযুক্ত সময়। চাইলে মুসলমানরা স্পেনে অভিযান পরিচালনা করতে পারে।
স্পেনে দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করা হয় ৭১১ খ্রি’াব্দে। আফ্রিকার শাসনকর্তা ও সামরিক অধিনায়ক মুসা বিন নুসায়র তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে ৭ হাজার বার্বার ও ৩০০ আরব সৈন্যের একটি বাহিনী দ্বিতীয় বারের মতো স্পেন বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেন। পরে আরও বিভিন্ন জায়গা থেকে সৈন্যরা মুসলমানদের বাহিনিতে যোগ দেয়। ফলে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১২ হাজারে পৌঁছে। কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক প্রেরিত চারটি জাহাজে তারিক জিব্রালাটার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করেন। তারিক বিন জিয়াদ যে স্থানে ঘাটি স্থাপন করছিলেন তা আজও জাবালুত তারিক(তারিকের পর্বত)নামে পরিচিত। প্রথমে তিনি ঝড়ের বেগে আন্দালুস তথা স্পেনের দক্ষিণাঞ্চল দখল করেন।
অতঃপর ৭১১ সালের ১৯ জুলাই মূলবাহিনী রডারিকের একলাখ সৈন্যর মোকাবিলা করে মুসলিম বাহিনি। স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রডারিকের বিশাল বাহিনির মুখোমুখি হোন তারিক বিন জিয়াদ। ভরসা ছিলো একমাত্র আল্লাহর উপর। ওয়াদী লাস্কের নিকটবর্তী সারিস বা জেরেখে মুসলিম ও রডারিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ওয়াদী লাস্কের যুদ্ধ নামে পরিচিত। রক্ষক্ষয়ী এবং অবিশ^াস্য সে যুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিজয় দান করেন। এ যুদ্ধ রাজা রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন। এ অভিযানে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজধানী কর্ডোভার এবং মূল রাজধানী টলেডোর পতন ঘটে।
মূসা বিন নুসায়র ৭১২ সালে তারিক বিন জিয়াদের অধিকৃত অঞ্চল ব্যতিরেকে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খ্রিস্টান অধ্যুষিত শহরগুলোর দিকে অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি মাত্র আটারোশত সৈন্য নিয়ে অতি সহজে মেদিনা, সেভিল, মেরিদা দখল করেন। এরপর তারিক ও মূসার সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানে লিও, গ্যালিসিয়া ও মুসলিম অধিকারে আসে, তারপর তারা আরাগানে উপস্থিত হয়ে লিজিও আমিয়া অধিকার করেন। মাত্র দুই বছরে সমগ্র স্পেনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রডারিকের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে স্পেনে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের পর অল্পদিনের মধ্যে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খেলাফতের অধীনে চলে আসে। অবশেষে এভাবে ধারাবহিক ভাবে স্পেনে খলিফাগণ খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এবং ৭৫০ সালে জাবের যুদ্ধের মাধ্যমে আব্বাসীয়দের হাতে উমাইয়াদের পতন হলে, আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে আব্দুর রহমান আদদাখিল নামক এক ব্যক্তি দামেস্ক থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে গিয়ে স্পেনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি অবস্থান করার পর স্বাধীনভাবে আবার উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন, অবশেষে ধারাবাহিকভাবে ১০৩১ খ্রি’াব্দ পর্যন্ত তা চলতে থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হলেও স্পেনে মুসলিম আধিপত্য চলতে থাকে।
এরপর স্পেনের বিভিন্ন শহর পরিণত হয় জ্ঞানের কেন্দ্রভূমিতে। সর্বপ্রথম কর্ডোভার কথা বলতে পারি। ইউরোপিয়ানরা যখন বনে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন কর্ডোভাতেই উঁদিত হয়েছিলো জ্ঞানের রওশন সিতারা। সে সিতারার আলোতে আলোকিত হয়েছে পুরো ইউরোপ। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞান অন্বেষণকারীরা পঙ্গপালের মতো ছুটে আসত কর্ডোভায়।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, একাদশ শতাব্দীতে জ্ঞান বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই কর্ডোভা হয়ে উঠেছিল গোটা বিশ্বের অগ্রণী নগর। ইউরোপের বহু খ্রিস্টান বিদ্যা অর্জনের জন্য পাড়ি জমিয়েছিল এই নগরীতে। তাদের অনেকে পেশাজীবী হিসেবে এই শহরেই বাস করতেন। অনেকে এখান থেকে বিদ্যা আহরণ করে পিরনিজ পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে চলে যান ইউরোপে। তখন তারাই হয়ে যান অবশি’ ইউরোপের মহাজ্ঞানী। পরবর্তী সময়ে ইউরোপের শিল্প, সাহিত্য ও সভ্যতায় সেকালের কর্ডোভার প্রভাব সুস্প’ প্রতিভাত হয়। নগর সভ্যতার এতটা উৎকর্ষ সে কালের আর কোনো নগরীর ভাগ্যে জোটেনি। সে সময় গোটা কর্ডোভায় পাঁচ শতাধিক লাইব্রেরি ছিল। তৎকালীন ইউরোপে গোসলখানাকে হারাম বলে গণ্য করা হত, অথচ কর্ডোভাতে ছিল ৯০০ পাবলিক বাথরুম। দশম শতকে কর্ডোভাতে ছিল ৭০০ মসজিদ। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ১৫৬৭ সালে এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দালুসের মুসলিম শাসনামলে নির্মিত সকল হাম্মাম ( গোসলখানা) ভেঙে দেয়া হয়।
শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান সাধনায় নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও কর্ডোভা ছিল সেকালের রোল মডেল। চামড়া, লোহা, সুতা, রেশম এবং বস্ত্রসহ বহুমুখী উৎপাদনের কেন্দও ছিল এই কর্ডোভা। ইউরোপের বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের কাপড় তৈরি হতো কর্ডোভাতে। কৃষিখাতেও কর্ডোভা ছিল বহু এগিয়ে। সে কালের চাকা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ কাজ পরিচালিত হতো। মরুময় আরবের কঠোর পরিশ্রমী জাতি এখানে সোনার ফসল ফলাতে লাগল। নানা ধরনের সবজি ও ফলফলাদি বেশ সহজেই উৎপাদন হচ্ছিল। এসব উৎপাদন কর্ডোভার অর্থনীতিকে বহুদূর এগিয়ে নিয়েছিল। বিদ্যূত উৎপাদনে বায়ুকলের ব্যবহার গোটা ইউরোপের মাঝে এই ভূখ-েই সর্বপ্রথম হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, মুসলমানরাই অন্ধকার থেকে ইউরোপকে আলোর পথে তুলে এনেছিল। জ্ঞানের সমুদ্রে অবগাহণ করতে তাদের শিখিয়েছে। কিন্তু আজকের ইউরোপিয়ানরা বড়ই অকৃতজ্ঞ এবং নিমকহারাম! মুসলমানদের অবদানের কথা তারা একবারও স্বীকার করতে চায় না। এমনকি মুসলমানদের অবদানকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য বিকৃত ইতিহাস লিখতেও তাদের বিবেক বাধা দেয়নি! মাসিক বেতন দিয়ে, লোক খাটিয়ে শতাব্দির পর শতাব্দি তারা বিকৃত ইতিহাস রচনা করেই চলছে!