ইসতিশরাক তথা প্রাচ্যবিদ্যা: প্রাচ্যবিদ কারা?

ড. ফাতহুল্লাহ জিয়াদি এ ব্যাপারে তুলনামূলক তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন। তিনি ইসতিশরাক তথা প্রাচ্যবিদ্যার অনেকগুলো সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন।

১. প্রাচ্যবিদ্যা অর্থ হলো প্রাচ্য জগত সংক্রান্ত বিদ্যা। ব্যাপক অর্থ হিসাবে ধরলে প্রাচ্যের যে কোনো স্থান, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে যে কোনো পাশ্চাত্যের গবেষণাকে বুঝায়। বিশেষ অর্থ হিসাবে প্রাচ্যবিদ্যা মানে হলো, ইসলামি প্রাচ্য, তার ভাষা, ইতিহাস এবং আকিদা সম্পর্কে পাশ্চাত্য গবেষকদের গবেষণা।

২. আলাদা আলাদাভাবে প্রাচ্যের বিভিন্ন শহর নিয়ে পড়াশুনা করা, একথায় বলতে গেলে মধ্যযুগের তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশকে যারা আলোয় আলোকিত করেছিলেন, তাদের নিয়ে গবেষণা করা। তাদের বিভিন্ন কাজের পর্যালোচনা করা।

৩. প্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতি যেমন, আরবি, ভারতীয়, চায়নিজ নিয়ে, তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি নিয়ে যিনি গবেষণা করেন, তাকে বলা হয় প্রাচ্যবিদ।

৪. প্রাচ্যবিদ মানে পশ্চিমা গবেষক, যিনি ইসলামি সভ্যতা নিয়ে লেখালেখি করেন।

উল্লিখিত সংজ্ঞায়নে বিভিন্ন ধারার গবেষকদের উক্তিগুলোর প্রতিটিতে যে জিনিসটি হাজির তা হচ্ছে, প্রাচ্যবিদ্যায় দুটি বিষয় থাকবে: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। এর মধ্যে অধিকাংশের মত হচ্ছে প্রাচ্যবিদ্যা একই সাথে জ্ঞান-তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ব্যাপার। প্রাচ্যবিদ্যা মানে ব্যাপকভাবে প্রাচ্যের যেকোনো দেশ ও জাতির সভ্যতা সংস্কৃতি এবং বিশেষভাবে ইসলাম ও আরব সম্পর্কে পশ্চিমের পড়াশোনা, জানা এবং তার মধ্য দিয়ে তার উপর পশ্চিমের রাজনৈতিক আধিপত্যের পথ সুগম ও নিশ্চিত করা। প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে এই ধারণা উনিশ শতক পরবর্তী বিশ্ব-রাজনৈতিক ঘটনাবলী দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত।
আরবী শব্দ কাঠামো সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন أ س ت যুক্ত ক্রিয়াপদ মূলত উক্ত ক্রিয়ার কামনা নির্দেশ করে। সুতরাং সেই হিসেবে الاستشراق শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রাচ্যকে কামনা করা। সুতরাং শাব্দিকভাবে শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। প্রাচ্য ভ্রমণ, প্রাচ্য নিয়ে পড়াশোনা (গবেষণা- লেখালেখি করা এবং প্রাচ্য উপনিবেশ গড়া) সবই ইসতেশরাক। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘ইসতেশরাক’ নিছক কোনো শব্দ নয়। তা একটি পরিভাষা হয়ে উঠেছে। সুতরাং শব্দটির আভিধানিক অর্থের সাথে সাথে আমাদেরকে নির্দি’ভাবে তার পরিভাষিক অর্থও জানতে হবে।

প্রাচ্যবিদ্যা শব্দটি প্রথমত এবং মূলত একটি নির্দি’ ভূগোলকে নির্দেশ করে। তবে শব্দের পারিভাষিক ব্যবহারে সেটা বিবেচ্য নয়। তাছাড়া দিকনির্ভর কোনো ভূগোলের নিজস্ব কোনো অস্তিÍত্ব নেই, নির্ধারকের অবস্থান অনুসারে তা নির্ধারিত হয়। জার্মানে অবস্থিত এক ব্যক্তির নিকট যেটা প্রাচ্য, জাপানে অবস্থানকারীর নিকট সেটা নিশ্চয় প্রাচ্য নয়।

সুতরাং শব্দটি বিচার করতে হবে ঐতিহাসিক দৃ’িকোণ থেকে। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, প্রাচীনকাল থেকে বিশ্ব শক্তি সবসময়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, প্রধানত এই শিবিরে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন রোম-পারস্যের দ্বন্ধ, অতঃপর রোম-মুসলিমদের দ্বন্ধ, অতঃপর মুসলিম-ক্রুসেডারদের দ্বন্ধ, এরপর উসমানী-ইউরোপিয়ানদের দ্বন্ধ- ইতিহাসের নানা পর্বে এই দুই শক্তি বিকশিত হয়েছে এই রূপে। বর্তমান কালে এসে পরস্পর প্রতিপক্ষ এই শিবির ভাগ হয়েছে যেই রূপে তাতে প্রথম শিবির অর্থাৎ পাশ্চাত্যের শিবিরে রয়েছে ইউরোপ আমেরিকা এবং দ্বিতীয় শিবির অর্থাৎ প্রাচ্যে রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকা।
সুতরাং শব্দটির অর্থ করতে পারি এভাবে, ইসতেশরাক মানে পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রাচ্যকে কামনা করা। অর্থাৎ প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সম্পর্ক। এই সম্পর্কের কর্তা হচ্ছে পাশ্চাত্য।

কিন্তু এই সম্পর্কের ধরণ কী এবং সম্পর্ক পাতানোর ক্ষেত্রে কর্তার মনে কী আকাঙ্ক্ষা কাজ করে? প্রাচ্যবিদ্যাকে যারা একাডেমিক, জ্ঞান-তাত্ত্বিক জায়গা থেকে বিচার করেন তারা বলেন, পশ্চিমা প-িতদের প্রাচ্য পাঠ, প্রাচ্যকে জানা, প্রাচ্যের ইতিহাস-সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার নামই প্রাচ্যবিদ্যা। আর যারা বিষয়টি বিচার করেন রাজনৈতিক জায়গা থেকে তারা বলেন, প্রাচ্যবিদ্যা মানে জ্ঞানগতভাবে পশ্চিমের প্রাচ্যকে আত্মস্থ করণ এবং তার মধ্য দিয়ে তার ওপর আধিপত্ব বিস্তার।
আমি মনে করি প্রাচ্যবিদদের প্রাচ্য নিয়ে কাজগুলো আমাদেরকে প্রাচ্যবিদ্যা বুঝতে সহযোগিতা করতে পারে। প্রাচ্যবিদদের কর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তারা সমগ্র প্রাচ্য নয়, সর্বাধিক মনোযোগ দিয়েছেন প্রচ্যের একটি বিষয়ের দিকে, সেটা হচ্ছে আরব এবং ইসলাম।

প্রাচ্যবিদ্যার এই দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখেই কোনো কোনো গবেষক প্রাচ্যবিদ্যাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: ব্যাপক এবং বিশেষ। ব্যাপক প্রাচ্যবিদ্যা কাজ করে ব্যাপকভাবে প্রাচ্যের সভ্যতা-সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা-সাহিত্য-ধর্ম-সমাজ-অর্থনীতি নিয়ে। আর বিশেষ প্রাচ্যবিদ্যা কাজ করে প্রাচ্যের একটি বিশেষ অংশ অর্থাৎ আরব সভ্যতা ও ইসলাম নিয়ে। পরবর্তীতে আমরা দেখব এই বিশেষ প্রাচ্যবিদ্যা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্যা।

আরব সভ্যতা ও ইসলাম নিয়ে প্রাচ্যবিদদের লেখা-গবেষণাগুলো পড়লে দেখা যায়, নিছক জ্ঞান অর্জনের আগ্রহে বা অন্য কোনো সদিচ্ছা নিয়ে তারা ইসলাম নিয়ে কাজ করেন নি। মূলত এই প্রাচ্যবিদরা শুরুতেই আরব সভ্যতা ও ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়েই কাজ শুরু করেন এবং সচেতন ও পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন দিক থেকে তার বিরুদ্ধে কাজ করেন। বর্তমানে ইসলাম সম্পর্কে প্রচলিত ভুল বিকৃত ধারণাগুলোর অধিকাংশের জন্ম এই প্রাচ্যবিদ্যার গর্ভে। ধর্ম সচেতন মুসলিমরা যে প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেছেন তার উৎস এই দুঃখজনক বাস্তবতা। বিভিন্ন মুসলিম দেশে জাগ্রত নানা ইসলামী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যখন ইসলামী শিক্ষা ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক নতুন প্রজন্মের বিকাশ ঘটল তখন মুসলিম সমাজে প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে এই নেতিবাচক ধারণা আরো সচেতন ও সংঘটিত বিকাশ লাভ করে। এই প্রজন্ম প্রাচ্যবিদ্যার চরিত্র, প্রাচ্যবিদদের লক্ষ্য এবং ইসলাম সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের লেখা গ্রন্থ পাঠের বিপদ সম্পর্কে মুসলিম সমাজকে সচেতন করে তুললেন। ফলে ইসলামী বিশ্বে প্রাচ্যবিদ্যা গ্রহণযোগ্যতা হারাল। ‘প্রাচ্যবিদ্যা’ ও ‘প্রাচ্যবিদ’ শব্দগুলো পরিণত হলো ঘৃণ্যতম শব্দে। এই সময়েই আমরা দেখতে পাই যে, পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম নতুন দু’টি শব্দ তৈরি করল, ‘মধ্যপপ্রাচ্য গবেষণা’ ‘মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ’। আরব, ইসলাম নিয়ে গবেষণা হয়ে উঠল ‘মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা’ এই বিষয়ের পশ্চিমা গবেষক, ‘প্রাচ্যবিদ’ বাদ দিয়ে নতুন নাম গ্রহণ করলেন ‘মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ’। বলাবাহুল্য প্রাচ্যবিদ্যার বিষয় ও লক্ষ্য কিন্তু অভিন্নই থাকল; বদলে গেল শুধু তার নাম। ‘প্রাচ্যবিদ্যা’ ও ‘মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা’ মূল স্বভাবে এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যে একই বস্তু। প্রাচ্যবিদ্যা, পরিভাষা বিশ্লেষণ, ফয়সাল বিন খালিদ, ১০-১৩

 

Check Also

ইউরোপে মুসলমানদের আগমন, অবদান এবং ইতিহাস বিকৃতি

মধ্যযুগীয় ইউরোপের অগ্রযাত্রায় স্পেনই ছিল পথ প্রদর্শকের ভূমিকায়। স্পেন তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বে’িত। পূর্ব দিকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *